চাটগাঁইয়া গান— নকল বা চুরির উৎস সন্ধান

সংগীতগুণীরা বলেন, খাঁটি লোকসংগীতের সুর কখনও নির্দিষ্ট থাকে না, উৎস থেকে বেরিয়ে বহতা নদীর মতো এঁকেবেঁকে ফুলেফেঁপে বয়ে চলে। চলার সময় সেই সুরনদী প্লাবিত করে দুকূল— সেই প্লাবনে সৃষ্টি হয় নতুন সুর, নতুন গান। কালের প্রবাহে লোকসংগীত ভেঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক কিংবদন্তী শিল্পী অসংখ্য চিরসবুজ গান সৃষ্টি করেছেন। লোকসংগীত-রঞ্জিত এসব গানকে ‘চৌর্যবৃত্তি’র (নকল বা চুরি) পর্যায়ে ফেলা যথার্থ নয়।

শিল্পে ‘চৌর্যবৃত্তি বা ‘অনুকরণ-অনুসরণ’ নতুন কিছু নয়, নতুন নয় তা চাটগাঁইয়া গানেও। কিন্তু চৌর্যবৃত্তি আর অনুকরণ-অনুসরণ এক জিনিস নয়। অন্য কারও সৃষ্টি লাইন বাই লাইন কপি না করলে তাকে ‘চুরি বা ‘নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া’ বলা যায় না। শিল্প-সাহিত্যে চৌর্যবৃত্তি অবশ্যই গর্হিত কাজ, কিন্তু অনুকরণ-অনুসরণকে এই কাতারে ফেলা যায় না, ফেললে অনেক কালজয়ী সাহিত্য-সংগীত এবং সেসবের স্রষ্টাকে বাতিল করতে হবে।

চাটগাঁইয়া সংস্কৃতিতে অনুকরণ ও অনুসরণ-চেষ্টায় সৃষ্ট অসংখ্য গান কালজয়ী গান হিসাবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে, সাংগীতিক পরিভাষায় সেসব গানকে বলা হয় ‘ভাঙা-গান’। দেশি-বিদেশি যেসব গান শিল্পীরা নিজে বা অন্য কারোর কাছে শুনে মুগ্ধ হয়ে সুর-কাঠামো অনেকাংশে ঠিক রেখে তাতে বাণী বসিয়েছেন— সেগুলিকেই ভাঙা-গান বলা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, ডিএল রায়, শচীন দেববর্মণসহ সংগীতের অনেক বরপুত্র অন্যের গান অনুসরণ করে ভাঙা-গান সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো আজ বাঙালির প্রাণের গান। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাঙা-গান আছে ২৩৩টি। মধ্বয়সে বাংলা গ্রামীণ গান ভেঙে অনেকগুলি গান বানান রবীন্দ্রনাথ। এ ক্ষেত্রে তাঁর কালজয়ী গানটি হলো— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি।’ লালন-শিষ্য গগন হরকরার সর্বশ্রেষ্ঠ গান ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’ গানটি ভেঙ্গে রবিঠাকুর এই অমর দেশাত্মবোধক গানটি সৃষ্টি করেছেন। যেটি আজ আমাদের জাতীয় সংগীত।

চাটগাঁইয়া গানে উল্লেখযোগ্য ভাঙা-গান হলো লোকসংগীতের প্রবাদপুরুষ কবিয়াল রমেশ শীলের ‘আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লই’, খায়েরজ্জামা পণ্ডিতের ‘বানারশি গামছা গায় ভগ্নির’, মলয় ঘোষ দস্তিদারের ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি’ এবং ‘ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’, মোহন লাল দাশের ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’, শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের ‘ওরে নুরানী বালা’ এম এন আখতারের ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে’, আবদুল গফুর হালীর ‘বানুরে, জি জি জি’, ‘ ন মাতাই ন বুলাই গেলিরে বন্ধুয়া’, সনজিত আচার্যের ‘কি গান মাঝি হুনাইল’ ইত্যাদি।

অনুকরণে সৃষ্ট ‘ছোড ছোড ঢেউ’ ও ‘আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান’

আঞ্চলিক গানের দুজন কিংবদন্তী রচয়িতা মলয় ঘোষ দস্তিদার ও মোহনলাল দাশের দুটি বিখ্যাত গান নিরীক্ষণ করা যাক—

গান-১
ছোড ছোড ঢেউ তুলি, কথা ও সুর : মলয় ঘোষ দস্তিদার

ছোড ছোড ঢেউ তুলি
লুসাই পাহাড়ত্তুন লামিয়ারে
যার গই কর্ণফুলী।
এক কুলদি শহর বন্দর
নগর কত আছে
আরেক কুলত সবুজ রোয়ার মাথাত
সোনালি ধান হাসে
গাছর তলায় মলকাবানুর গান
গোরপ পোয়া গায় পরান খুলি।
পাহাড়ি কন সোন্দরী মাইয়া
ঢেউর পানিত যাই
সিয়ান গরি উডি দেখের
কানর ফুল তার নাই
যেইদিন কানর ফুল হাজাইয়ে
হেইদিনত্তুন নাম কর্ণফুলী।।

গান-২
পানির বুগত ঢেউ তুলি, কথা ও সুর : মোহন লাল দাশ

পানির বুগত ঢেউ তুলি
চলের দুই কুলদি ঢেউ তুলি
ছলছলাইয়া কলকলাইয়া
যার গই কর্ণফুলী।
দুই কুলে তার শ্যামল ক্ষেত
আছে পীর বদর
আরো কত আছে ভাইরে
শহর বন্দর
বাহার মারি যার গই সাম্পান
তালে তালে দাঁড় ফেলি।।
রাঙামাটি পাহাড়ি কন্যা
খোঁপায় রাঙা ফুল
সেয়ান গইত্যে আই হাজাইয়ে
তার কানর কর্ণফুল
কাইছা খালর নাম হইয়ে
হেদিনত্তুন কর্ণফুলী।।
(সূত্র : চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান-কল্যাণী ঘোষ, বাংলা একাডেমি)

মলয় ঘোষ দস্তিদারের আরেকটি কালজয়ী আঞ্চলিক গানের (ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান) সাথেও কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তীর একটি গানের হুবহু মিল পাওয়া যায়। এখানেও মলয় ঘোষের গানটিই বহুল প্রচারিত এবং তুমুল জনপ্রিয়। নিচে গান দুটির অংশবিশেষ তুলে দেওয়া হলো—

গান-১
ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান

(কথা ও সুর : মলয় ঘোষ দস্তিদার)

ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান
দইজ্যার কুলত বসত গরি
সিনা দি ঠেগাই ঝড় তুয়ান।

গান-২
চাটগাঁইয়া নওজোয়ান আঁরা
(কথা ও সুর :অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী)

চাটগাঁইয়া নওজোয়ান আঁরা
হিন্দু মুসলমান
দৈর্গার কুলত বসত গরি
ঠেগাই ঝড় তুয়ান।।

এখানেও প্রশ্ন গান দুটির পাঠ প্রায় একই, তাহলে কে কাকে অনুকরণ-অনুসরণ করেছেন? এটা কি চৌর্যবৃত্তি?

আবদুল গফুর হালী কেন লক্ষ্য

সাম্প্রতিক সময়ে চাটগাঁইয়া গানে ‘চৌর্যবৃত্তি’ নিয়ে বেশ আলোচনা শোনা যায়। চাটগাঁইয়া গান বলতে আমি প্রধানত আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানকেই বুঝিয়েছি। আর এসব আলোচনার প্রধান লক্ষ্য হলেন সাধক-শিল্পী আবদুল গফুর হালী। কোনো কোনো গবেষক বা শিল্পী আবদুল গফুর হালীকে অশোভন ভাষায় আক্রমণ করে পত্রিকা বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি করছেন। কেউ কেউ আবদুল গফুর হালীর গানে সাধক-শিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিত, খায়েরজ্জামা পণ্ডিত বা রমেশ শীলের গানের প্রভাব লক্ষ্য করে ঢালাওভাবে তাকে ‘চৌর্যবৃত্তি’র দায়ে অভিযুক্ত করছেন। আবার এখন অশ্লীল গানের কোনো কোনো শিল্পীও দু-চারটা ক্যাসেট করে জাতে ওঠার পর আবদুল গফুর হালীর মতো কালজয়ী সংগীতজ্ঞের গান নিয়ে প্রশ্ন তোলার দুঃসাহস দেখাচ্ছেন।

এটা অবশ্যই স্বীকার্য যে আবদুল গফুর হালীর গানে আস্কর আলী পণ্ডিত বা রমেশ শীলের গানের সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। কিন্তু প্রভাব থাকা আর অন্যের গান ‘নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া’ একই জিনিস নয়। তার বিরুদ্ধে ‘চৌর্যবৃত্তি’র অভিযোগ তোলা নিতান্তই বিদ্বেষপ্রসূত। যে মানদণ্ডে হালীর বিরুদ্ধে ‘চৌর্যবৃত্তি’র অভিযোগ তোলা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি তথাকথিত ‘চৌর্যবৃত্তি’র চেষ্টা দৃশ্যমান রমেশ শীল, অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী, মলয় ঘোষ দস্তিদার, মোহন লাল দাশ, এমএন আখতার বা সনজিত আচার্য্য ও সিরাজুল ইসলাম আজাদের গানে। একজনের গানের সাথে অন্যজনের গানের এই আশ্চর্য মিল কি চৌর্যবৃত্তি, না শিল্পের মুন্সিয়ানা?

লোকসংগীত গুরুমুখী নয়, গণমুখী

লোকসংগীতের রাজা ছিলেন আব্বাস উদ্দীন আর রাগ সংগীতের রাজা ছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়। তবে একই সঙ্গে উভয় সংগীতেরই রাজা ছিলেন একমাত্র শচীন দেববর্মণ। সেজন্য উভয়েই গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন কর্তাকে।’ (সংগীত বিচিত্রা-আবদুশ শাকুর)।

রাগ সংগীতে শচীনকর্তা ফৈয়াজ খাঁ, ভীষ্মদেব বা আলাউদ্দীন খাঁ’র মতো সংগীত মহারথীর শিষ্য ছিলেন, কিন্তু তিনি লোকসংগীত শিখলেন কোথায়? উত্তর হলো কুমিল্লায়— তার জন্মভুমিতে। তবে কোনো পেশাদার গুরুর কাছে নয়— কর্তা লোকসংগীত শিখেছেন গণমানুষের কাছে, মাটির বুকে কান পেতে। শচীন-কর্তার লোকগানের ভাণ্ডারী ছিলেন সায়েব আলী, যিনি পেশায় ঘর ছাওয়ার কাজ করতেন। তাই তো শচীন দেববর্মণ বলেছেন, ‘লোকসংগীত গুরুমুখী নয়, গণমুখী। লোকসংগীতের কোনো ঘরানা নেই, আছে বাহিরানা।’ (সরগমের নিখাদ- শচীন দেববর্মণ)।

আমাদের চাটগাঁইয়া গানের প্রধান রূপকার আস্কর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীল, আবদুল গফুর হালীদেরও সংগীতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই বললেই চলে, পুঁথিগত বিদ্যার দৌড়ও সামান্যই। তাহলে তারা কোন্ যাদুবলে বাংলা লোকসংগীতের দিকপাল হয়ে উঠলেন? ওই যে উত্তর একটাই— তারা শিখেছেন গণমানুষ থেকে, মাটি থেকে, প্রকৃতি থেকে এবং তাদের শুরুটা হয়েছে পূর্বসূরীকে অনুকরণ অনুসরণ করে। এখন প্রশ্ন হলো অনুকরণ-অনুসরণ কি অন্যায়?

রবিঠাকুরের ভাঙা-গান

শতবছর আগে নাগরিক কবি হওয়া সত্ত্বেও সযত্নে ও সানুরাগে লোকসংগীতের ভাববিচিত্রা ও গঠনভঙ্গি আত্মস্থ করে অভিনব রূপে ‘কাজে’ লাগিয়েছিলেন তার কাব্যসংগীতে। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ সংগীততাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন— ‘যখন থেকে দেশি সংগীত, অর্থাৎ বাউল, কীর্তন, ভাটিয়ালের স্রোত তার প্রতিভাকে অনুপ্রাণিত করলে তখনই তিনি (রবীন্দ্রনাথ) নিজের সন্ধান পেলেন, স্বাধীন হলেন। এতদিন হচ্ছিল অনুকরণ, হাতেখড়ি, এখন শুরু হ’ল সৃষ্টি। …মাটির সন্ধান পেয়েছেন বলে রবিবাবু সংগীতকে নবজীবন দিতে পেরেছেন।’ (‘সংগীত সমালোচনা’, পৃষ্ঠা-১৪৩, ধূর্জটিপ্রসাদ রচনাবলী, ২য় খণ্ড, দেজ পাবলিশিং, কলকতা)।

আসলে রবীন্দ্রনাথ এই বাংলা মায়ের রত্নের সন্ধান পান উনিশ শতকের শেষ দিকে, যখন তিনি জমিদারি সূত্রে পদ্মাতীরের অনেক গ্রামীণ জনপদ প্রত্যক্ষভাবে দেখলেন এবং গভীরভাবে জানলেন। শিলাইদহে বাউল ফকিরদের স্বচক্ষে দেখলেন প্রথম, তাদের গান শোনেন, সংগ্রহ করেন। বাংলা সংগীতে এর ফল মধুরতম।

চলতি হিসাব মতে, রবীন্দ্রসংগীতের মোট সংখ্যা দুই হাজার ২৩২। এর প্রধান দুটি ভাগ— মৌলিক আর ভাঙা-গান। একেবারে ছোটবেলা থেকে জীবনের শেষভাগ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ দেশি-বিদেশি যেসব গান নিজে বা অন্য কারুর কাছে শুনে মুগ্ধ হয়ে সুর-কাঠামো অনেকাংশে রেখে তাতে বাণী বসিয়েছেন, সেগুলিকেই ভাঙা-গান বলা হয়। এ খাতে তিনি উপহার দিয়েছেন ২৩৩টি গান। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ঘিরে রবীন্দ্রনাথ যে অতুলনীয় দেশাত্মবোধক গানগুলো সৃষ্টি করেন তার কিছু মৌলিক কিছু লোকগীতি-ভাঙা। স্মরণ করা যাক-লালন শিষ্য গগন হরকরার সর্বশ্রেষ্ট গানটি— ‘আমি কোথায় পাব তারে/আমার মনের মানুষ যে রে’।

গগন হরকরার গানটির থিম ছিল নিঃসঙ্গ বাউলের ‘মনের মানুষের’ জন্য আর্ত অনুসন্ধান— যা একান্তই ব্যক্তিগত ব্যাকুলতা। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিক আর্ত উচ্চারণকে ভেঙ্গে নিজের গানে এনে দিলেন স্বদেশপ্রেম-প্রাণিত সামষ্টিক উদ্বোধন। গানটি দাঁড়াল— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি/চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ আর সেই গানটি আজ বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভক্তিরসে আপ্লুত, আখরযুক্ত ঢপকীর্তন ধাঁচের গান ‘হরি নাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার একলা নিতাই’ ভেঙ্গে সৃষ্টি করেন তার অমর গান ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’।

আধুনিক বাংলা গানেও এ ধরনের ভাঙা-গান অসংখ্য। বিদেশী গানের সুরে ‘আই এম এ জলি গুড ফেলা’র স্টাইল অনুসরণ করে সুধীন দাশগুপ্ত সৃষ্টি করেছিলেন সতীনাথের গাওয়া বিখ্যাত সেই গান ‘আকাশ এত মেঘলা/ যেও না কো একলা’। (সূত্র: কথায় কথায় রাত হয়ে যায় : পুলক বন্দোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-১১৬)

ভাণ্ডারী গানের সুরে মোহন লাল দাশের ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’

চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাসে মোহন লাল দাশের ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ গানটি একটি চিরসবুজ গান। ১৯৬৮ সালে শেফালী ঘোষের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ডের গান এটি। এই গান দিয়েই শিল্পী শেফালী ঘোষের উত্থান। এই একটি গানই শেফালী ঘোষকে রাতারাতি তারকা বানিয়ে দেয়। কিন্তু এই গানটির সুর কি মৌলিক? কিংবদন্তী সংগীতজ্ঞ মোহন লাল দাশের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলছি ‘ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দেওয়ানা’ গানটির সুর কিন্তু একটি মাইজভাণ্ডারী গান থেকে নেওয়া। আদি বা উদ্ভব পর্বের ভাণ্ডারী গান ‘নয়নে নয়নে রাখিব রে শাম তোরে পাইলে’ এর সুরে মোহন লাল দাশ সৃষ্টি করেন তার কালজয়ী গান ‘ওরে সাম্পানওয়ালা’। শুধু তাই নয় মোহন লাল দাশের আরেকটি অমর সৃষ্টি ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’ গানটির সুরও কিন্তু মাইজভাণ্ডারী গান থেকে নেওয়া— যেটি গেয়েছিলেন গজলসম্রাট মেহেদী হাসান। মাইজভাণ্ডারী গানের আদি রচয়িতা মৌলানা আবদুল হাদীর একটি সাধন-সংগীত ‘না জানি কী ধন আছে চরণে তোমার/যত দেখি তত সাধ দেখিতে আবার’ গানটি থেকে ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়’ গানটির সুর নেওয়া হয়েছে। (সূত্র : রত্নভাণ্ডার ২য় খণ্ড)।

প্রসঙ্গ সিরাজুল ইসলাম আজাদ

শিল্পী শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের একটি সুপারহিট গান ‘ওরে নুরানী বালা’— এটিও একটি ভাঙা-গান। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের ‘রামাইয়া বস্তা ভাইয়া’ গানটির সুরে ‘নুরানী বালা’ গানটি তৈরি করা হয়েছিল। এই গানটি থেকে তৈরি হয়েছে চট্টগ্রামের জনপ্রিয় আঞ্চলিক গান ‘ওরে কালা ভ্রমরা আঁই আইজও ফুলর হরা’ গানটি— যার গীতিকার হিসাবে পরিচিত বিখ্যাত মরমী শিল্পী সেলিম নিজামীর পিতা এমএম রশিদ কাওয়াল। যদিও এখন এই গানের গীতিকার হিসাবে সিরাজুল ইসলাম আজাদের নাম লেখা হয়। কিন্তু রশিদ কাওয়ালের পরিবারের দাবি, সিরাজ ছিলেন রশিদ কাওয়ালের শিষ্য। সে সূত্রে গানটি সিরাজকে গাইতে দেওয়া হয়েছিল। রশিদ কাওয়াল মারা যাওয়ার পর গানটি সিরাজ তার লেখা বলে দাবি করতে থাকেন।

সিরাজুল ইসলাম আজাদের সবচেয়ে জনপ্রিয় গান ‘ও মামুরে হেডমাস্টরে তোঁয়ারে তোয়ার’ গানটির সুর আস্কর আলী পণ্ডিতের একটি কম প্রচলিত গান ‘ওরে সন্ধ্যা বেলা, তোরে হনে দিল চম্পা ফুল’ এর মুখরা থেকে নেওয়া। আবার সিরাজের জনপ্রিয় গান ‘আইজকাল আঁই আইলে এন ক্যা গরঅ/আগর ডইল্যা দেইত নঅ পার’ গানটির সুর হুবহু নেওয়া হয়েছে কিংবদন্তী শিল্পী সনজিত আচার্য্য রচিত ও আঞ্চলিক গানের রানী কল্যাণী ঘোষের গাওয়া ‘এন গরি ক্যা শীত পরের/বন্ধু আঁর নাই ঘরে’ থেকে। এসব দোষের কিছু নয়। কারণ দেখা যায়, অনেক সময় মূল গানের চেয়ে ভাঙা গানের জনপ্রিয়তা বেশি হয়।

অনুসরণে সৃষ্ট জনপ্রিয় দ্বৈত গান

দ্বৈত কণ্ঠের আঞ্চলিক গানের ইতিহাসে চারটি গান মাইলফলক— এগুলো হলো ‘নাইওর গেলে বাপোর বাড়ি’, ‘বাছুরে, জি জি জি’, ‘বানুরে, জি জি জি’ এবং ‘বাজান গেইয়ে দইনর বিলত’। কালজয়ী শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর জুটির প্রথম দ্বৈত আঞ্চলিক গান হলো—

স্ত্রী : ‘নাইওর গেলে বাবোর বাড়ি
আইস্য ত্বরাত্বরি
খাইল্যা ঘরত তোঁয়ারে ছাড়া
থাইক্যুম কেন গরি।।
স্বামী : বেশিদিন ন থাইক্য তুঁই
ঘর গিরস্তি ছাড়ি
পতর মিক্যা চাই থাইক্যুম
আইওর আইওর গরি।।
(সূত্র : চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান—কল্যাণী ঘোষ)

চট্টগ্রাম বেতারের তখনকার আঞ্চলিক পরিচালক আশরাফুজ্জামানের একান্ত উদ্যোগে শ্যাম-শেফালী প্রথম দ্বৈতকণ্ঠে আঞ্চলিক গান করেন। এই গান দিয়ে শ্যাম-শেফালী জুটি শুরু হলেও আবদুল গফুর হালী রচিত ‘ন যাইও ন যাইও আঁরে ফেলাই বাপর বাড়িত ন যাইও’ দ্বৈত গানটি দিয়েই এই জুটির জনপ্রিয়তা শুরু।

ব্যক্তিগত আলাপে শিল্পী সনজিত আচার্য আমাকে জানিয়েছেন, গফুর হালীর ‘নাইয়র’ গানটি দিয়েই শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর জুটির উত্থান। এখানে উল্লেখ্য, মলয় ঘোষ দস্তিদারের গানের সাথে গফুর হালীর গানটির সুন্দর সাদৃশ্য রয়েছে, কিন্তু দুটি গান আপন বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। ঠিক তেমনি এমএন আখতার ও আবদুল গফুর হালী রচিত আরো দুটি চিরসবুজ দ্বৈত আঞ্চলিক গানেও কথা ও ভাবের আদান-প্রদান লক্ষ করা যায়। এমএন আখতার রচিত ও এমএন আখতার-ঊমা খানের গাওয়া গানটি এরকম—
আখতার : বাছুরে
ঊমা : জি
আখতার : ও বাছু
উমা : জ্বী জ্বী জ্বী
আখতার : আঁই যাইয়ম চাঁডিয়া শঅরত তোঁয়াল্লাই আইন্যম কি?
উমা : শাড়ি চুড়ীর কথা কইলে পিরীত ভাঙ্গি যায় দি
কোন কিছুর হারা দিলে ফাল দি উড তুই যদি
হেই কথাল্লাই ডরে ন যাইর তোঁয়ার কাছদি।

(মানবদরদী সুরসাধক এমএন আখতারের গান, পৃষ্ঠা-৩০৭)

আবদুল গফুর হালী রচিত শেফালী-শ্যামের গাওয়া গানটি এরকম—
স্বামী: বানুরে
স্ত্রী : জি
স্বামী : ও বানু
স্ত্রী : জি জি জি
স্বামী : আই যাইয়ম রেঙ্গুম শঅরত তোয়াল্লাই আইন্যম কি
স্ত্রী : শাড়ি চুুলির আশা গরি রেঙ্গুম যাইতাম দি যদি
সোনার যৈবন কেনে রইখ্যম গামছা দি বাঁধি।

এমএন আখতার ও আবদুল গফুর হালীর উপরোক্ত গান দুটির কথা ও সুর প্রায় একই হলেও দুটি গানই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের ইতিহাসে অমর গান হিসেবে গণ্য হচ্ছে। সুখের বিষয়, এত কাছাকাছি গানের কথা আর সুর হওয়ার পরও এই দুই কিংবদন্তী সংগীতজ্ঞ কখনও একে অপরকে গান নকলের দায়ে অভিযুক্ত করেননি।

শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব জুটি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে চট্টগ্রাম ছাড়িয়ে জাতীয় পর্যায়ে এমনকি বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। অনেকটা চলচ্চিত্রে উত্তম-সুচিত্রা, রাজ্জাক-কবরী জুটির মতো সংগীতেও (তাও একটি অঞ্চলের গানে) জুটি প্রথার একমাত্র নজির শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর। তাদের প্রথম দ্বৈত (ডুয়েট) গানটি ছিল মলয় ঘোষ দস্তিদার রচিত ‘নাইয়র গেলে বাপর বাড়ি আইস্য তরাতরি’। কিন্তু চট্টগ্রামের দ্বৈত আঞ্চলিক গানেরও পথিকৃৎ রচয়িতা হলেন রমেশ শীল। মলয় ঘোষ দস্তিদারের অনেক আগেই দ্বৈত আঞ্চলিক গান রচনা করেছেন রমেশ শীল।

আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম ও কইলজার ভিতর গাঁথি রাই্যখম

এমএন আখতার রচিত চিরসবুজ একটি আঞ্চলিক গান হলো ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে।’ ১৯৭৭ সালে সাবিনা ইয়াসমিন ও এমএন আখতারের কণ্ঠে গ্রামোফোন রেকর্ডে এই গান বের হয়। গত তিন যুগ ধরে এই গান চট্টগ্রামের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। বছরআটেক আগে ক্লোজআপ ওয়ান তারকা সালমার কণ্ঠে গানটি রিমিক্স হওয়ার পর সারাদেশে এই গানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন এমএন আখতার ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে’ গানটির সুর নিয়েছেন রমেশ শীলের বিখ্যাত আধ্যাত্মিক গান ‘আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লই’ থেকে। সত্তরের দশকে এই গানটি শেফালী ঘোষের কণ্ঠে দারুণ জনপ্রিয় হয়।

এখন প্রশ্ন হলো এমএন আখতার যদি রমেশ শীলের গান থেকে তার ‘কইলজার ভিতর’ গানটির সুর নেন, তাহলে রমেশ শীল কোথা থেকে নিয়েছিলেন? রমেশ শীলের ‘আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লই’ গানটির সুরের সাথ আস্কর আলী পণ্ডিতের একটি আধ্যাত্ম চেতনাপুষ্ট গান ‘এবার মরিমরে আমি বিষ খাইয়া’র দারুণ মিল রয়েছে। তাহলে এখন ‘চৌর্যবৃত্তি’র দায়ে কাকে অভিযুক্ত করা হবে— রমেশ শীল, না এমএন আখতারকে? নাকি দুজনকেই? আসলে এটা চৌর্যবৃত্তি নয়, শিল্পের কটুম্বিতা। রমেশ শীল আর আস্কর আলী পণ্ডিত প্রায় সমসাময়িক শিল্পী। আস্কর আলীর ডেরায় যাতায়াত ছিল রমেশেরও। আবার রমেশ শীলের সংগীত জীবনের শেষ দিকে এমএন আখতারদের উত্থান। সুতরাং তাদের সংগীতের স্বপ্ন একই সূত্রে গাঁথা। আস্কর আলী পণ্ডিতের গানের সুর অনুসরণ করে রমেশ শীল আর এমএন আখতার যে দুটি গান সৃষ্টি করেছেন পরবর্তীকালে দুটি গানই কালজয়ী গান হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। একটু কান পাতলেই বোঝা যায়, গান দুটির সুরের উৎস আস্কর আলী পণ্ডিতের ‘এবার মরিমরে আমি বিষ খাইয়া’ হলেও দুটি গানই সুর ও ভাবে স্বতন্ত্র ঐশ্বর্যমণ্ডিত। দুটি গানই খ্যাতিতে আস্কর আলী পণ্ডিতের গানটিকে অতিক্রম করেছে। চাটগাঁইয়া গানের ইতিহাসে এমএন আখতারের ‘কইলজার ভিতর গাঁথি রাইখ্যম তোঁয়ারে’ ও রমেশ শীলের ‘আঁধার ঘরত রাইত কাডাইয়ম কারে লই’ গান দুটি মাইলফলক হয়ে আছে। (সূত্র : রমেশ শীল রচনাবলী, বাংলা একাডেমি ও মানবদরদী সুরসাধক এমএন আখতারের গান)

গফুর হালীর গান অনুসরণে সনজিত আচার্যের গান

আবদুল গফুর হালী পূর্বসূরীর গান ভেঙে যেমন নতুন গান সৃষ্টি করেছেন, তেমনি হালীর গান ভেঙ্গেও উত্তরসূরী শিল্পীরা অনেক জনপ্রিয় গান তৈরি করেছেন। গফুর হালীর একটি ভাবের গান ‘এতদিনে বুঝিতরে পাইল্যাম/আঁর লাই বুলি তোর নাই আদর’ এর সুরে শিল্পী সনজিত আচার্য সৃষ্টি করেছেন আরেকটি অসাধারণ দ্বৈত গান। সনজিত আচার্য ও শিল্পী রানীর কণ্ঠে গানটি এখনো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সনজিতের গানটি এরকম :
মেয়ে : বাজান গিয়ে দইনর বিলত
পাটি বিছাই দিয়্যি বইও ঘরত
ছেলে : শীতল পাটির বৈডক ন চাইরে
তোর বাপ থাইব হই নাই ঘরত
তাত্তুন নাই মনত।

শুধু চট্টগ্রামে নয় জাতীয় পর্যায়েও আবদুল গফুর হালীর আঞ্চলিক গান ভেঙ্গে নতুন গান তৈরি হয়েছে, গফুর হালীর জনপ্রিয় আঞ্চলিক লোকনাট্য ‘নীলমণি’র জনপ্রিয় একটি গান প্রমিত বাংলায় রূপান্তরিত করে এন্ড্রু কিশোর আর সাবিনা ইয়াসমিনের মতো শিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়েছে। ‘নীলমণি’ নাটকের নায়িকা অঞ্জু ঘোষের মাধ্যমে ওই গানটি চলচ্চিত্রে স্থান পায়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গফুর হালীর গানটি এরকম—
হাজেরা : ও মাঝি ভাই আঁত্তে পারর কড়ি নাই
তোঁয়ার নৌকাত গরি আঁরে পার গরাইবানি
টুনু : আঁই পার করি দিওম তোঁয়াত্তুন পৈসা ন লইওম
সত্য গরি কও তোঁয়ার বিয়া হইয়েনি।

জনপ্রিয় শিল্পী রবি চৌধুরী আবদুল গফুর হালীর গান ‘রতন কাঞ্চন বোঝাই লইয়ারে’ গানের সুরে কথা বসিয়ে নতুন গান বানিয়েছেন।

গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী হিসাবে আবদুল গফুর হালী একজন কালজয়ী প্রতিভা। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গানে রমেশ শীলের পর তিনি আরেকজন নবযুগের স্রষ্টা। চট্টগ্রামের নিজস্ব দুটি সংগীতধারা আঞ্চলিক ও মাইজভাণ্ডারী গান যে আজ বাংলা লোকসংস্কৃতির অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তাতে রমেশ শীলে পর আবদুল গফুর হালীর অবদান সবচেয়ে বেশি। আবদুল গফুর হালী আঞ্চলিক নাটকের পথিকৃৎ রচয়িতাও। শুধু তাই নয়, গফুর হালী বর্তমানে দারুণ জনপ্রিয় সংগীতধারা ‘মোহছেন আউলিয়ার গানেরও’ প্রবক্তা। নইব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে অডিও বাজারের প্রয়োজনেই শিল্পী শিমুল শীলকে দিয়ে ‘মোহছেন আউলিয়ার’ গান নামে নতুন ধারার গান সৃষ্টি করেন আবদুল গফুর হালী ও এমএন আখতার।

আবদুল গফুর হালীর ‘ভাঙা-গান’

উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায়, সংগীতে পূর্বসূরীর প্রভাব থাকা দোষের কিছু নয়, পূর্বসূরীকে অনুকরণ-অনুসরণ করেও অনেক কালজয়ী গানের জন্ম হয়েছে। রবিঠাকুরের মতোই চাটগাঁইয়া গানের প্রধান রূপকারদের সংগীতসম্ভারে এরকম অনেক ভাঙা-গান দেখা যায়। আস্কর আলী পণ্ডিত, রমেশ শীল, এমএন আখতার, আবদুল গফুর হালীরা মূলত সাধক-শিল্পী। এসব লোকশিল্পী কখনও গুরুমুখী ছিলেন না, তারা সবসময় গণমুখী। সুতরাং তাদের গানে বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধ অর্থাৎ পূর্বসূরীর গানের রেশ থাকবে না তো কী থাকবে?

আবদুল গফুর হালীর জন্ম সাধক-শিল্পী আস্কর আলী পণ্ডিতের এলাকাতেই। গফুর হালী বড় হয়েছেন আস্কর আলীর গান শুনে— তার গান গেয়ে। গফুর হালী নিজেকে আস্কর আলীর ভাবশিষ্য পরিচয় দিতে গর্ববোধ করেন। সুতরাং আবদুল গফুর হালীর গানে আস্কর আলীর প্রভাব আছে, হালী আস্কর আলী, রমেশ শীলদের অনুকরণ-অনুসরণ করেই শিল্পী হিসাবে নিজের সন্ধান পেয়েছেন, সংগীতে স্বাধীন হয়েছেন। পরে আস্কর আলী, খায়েরজ্জামা বা রমেশ শীলদের কিছু গান ভেঙ্গে অপূর্ব সব গান তৈরি করেছেন।

‘আস্কর আলী পণ্ডিত : একটি বিলুপ্ত অধ্যায়’ গ্রন্থের ৫১ পৃষ্ঠায় লেখক শামসুল আরেফীন লিখেছেন, ‘আবদুল গফুর হালী সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে, আস্কর আলী পণ্ডিতের (রচিত ও সুরারোপিত) কোনো কোনো গান তিনি ক্যাসেট ইত্যাদিতে ‘নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছেন’। এ অভিযোগ আদৌ সত্য কিনা— তর্কসাপেক্ষ। তবে এটুকু বলতে পারি যে, আবদুল গফুর হালীর কোনো কোনো গানে আস্কর আলী পণ্ডিতের গানের কথা বা অংশবিশেষের প্রয়োগ ঘটেছে।’

উদাহরণ হিসাবে তিনি আস্কর আলী পণ্ডিতের নিচের গানটির সাথে গফুর হালীর একটি গানের সাদৃশ্য দেখিয়েছেন—
‘বাতাশের রিত ন বুজি
শুজন মাঝি ভাশাই দিছে
সৌদের তরি।’
(সূত্র : আস্কর আলী পণ্ডিত : একটি বিলুপ্ত অধ্যায়, পৃষ্ঠা-৫০)।

আবদুল গফুর হালীর গানটির পাঠ এরকম—
বাতাসের রীত না বুঝি
সুজন মাঝি কোন ভরসায়
ছাড়লে তরী।।
(জ্ঞানজোতি-আবদুল গফুর হালী, গান নম্বর-৭২)

আবদুল গফুর হালীর গানে তার কল্পনার গুরু আস্কর আলী পণ্ডিতের কোনো কোনো গানের কথা ও সুরের মিল রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো সেটা ‘নিজের নামে চালিয়ে দেওয়া’র পর্যায়ে পড়ে কি না? কারণ কবিয়াল রমেশ শীলের অনেক গানেও আস্কর আলী পণ্ডিতের গানের কথার সাথে মিল রয়েছে। এখন এই গানের জন্য বা এমন ধরনের আরও কিছু গানে আস্কর আলী পণ্ডিতের গানের প্রভাব থাকায় যদি আবদুল গফুর হালীকে চৌর্যবৃত্তির দায়ে অভিযুক্ত করা হয়, তাহলে এই লেখার শুরুতে লিজেন্ড অচিন্ত্যকুমার চক্রবর্তী বা মোহন লাল দাশের গানের সাথে মলয় ঘোষ দস্তিাদারের গানের যে হুবহু মিল আমরা দেখেছি (ও ভাই আঁরা চাটগাঁইয়া নওজোয়ান বা ছোড ছোড ঢেউ তুলি) তাকে কী বলা হবে? নকল, চুরি না অনুসরণ-অনুকরণ?

বলে রাখা ভালো, রমেশ শীলের গান ‘ভাণ্ডারীর বর্জকের তরী ধীরে ধীরে বাইও’সহ দুয়েকটি গান জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হান্স হারডারের গবেষণাগ্রন্থ ‘ডার ফেরুখটে গফুর স্ফ্রিখট’ (পাগলা গফুর বলে)-এ আবদুল গফুর হালীর নামে গ্রন্থিত হয়েছে। দুটি ভুলই অনিচ্ছাকৃত মুদ্রণ প্রমাদ। ড. হান্স হারডার ব্যক্তিগত আলাপে আমাকে বলেছেন, মাইজভাণ্ডারী গান নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে রমেশ শীলসহ অনেককে নিয়ে কাজ করেছেন তিনি। ভাষাগত সীমাবদ্ধতা বা অসাবধানতার কারণে তার রচনায় রমেশ শীল আর হালীর গান মিশে গেছে। পরবর্তী সংস্করণে সেসব সংশোধন করা হবে।

শেষ কথা

মুম্বাইতে এক ঘরোয়া আড্ডায় শচীন দেববর্মণের কাছের মানুষদের একজন বলে উঠেছিলেন— ‘‘সলিল চৌধুরী কিন্তু দারুণ কায়দা করে দুটো বিখ্যাত বিদেশি গানকে বাংলায় কাজে লাগিয়েছেন। একটা ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ/হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ সুর নিয়ে ‘ক্লান্তি নামে গো/ক্লান্তি নামে গো’। বিখ্যাত গায়ক প্যাট বুনের টেকনিক গানের সুর নিয়ে ‘দূরন্ত ঘূর্ণি তাই লেগেছে পাক/এই দুনিয়া ঘুরে বন বন’ ধরাছোঁয়ার উপায় নেই।”

স্বল্পভাষী শচীন দেববর্মণ ওই আলোচনাটা থামিয়ে দিয়েছিলেন এই বলে— ‘ওই যে বললে কায়দা করে লাগানো, ওই কায়দাটাই হচ্ছে আসল জিনিস। রবিঠাকুর করেছেন, ডিএল রায়, কাজী সাহেব সবাই করেছেন। আমিও করেছি। গুরু দত্তের ‘পিয়াসা’ ছবিতে যে গানটা হেমন্তকে দিয়ে গাইয়েছিলাম ‘যানে হো ক্যায়সে/লোগসে জিনকে/প্যায়ার তো প্যায়ার মিলা/হামনে তো যব কালিয়া মাঙ্গি/কাঁটাকো হার মিলা’। এই সেকেন্ড লাইনটা যে আমাদের ন্যাশনাল সঙের ‘পাঞ্জাব সিন্ধু গুজরাট মারাঠা দ্রাবিড় উৎকল বঙ্গ’ আমি বলার আগে কেউ বুঝতে পেরেছিল কি? ওসব কথা ছাড়ান দাও।’ (সূত্র : কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, পুলক বন্দোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৯২)।

বাংলা গানে এমন কায়দা করে অন্যের গানের কথা বা সুর কাজে লাগানোর উদাহারণ ভুরি ভুরি আছে। শচীনকর্তা তো বলেছেনই, ‘রবি ঠাকুর করেছেন, কাজী সাহেব করেছেন।’ কিন্তু প্রশ্ন হল— এই ‘কায়দা করে কাজে লাগানো’কে চৌর্যবৃত্তি বলা যায় কি না।

আসলে চাটগাঁইয়া গানে এক শিল্পীর গানে অন্য শিল্পীর কথা ও সুরের প্রভাব অহরহ লক্ষ করা যায়। কিন্তু আঞ্চলিক বা মাইজভাণ্ডারী গানের অপরূপ বৈশিষ্ট্য হলো এই— প্রায় একই সুরে বা কাছাকাছি কথায় একাধিক গান তৈরি হলেও সেসব গান মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। কোনো কোনো গান চিরসবুজ গানের তালিকায় স্থান পেয়েছে। এটাও চাটগাঁইয়া গানের অনন্য রূপ। দুই-একটি ব্যতিক্রম থাকলেও এটাকে কোনোভাবেই চৌর্যবৃত্তির পর্যায়ে ফেলা যায় না। আর এটিই হলো শিল্পের সৌন্দর্য।

নাসির উদ্দিন হায়দার: সাংবাদিক ও চট্টগ্রামের লোকসংগীত গবেষক

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!