চবি নাট্যকলা বিভাগের প্রভাষক নিয়োগ বোর্ড শেষ নানান নাটকীয়তায়
স্ত্রীকে সাক্ষাৎকারে না ডাকায় স্বামী কুন্তলের ‘অভিমান’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) নাট্যকলা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে নাটকীয়তা। একদফা পিছিয়ে এই বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে রোববার (২১ জানুয়ারি)।
বোর্ডের দিন সকালে চার সদস্যের একজন অধ্যাপক কুন্তল বড়ুয়া পদত্যাগ করেন। আরেক সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ পলাশ অনুপস্থিত ছিলেন।
বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী এ বিভাগে তিন জন শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও বোর্ড সদস্য নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক কুন্তল বড়ুয়ার পদত্যাগ এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ পলাশের অনুপস্থিতি নিয়ে চলছে ধোঁয়াশা।
পদত্যাগ করার নেপথ্যে কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নাট্যকলা বিভাগে নাট্যকলা বিষয়ক তিনজন প্রভাষক নিয়োগের জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। কিন্তু বিভাগের শিক্ষক ও বোর্ড সদস্য অধ্যাপক কুন্তল বড়ুয়ার স্ত্রী সোমা বড়ুয়া ওরফে প্রমা অবন্তি নৃত্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী হয়েও নাট্যকলা বিভাগে প্রভাষক পদে আবেদন করেন। বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির সদস্যরা চাপের মুখে বিশেষ বিবেচনায় সোমা বড়ুয়াকে সাক্ষাৎকারে ডাকতে কমিটি সুপারিশ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী নৃত্যকলা বিষয়টি বিজ্ঞাপনে অন্তর্ভুক্ত না থাকায় শিক্ষক সেল থেকে কুন্তল বড়ুয়ার স্ত্রী সোমা বড়ুয়াকে সাক্ষাৎকারে ডাকা হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের উপরও নানাভাবে একটি পক্ষ সোমা বড়ুয়াকে সাক্ষাৎকারে ডাকার চিঠি দিতে চাপ দিচ্ছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি নীতিমালা বহির্ভূত সুপারিশ করলেও সেটি বাস্তবায়ন না করতে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত ১১ জানুয়ারি এই বোর্ড সভা আহ্বান করেছিলেন উপাচার্য। কিন্তু দুই আগেই এই বোর্ডে না আসার ঘোষণা দেন বোর্ড সদস্য কুন্তল বড়ুয়া ও আনোয়ার সাঈদ পলাশ।
পরে উপাচার্য আবারও রোববার (২১ জানুয়ারি) এ বোর্ড সভা আহ্বান করেন। এই বোর্ডে অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ ও কুন্তল বড়ুয়া উপস্থিত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। কিন্তু বোর্ড সভার দিন সকালে কুন্তল বড়ুয়া পদত্যাগপত্র জমা দেন উপাচার্য দপ্তর, নাট্যকলা বিভাগ ও রেজিস্ট্রার দপ্তরে।
এরপর রোববার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার কেএম নুর আহমদ ও শিক্ষক সেলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হাসান মিয়াসহ বৈঠক করেন।
এ সময় রেজিস্ট্রার ও শিক্ষক সেলের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হাসান মিয়া ৫০ শতাংশ বোর্ড সদস্য উপস্থিত থাকলে বোর্ড সাক্ষাৎ গ্রহণ করতে পারে বলে নিয়মটি উপাচার্যকে জানান।
যেহেতু চার জনের একজন উপস্থিত হননি, সেহেতু বাকি তিন জনের মধ্যে বিভাগীয় চেয়ারম্যান ও উপাচার্যসহ দুই জন উপস্থিত ছিলেন বিধায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এই শিক্ষক নিয়োগ বোর্ড শুরু হয়। চলে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্ট কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ, কোনো কারণ ছাড়া অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ পলাশ নাট্যকলা বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ বোর্ডে উপস্থিত হননি। তিনি কোনো ছুটির আবেদনও করেননি। আগের রাতে তাকে চট্টগ্রাম নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় দেখা গেছে। এছাড়া বোর্ডের দিন সকালে কুন্তল বড়ুয়া পদত্যাগ করে এই বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া ব্যাহত করেছেন। তাদের এমন ধরনের আচরণ নানা সন্দেহের উদ্রেক ঘটিয়েছে। কুন্তল বড়ুয়া নিজের স্ত্রীকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের উপর নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। অনেককে এই বোর্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে নানা মেসেজ দিয়ে চাপ প্রয়োগ করেছেন।
শিক্ষকদের অভিযোগ, স্ত্রীকে নিয়োগ দিতে প্রকাশ্যে এভাবে অবস্থান নেওয়ার নজির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই।
জানা গেছে, কুন্তল বড়ুয়া পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার পর শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন। ওই অভিযোগের উল্লেখ করা হয়, বিশেষজ্ঞ সদস্যকে বাদ দিয়ে বোর্ডের গ্রহণযোগ্য নেই।
একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জানান, তিনি নিজে পদত্যাগ করে একটি সিন্ডিকেট স্বীকৃত বোর্ডকে অকার্যকর করতে পারেন না। এছাড়া অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ পলাশ সিন্ডিকেট কর্তৃক দেওয়া দায়িত্ব পালনে অবহেলা করায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ওনার দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) কেএম নুর আহমদ বলেন, ‘৫০ শতাংশ বোর্ড সদস্য উপস্থিত থাকলেই নিয়োগ বোর্ডের কোরাম পূর্ণ হয়ে যাবে। বোর্ড তাদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। নাট্যকলা বিভাগের ক্ষেত্রে এ নিয়ম মানা হয়েছে।’
এ বিষয়ে জানতে রোববার বিকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার বলেন, ‘বিভাগের পরিকল্পনা কমিটির দুই দফা সুপারিশ করেছে নাট্যকলা বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ দিতে। সে অনুযায়ী সার্কুলার হয়েছে, নিয়ম অনুযায়ী বোর্ডও বসেছে। কোরাম পূর্ণ করতে না দিতে কেউ পদত্যাগ করেছেন বলে শুনেছি। কিন্তু তবুও কোরাম পূর্ণ হয়েছে। আমরা রেজিস্ট্রার ও শিক্ষক সেলের কাছ থেকে নিয়মের বিষয়টি স্পষ্ট করে জেনে নিয়ে বোর্ডের কাজ সম্পন্ন করেছি। নিয়মের ব্যত্যয় হয়নি।’
এ বিষয়ে নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ও প্রভাষক নিয়োগ বোর্ডের সদস্য কুন্তল বড়ুয়া বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করিনি, এই বোর্ড থেকে নিজেকে বিরত থেকেছি। আমার স্ত্রীকে নিয়ে যে কথা হচ্ছে, তা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
নিয়োগ বোর্ডের অপর সদস্য বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ পলাশকে কল দেওয়া হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন আহমেদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিটির সুপারিশ না থাকায় এবং আবেদনপত্র সঠিক প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই না করায় আমরা আইন বিভাগের শিক্ষক নিয়োগ বাতিল চেয়ে আন্দোলন করছি। নাট্যকলা বিভাগে এ ধরনের কোনো জটিলতা না থাকলে এবং প্রথা অনুযায়ী বোর্ডের কোরাম পূর্ণ হলে নিয়োগ বোর্ড পরিচালনা করতে কোনো সমস্যা নেই। নিয়ম মেনে যদি নিয়োগ হয় সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললে তা হবে অযৌক্তিক।’
হেলাল উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘একজন বোর্ড সদস্য নাট্যকলায় বিশেষজ্ঞ শিক্ষক ছাড়া কীভাবে নিয়োগ হবে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শিক্ষক সমিতিকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু, মনোবিজ্ঞান বিভাগে ফরেস্ট্রি এবং পদার্থ বিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞ দিয়ে নিয়োগ বোর্ড যখন বসে তখন কিন্তু এই সিনিয়র শিক্ষক কোনো প্রশ্ন তুলেনি। এখন নিজস্বার্থ সামনে আসায় তিনি হয়তো চিঠি দিয়ে বেড়াচ্ছেন।’
এ ব্যাপারে বিভাগের সভাপতি শাকিলা তাসনিম বলেন, আমাদের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কোনো প্রশাসনিক জটিলতা নেই। তিনজন শিক্ষক শিক্ষাছুটিতে যাওয়ায় বিভাগ শিক্ষক সংকটে পড়ে। প্ল্যানিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাট্যকলা বিভাগের শূন্য পদের জন্য বিজ্ঞপ্তি হয়। এতে নাট্যকলায় অনার্স মাস্টার্সের বাইরে নৃত্যকলা ও চারুকলার ২ জন প্রার্থী এতে আবেদন করেন। বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটির মধ্যে অন্য বিষয়ে পাশ করা প্রার্থীদের নিয়ে মতদ্বৈততা তৈরি হয়। তারপরও উনাদের জন্য বোর্ড সুপারিশ করে। কিন্তু রেজিস্ট্রার অফিস থেকে নৃত্যকলা ও ভাস্কর্য থেকে পাশ করা প্রার্থীদের নাট্যকলা বিষয়ের নির্বাচনী বোর্ডের অংশগ্রহনের চিঠি দেওয়া হবে না জানানো হয়।’
শাকিলা তাসনিম আরও বলেন, তারপরও বিভাগীয় পরিকল্পনা কমিটি আবার সুপারিশ করে চিঠি পাঠায়। সম্ভবত সসংশ্লিষ্ট বিষয় না হওয়ায় রেজিস্ট্রার অফিস ওই দু’জন প্রার্থীর ইন্টারভিউ কার্ড ইস্যু করেনি। এরপর একদফা পিছিয়ে যাবার পর ২১ জানুয়ারি বোর্ড অনুষ্ঠিত হয়। এর বোর্ড সদস্য ছিলাম উপাচার্য শিরীণ আখতার, অধ্যাপক কুন্তল বড়ুয়া, অধ্যাপক আনোয়ার সাঈদ এবং আমি শাকিলা তাসনিম। এরমধ্যে আমি এবং উপাচার্য মহোদয় বোর্ডে উপস্থিত ছিলাম। কুন্তল বড়ুয়া স্যার দুই বার প্ল্যানিং কমিটির সভায় উপস্থিত থেকে নিয়োগের সার্কুলার দিতে রাজি থাকলেও, ২১ জানুয়ারি সকালে আসেননি। নির্বাচনী বোর্ডে অনুপস্থিত থাকবেন বলে লিখিতভাবে জানান। আনোয়ার সাঈদ স্যার কেন অনুপস্থিত ছিলেন তা আমার জানা নেই। কোরাম পূর্ণ হওয়ায় যথারীতি বোর্ড হয়।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নৃত্যকলা বিভাগ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করে প্রভাষক পদে আবেদন করে রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে ভাইবা কার্ড না পাওয়া প্রার্থী সোমা বড়ুয়া একজন বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী। দীর্ঘদিন ধরে নাট্যকলা বিভাগে দুটি কোর্স অতিথি শিক্ষক হিসেবে পড়াচ্ছেন। তার অন্য একটি পরিচয় তিনি বিভাগের অধ্যাপক কুন্তল বড়ুয়ার স্ত্রী।’