চীনা হাসপাতাল নিয়ে পটিয়ায় টানাপোড়েন, ভেস্তে যাচ্ছে কেডিএস-মীরের ‘গেম প্ল্যান’

জিরি নয়, সরকারের পছন্দ হরিণখাইন

চীন সরকারের অর্থায়নে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলায় ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ নিয়ে শুরু থেকেই ছিল আশাবাদ—আর এখন তা ঘিরে সৃষ্টি হয়েছে গভীর রাজনৈতিক ও আর্থিক বিতর্ক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম পরপর দুইবার স্থান পরিদর্শন করে গেলেও প্রকল্পের সম্ভাব্য স্থান নিয়ে স্থানীয় ক্ষমতাশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠী কেডিএস ও মীর গ্রুপের হস্তক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সমীকরণে জটিলতা তৈরি হয়েছে।

কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের জামাতা জায়েম আহমেদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তদবির করে হাসপাতালের স্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করেন— এমন খবর জানা গেছে স্বাস্থ্য বিভাগীয় একটি বিশ্বস্ত সূত্রে।
কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের জামাতা জায়েম আহমেদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তদবির করে হাসপাতালের স্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করেন— এমন খবর জানা গেছে স্বাস্থ্য বিভাগীয় একটি বিশ্বস্ত সূত্রে।

প্রথম পরিদর্শন: স্বপ্ন দেখালেন দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী

গত ১৬ মার্চ নুরজাহান বেগম প্রথমবারের মতো পটিয়ার কুসুমপুরা ইউনিয়নের হরিনখাইন গ্রামে হাসপাতালের জন্য জমি পরিদর্শন করেন। এ সময় ভূমিদাতা, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আইডিয়াল স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে বৈঠক করেন তিনি। এই উদ্যোগে পটিয়া ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ একটি সরকারি হাসপাতাল পেতে আশাবাদী হয়।

দ্বিতীয় পরিদর্শন: কেডিএস-মীর গ্রুপের ‘লবিং’ ও বিতর্ক

কিন্তু ২৬ এপ্রিল, দেড় মাস পর আবারও জমি পরিদর্শনে আসেন উপদেষ্টা নুরজাহান বেগম। তবে এবার সফরের পেছনে ছিল ভিন্ন চিত্র। তথ্য অনুসারে, কেডিএস ও মীর গ্রুপের নেতৃত্বাধীন একটি প্রভাবশালী চক্র এই পরিদর্শনের সূচি প্রভাবিত করে। স্বাস্থ্য বিভাগীয় একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের জামাতা জায়েম আহমেদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তদবির করে হাসপাতালের স্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তিনিই ঢাকায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে লবিং করে এ পরিদর্শন সূচি গঠন করেন। তবে জায়গাটি এবার ছিল বিতর্কিত জিরি ইউনিয়নে, যা খলিল ও মীর গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা।

এদিকে প্রথমবারের পরিদর্শনে যেখানে স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতারা উপস্থিত ছিলেন, এবার তারা ছিলেন না। স্থানীয় সূত্র বলছে, কেডিএস-মীর গ্রুপকে তারা এস আলম গ্রুপের দোসর মনে করে এবং রাজনৈতিকভাবে তাদের সাথে সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে চলে।

স্বাস্থ্য বিভাগের স্পষ্টতা: হরিণখাইনই প্রধান বিবেচ্য

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. জাহাঙ্গীর আলম স্পষ্ট করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জিরি ইউনিয়নে হাসপাতাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সবার সুবিধার জন্য হরিনখাইন বা কর্ণফুলী ক্রসিংই উত্তম।’

সিভিল সার্জন বলেন, ‘২৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য উপদেষ্টা মহোদয় যে জায়গাটি পরির্দশনে গিয়েছেন সেখানে হাসপাতাল হচ্ছে না। সেই এলাকায় হাসপাতাল নির্মিত হলে দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষ স্বাস্থ্য সেবা পাবে না। পাবে শুধু ওই এলাকার লোকজন।

ডা. জাহাঙ্গীর আলম আরও বলেন, ‘যেহেতু চায়নার অর্থায়নে ৫০০ বেডের একটি হাসপাতাল নির্মাণ হবে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালও হতে পারে সে বিবেচনায় হাসপাতালটি গড়তে ১০ একর জায়গা প্রয়োজন হবে। আবার যোগাযোগ ব্যবস্থার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। তাই সেই বিবেচনায় পটিয়ার আইডিয়াল স্কুলের পাশের স্থান অথবা কর্ণফুলীর ক্রসিং এলাকায় হাসপাতালটি নির্মাণের সম্ভাবনা রয়েছে।’

স্থানীয়দের অভিযোগ, ক্ষমতালোভী গোষ্ঠী চীনের এই বিনিয়োগ থেকে সুবিধা আদায় করতে চাইছে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার দফতর থেকে বলা হয়েছে, ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রকল্পের টেকনিক্যালি সঠিক স্থানেই হবে।’

এদিকে স্থানীয় জনগণের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ২৬ এপ্রিলই ফেরার পথে আবারও হরিণখাইন এলাকা পরিদর্শন করেন। আজ মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে বৈঠকও হয়েছে বলে জানা গেছে।

রাজনৈতিক বিতর্ক ও এস আলমের ছায়া

পটিয়ায় হাসপাতালের জন্য জায়গা খুঁজতে স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুর জাহান বেগমের প্রথম পরিদর্শনে জামায়াত-বিএনপির নেতারা উপস্থিত থাকলেও দ্বিতীয়বার তারা অনুপস্থিত ছিলেন। স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নুর জাহান বেগমের দ্বিতীয় সফরে এস আলমের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের ছেলের শ্বশুর মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম এবং এস আলম পরিবারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের পাশাপাশি কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার উপস্থিতি নিয়ে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সেখানে পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আবুল হাসেম এবং যুবলীগ নেতা ও কেডিএস খলিলের ভাগ্নে এম ইদ্রিচ চৌধুরী অপুকেও দেখা যায়।

বিএনপির স্থানীয় নেতারা অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী এই ব্যবসায়ীরা সুযোগ বুঝে আবার পুনর্বাসিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। এস আলমের বিভিন্ন অপকর্মের তারাও অংশীদার।

গত বছরের আগস্টের শেষ দিকে চট্টগ্রাম নগরীর কালুরঘাট এলাকায় মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুস সালামের একটি ওয়্যারহাউসে লুকিয়ে রাখা ১৪টি বিলাসবহুল গোপনে সরিয়ে নেওয়া নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি হয়। মীর গ্রুপের আবদুস সালামের ফুফাতো ভাই দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ছাড়াও গাড়ি সরানোয় সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ান ও এস এম মামুন মিয়ার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় তাদের তিনজনকেই বিএনপি থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য ডিসেম্বরের শেষ দিকে তাদের বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হয়।

সাইফুল আলম মাসুদ ও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের সহায়তায় ২০১৬ সালের মে মাস থেকে দীর্ঘদিন ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন মীর গ্রুপের চেয়ারম্যান আবদুস সালাম।

গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবদুস সামাদ লাবু আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। এর পরপরই গত বছরের ১৯ আগস্ট আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক পিএলসির পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান হিসেবে ঢোকানো হয় এস আলম পরিবারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুর রহমানের ছেলে সেলিম রহমানকে। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠলে সেলিম রহমানকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

বিভিন্ন তদন্তে উঠে এসেছে, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিভিন্নভাবে ঋণের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। নামে-বেনামে এস আলম গ্রুপ এই ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ হাতিয়ে নেয়। এছাড়া এস আলমের মালিকানাধীন অন্যান্য ব্যাংকে বড় অঙ্কের অর্থ বিনিয়োগ করায় আটকে যায় আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের মূলধনও।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm