চিরকুট লিখে গায়েহলুদের দিনে চট্টগ্রামের তরুণী ঝুললেন রশিতে, যৌতুক চাইছিল ব্যাংকার বর

মেয়ের কৃষক বাবা নগদ দুই লাখ দিয়েছিলেন বরকে

বৃহস্পতিবার রাতে মেহেদি অনুষ্ঠানের জন্য চলছে নানা প্রস্তুতি আর শুক্রবার দুপুরে হবে বিয়ে। আত্মীয়স্বজনেরা আসতে শুরু করেছেন বিয়ে বাড়িতে। এরই মাঝে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে কনে রিমা আকতার (২০) আত্মহত্যা করে বসলেন। চট্টগ্রামের পটিয়ায় ঘটা এই মর্মান্তিক ঘটনার আগে রিমা রেখে গেছেন একটি চিরকুট।

বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার হাইদগাঁও ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সিরা গাজী তালুকদারের বাড়িতে ঘরের দরজা বন্ধ করে ফ্যানের সাথে রশি ঝুলিয়ে ওই তরুণী আত্মহত্যা করেন। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের কয়েক ঘন্টা আগে কক্ষের দরজা বন্ধ পেয়ে রিমাকে তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ডাকতে থাকেন। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে দেখা যায়, রিমা সিলিং ফ্যানের সাথে ঝুলে আছে। সাথে সাথে তাকে রশি কেটে নামিয়ে দ্রুত পটিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলেও তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিমা বৃহস্পতিবার বিকেল ৫টার দিকে মৃত্যুবরণ করেন।

রিমা পটিয়া সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাতে ছিল তার মেহেদী অনুষ্ঠান এবং শুক্রবার (২৮ জুন) দুপুরে ছিল বিয়ে। রিমার হবু স্বামী মিজানুর রহমান মোরশেদ একজন ব্যাংকার। তিনি আল আরাফাহ ইসলামি ব্যাংকের চাকরিজীবী। কনে রিমা ও বর মোরশেদ দুজনই একই এলাকার হওয়ায় তাদের মাঝে দীর্ঘদিন ধরে চলছিল প্রেমের সম্পর্ক। সেই সম্পর্ক পরে গড়ায় বিয়েতে।

জানা গেছে, প্রেমের সেই বিয়েতে যৌতুকের জন্যই অভিমানে প্রাণ দিতে হলো রিমাকে। দুই দিন আগেও রিমার কৃষক বাবা মনির আহমদ নগদ দুই লাখ টাকা দিয়েছিলেন বর মোরশেদের পরিবারের কাছে। ফার্নিচার নিয়ে চলছিল উভয়পক্ষের মধ্যে নানা হিসাবনিকাশ। এ নিয়ে কয়েকদিন ধরে বর মোরশেদ কনে রিমাকে মোবাইল ফোনে নানা ধরনের হুমকি ধমকি দিয়ে আসছিলেন। গত কয়েকদিন ধরে রিমাকে বিষণ্ন দেখতে পান তার স্বজনরা। তার জের ধরে অপমানে অভিমানে রিমা নিজ ঘরের সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় রশি ঝুলিয়ে আত্নহত্যা করেছেন বলে তার পরিবার সূত্রে জানা গেছে।

আত্মহত্যার আগে একটি চিরকুটে ২০ বছর বয়সী রিমা আকতার লিখে গেছেন— ‘প্রিয় শখের পুরুষ, তুমি করো তোমার বিয়ে। অনেক ভালোবেসেছি এবং অতিরিক্ত যন্ত্রণাও দিয়েছো। আমি পারছি না এত যন্ত্রণা নিতে। বাকি জীবনটা সুন্দর করে উপভোগ করতে পারলাম না, ভালো থেকো, আজকের দিনেও তোমার যন্ত্রণা আমি নিতে পারছি না। আমার পরিবার থেকে যে যৌতুকের টাকা তোমাদের দিয়েছে সেগুলো শোধ করে দিও। তুমি আমাকে বাঁচতে দিলে না, আমি বাঁচতে পারতাম যদি আমি বেশি মান-সম্মানওয়ালা পরিবারে জন্মগ্রহণ না করতাম। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও। আর আমার পোস্টমর্টেম করে আমার সব যন্ত্রণা ধুয়ে মুছে আমাকে কবরে পাঠিয়ো।’

চিরকুটের শেষে রিমা আরও লিখে গেছেন, ‘আর আমার পরিবারকে বলছি মোরশেদকে তোমরা ছাড়বে না। ওকে ওর প্রাপ্য শাস্তি তোমরা দিবা।’

রিমার ছোট চাচা নাছির উদ্দিন বলেন, ‘প্রায় তিন বছর ধরে একই এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে ব্যাংকার মিজানুর রহমানের সঙ্গে রিমার প্রেমের সম্পর্ক চলে আসছিল। এ নিয়ে আমার উভয়ের পরিবার ছেলে-মেয়ের সম্পর্ক জেনে পারিবারিকভাবেই শুক্রবার ২৮ জুন বিয়ের তারিখ ঠিক করি। বৃহস্পতিবার (২৭ জুন) রাতে হওয়ার কথা ছিল তাদের মেহেদী অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠান উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকালে রিমা ও মোরশেদ মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বলছিল। এরপর ঘরের দরজা বন্ধ করে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি ঝুলিয়ে রিমা আত্মহত্যা করে।’

রিমার ভাই আজগর হোসেন বলেন, ‘বিয়েতে বরযাত্রী খাওয়া দাওয়া বাবদ মোরশেদের পরিবারকে নগদ দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। তারপরও আমার বোনের কাছে যৌতুক হিসেবে ফার্নিচার, টিভি, ফ্রিজ এবং বিয়ের খরচ হিসেবে আরো নগদ টাকা দাবি করে। দুজনের প্রেমের সম্পর্ক থাকার পরও যৌতুক দাবি করার অপমান সইতে না পেরে আমার বোন আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তারা যে এতটা যৌতুকলোভী হবে আমরা জানতাম না। নিজের প্রাণ দিয়ে আমার বোন তাদের মুখোশ উম্মোচন করে দিয়ে গেছেন। মৃত্যুর আগে সে সুইসাইড নোটে নানা কথা লিখে রেখে গেছে।’

এদিকে রিমার লাশ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। শুক্রবার (২৮ জুন) পোস্টমর্টেম শেষে তার পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করা হবে।

পটিয়া থানার ওসি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘হাইদগাঁও এলাকায় এক তরুণীর আত্মহত্যা বিষয়টি খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে ছুটে গেছে। কিন্তু লাশ পাওয়া যায়নি। তার লাশটি হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের পরিবারের কাছ থেকে লিখিত অভিযোগ পেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm