চার বাসভর্তি লোক এনে চট্টগ্রাম প্রতিদিন অফিসের সামনে হঠাৎ বিক্ষোভ, ঢোকার চেষ্টা পুলিশের বাধায় ভণ্ডুল
দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ের সামনে অন্তত চারটি বাস থেকে নেমে আসা একদল লোক বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছে। একপর্যায়ে তারা অফিসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসন বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করে। এ ঘটনায় জামালখান এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং আশেপাশের অনেক দোকানপাট ভয়ে বন্ধ হয়ে যায়।
মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বেলা আড়াইটার দিকে চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান এলাকায় চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ের সামনে এই বিক্ষোভ ও মানববন্ধন শুরু হয়, যা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত চলতে থাকে। এভাবে পরিকল্পিত ‘মব’ তৈরির মাধ্যমে চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল বলে অভিযোগ করেছে চট্টগ্রাম প্রতিদিন কর্তৃপক্ষ।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, দুপুর দুইটার দিকে নারী ও পুরুষের একটি দল বাসে করে অজ্ঞাত স্থান থেকে এসে চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ের সামনে জড়ো হয়। কিছুক্ষণ পর আরেকটি বাসে করে আরও একটি দল সেখানে আসে। বেলা আড়াইটার দিকে শতাধিক লোক জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বিআরটিসির একটি ডাবল ডেকার বাসে করে আরও শতাধিক লোক এসে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে যোগ দেয়।
বিক্ষোভের সময় তারা চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দেয় এবং অনেকেই প্ল্যাকার্ড বহন করে, যাতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা লেখা ছিল। একপর্যায়ে সেখানে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে কোতোয়ালী থানার পুলিশ বিক্ষোভকারীদের রাস্তার একপাশে সরিয়ে দেয়।
বিকেলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ের সামনে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়। একপর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের একটি দল অফিসে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের সিঁড়ির মুখে আটকে দেয়। এ সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এর কর্মীরা কার্যালয়ের ভেতরে কার্যত অবরুদ্ধ অবস্থায় ছিলেন।
পরে কোতোয়ালী থানার পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নওশেদ কোরেশী ও শওকত আলীর মধ্যস্থতায় প্যাসিফিক গ্রুপের ‘শ্রমিক’ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় বসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এর সম্পাদক হোসাইন তৌফিক ইফতিখার। তিনি প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে যথাযথ প্রতিবাদ প্রকাশের আশ্বাস দিলে পুলিশ কর্মকর্তারা বিক্ষোভ ও মানববন্ধন বন্ধের অনুরোধ জানান। এরপর অপেক্ষমাণ বাসে করে বিক্ষোভকারীরা অজ্ঞাত স্থানে ফিরে যায়।
বিক্ষোভকারীদের অনেকে নিজেদের চট্টগ্রাম ইপিজেডের প্যাসিফিক গ্রুপের কর্মী বলে পরিচয় দেন সংবাদকর্মীদের কাছে। তাদের কেউ কেউ কারখানার আইডি কার্ডও গলায় ঝুলিয়ে রাখেন। তবে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া কয়েকজন জানান, তারা কেন এসেছেন তা জানেন না। চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) অবস্থিত প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালসের মালিক সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীর। তিনি প্যাসিফিক জিন্সের প্রতিষ্ঠাতা নাছির উদ্দিনের ছেলে।
কোন্ সংবাদের প্রতিবাদ করছেন— এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘আমি এসব কিছু জানি না।’ অন্যদিকে ‘বিচার চাই, বিচার চাই’ শ্লোগান দেওয়া অপর এক যুবককে কিসের বিচার চাইছেন— এমন প্রশ্ন করা হলে ওই যুবক নিরুত্তর থাকেন।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, তাদের মালিকের নামে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছে। তাদের মালিক কোনো বেতন-ভাতা বকেয়া রাখেননি এবং শুধু শুধু হয়রানি করা হচ্ছে। গত ৩০ বছর ধরে প্যাসিফিক গ্রুপের এমন কোনো রেকর্ড নেই। তারা দাবি করেন, তাদের কোম্পানি সরকারি নীতিমালার চেয়েও বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে।
মানববন্ধনে প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালস লিমিটেডের কোয়ালিটি বিভাগের ডেপুটি ম্যানেজার কাইয়ুম ও নাইম হোসেন বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম সিইপিজেড থেকে এখানে এসেছি, কারণ আমাদের আবেগ ও অনুভূতিতে আঘাত করা হয়েছে। গত ৩০ বছর ধরে প্যাসিফিক গ্রুপ সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। গতকাল চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এ প্রকাশিত সংবাদ আমাদের কোম্পানির মানহানি করেছে। আমরা এই সংবাদের তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আমরা এর বিপরীতে চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এর পক্ষ থেকে ভালো সংবাদ আশা করছি।’
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রতিদিন-এর সম্পাদক হোসাইন তৌফিক ইফতিখার বলেন, ‘প্রকাশিত কোনো সংবাদের বিষয়ে আপত্তি বা অভিযোগ থাকলে শান্তিপূর্ণভাবে সেটি জানানোর উপায় রয়েছে। তবে এভাবে ‘মব’ তৈরির মাধ্যমে মূলত চাপ সৃষ্টি করতেই চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ের সামনে লোক জড়ো করে হামলা চালানোর পরিকল্পনা ছিল বলে আমরা ধারণা করছি।’
তিনি বলেন, ‘কোনো অন্যায় চাপের মুখে অতীতেও আমরা নত হইনি, ভবিষ্যতেও কখনোই আমরা নতি স্বীকার করবো না।’
টানা দুদিন ধরে বন্ধ প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালস
চট্টগ্রামে রোববার থেকে টানা দুই দিন ধরে প্যাসিফিক নিট ডিভিশনের সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালস লিমিটেডের দুটি কারখানা বন্ধ হয়ে রয়েছে। এর ফলে এই দুটি ইউনিটে কর্মরত অন্তত ছয় হাজার শ্রমিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছেন। তারা খাদ্য ও চিকিৎসা ভাতা বাড়ানোর দাবি তোলার পরই কর্তৃপক্ষ কারখানা বন্ধের ঘোষণা দেয় বলে শ্রমিকরা অভিযোগ তোলেন। রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় একটি বিজ্ঞপ্তি ঝুলিয়ে প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালসের ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ বন্ধের ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ।
কারখানার মানবসম্পদ ও প্রশাসন বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার স্বাক্ষরিত ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘ইপিজেড শ্রম আইন ২০১৯-এর ১২(১) ধারা অনুযায়ী, এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকরা অবৈধভাবে উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছেন এবং অযৌক্তিক দাবি তুলেছেন, যা কারখানার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করছে। এ কারণে ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ইউনিট দুটি বন্ধ থাকবে।’
এর জের ধরে সোমবার সকালে সিইপিজেডে শ্রমিকদের দুই পক্ষের সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে সিইপিজেড এলাকার বেপজা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। পরে প্যাসিফিকের দুই কারখানার সামনে অবস্থান নেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। প্যাসিফিক ক্যাজুয়েলসের শ্রমিকদের কারও কারও অভিযোগ, একই গ্রুপের এনএইচটি ফ্যাশন লিমিটেডের শ্রমিকদের উস্কানি দিয়ে তাদের ওপর হামলা করানো হয়েছে।
এদিকে কারখানা খোলার কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা— এ বিষয়ে জানার জন্য প্যাসিফিক ক্যাজুয়ালসের মালিক সৈয়দ মোহাম্মদ তাহমীরের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে সাড়া মেলেনি।
সিপি