চবিতে বিপ্লবের দেয়াল মুছে দিচ্ছে প্রশাসন, ছুটিতে চুপিসারে চুনকাম

১৮ পয়েন্টে সাবাড় ২০ দেয়ালের সব গ্রাফিতি-দেয়ালচিত্র

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত ১৮টি পয়েন্টে ২০টিরও বেশি দেয়ালে জুলাই বিপ্লবের স্মৃতিবহ গ্রাফিতি ও দেয়াললিখন চুন দিয়ে মুছে দেওয়া হয়েছে। শীত ও বড়দিনের আটদিনব্যাপি ছুটির ভেতরে পরিকল্পিতভাবে এই কাজটি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এমন দৃশ্য দেখে গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ছুটি শেষে ক্যাম্পাসে ফিরে হতভম্ব হয়ে যান।

সবচেয়ে বেশি হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে চবি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের প্রবেশদ্বারেই সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিশালকায় স্কেচ দেয়ালচিত্র। এই কাণ্ডকে সরকারের কৃপালাভ বা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চবি প্রশাসনের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
সবচেয়ে বেশি হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে চবি সমাজবিজ্ঞান অনুষদের প্রবেশদ্বারেই সরকারপ্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের বিশালকায় স্কেচ দেয়ালচিত্র। এই কাণ্ডকে সরকারের কৃপালাভ বা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চবি প্রশাসনের চেষ্টা হিসেবে দেখছেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

রোববার (২৯ ডিসেম্বর) ছুটি শেষে প্রথম দিন ক্যাম্পাসে ঢুকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাদা রঙে ঢেকে দেওয়া দেয়াল ও মুছে দেওয়া গ্রাফিতি দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তাদের অনেকে ক্ষোভও প্রকাশ করেন। কোনো কোনো শিক্ষার্থী বিষয়টি তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রামে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফিকে জানালেও তিনিসহ বৈষম্যবিরোধী অন্য নেতারা নিশ্চুপ থাকেন।

খোদ প্রক্টর অফিসের সম্মুখেও ছিল গণঅভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্র। সেগুলোও চুন মেরে সব সাফ করে ফেলা হয়েছে।
খোদ প্রক্টর অফিসের সম্মুখেও ছিল গণঅভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্র। সেগুলোও চুন মেরে সব সাফ করে ফেলা হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের দাবি, অন্তবর্তীকালীন সরকার যেখানে জুলাই বিপ্লবের ভাষাকে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উপস্থাপন করেছে, সেখানে খোদ চবি প্রশাসন চুনকাম করে সেগুলো মুছে দিচ্ছে।

জয়বাংলা চত্বরে জুলাই বিপ্লবের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
জয়বাংলা চত্বরে জুলাই বিপ্লবের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

তারা বলছেন, জুলাই-আগস্টে চবির দেয়ালে দেয়ালে শিক্ষার্থীদের গণতান্ত্রিক আকুতিগুলো মুছে দিচ্ছে চবি প্রশাসন। এই আঁকা-লেখা হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্তভাবে। এই ইমোশন কি আমরা ফিরে পাবো আর? এগুলো তো অমূল্য ছিল।

চবি জাদুঘর চত্বরে সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

জানা গেছে, ১১ সদস্যের ‘অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যায়ন বাস্তবায়ন’ কমিটি আটদিনব্যাপি ছুটির ভেতরে ক্যাম্পাসজুড়ে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। চবির উপ-উপাচার্যকে আহ্বায়ক করে গঠিত ওই কমিটি গণঅভ্যুত্থানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রাণের দাবি ও আবেগ থেকে লেখা সব দেয়ালচিত্র ও গ্রাফিতি মুছে দেয়।

কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের তিনটি দেয়ালে জুলাই বিপ্লবের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের তিনটি দেয়ালে জুলাই বিপ্লবের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

জুলাই বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে চবির যেসব পয়েন্ট থেকে, তার মধ্যে রয়েছে— কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের তিন দেয়াল, উপাচার্য কার্যালয়ের দুটি দেয়াল, প্রক্টর অফিসের সম্মুখের দেয়াল, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি চত্বর, চবি জাদুঘর চত্বর, সেন্ট্রাল লাইব্রেরি, বুদ্ধিজীবী চত্বর, জয়বাংলা চত্বর, ব্যাংক চত্বর, কলা অনুষদের পশ্চিম দেয়াল ও প্রবেশসেতু, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ, কম্পিউটার সায়েন্স ফ্যাকাল্টির দেয়ালচিত্র, কাঁচাবাজার সংলগ্ন দেয়াল।

বুদ্ধিজীবী চত্বরেও সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
বুদ্ধিজীবী চত্বরেও সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

এছাড়া চাকসু নিয়ে ছাত্র আন্দোলনের দেয়ালচিত্র, ছাত্র ইউনিয়নের লেখা বৈষম্যবিরোধী দেয়ালচিত্র, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার বিষয়ক দেয়ালচিত্র আর এমনকি বাংলা ভাষা নিয়ে কবি ফররুখ আহমেদের কবিতার পংক্তিও বাদ যায়নি প্রশাসনের চুনকাম থেকে।

উপাচার্য কার্যালয়ের দুটি দেয়ালের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
উপাচার্য কার্যালয়ের দুটি দেয়ালের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

সাধারণ শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, জামায়াতপন্থী দুই শিক্ষক ও প্রক্টরের অতি উৎসাহে এই কাণ্ডটি ঘটেছে।

দেয়ালের ওপর ‘দেয়াল লিখন নিষেধ’ লিখেই চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ!
দেয়ালের ওপর ‘দেয়াল লিখন নিষেধ’ লিখেই চলছে সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ!

চবি প্রশাসন দেয়াললিখনের নিষেধ করছে দেয়ালের ওপর ‘দেয়াল লিখন নিষেধ’ লিখেই। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে এটিও হয়েছে হাসির খোরাক।

বাংলা ভাষা নিয়ে কবি ফররুখ আহমেদের কবিতার পংক্তিও চুনকাম থেকে বাদ যায়নি।
বাংলা ভাষা নিয়ে কবি ফররুখ আহমেদের কবিতার পংক্তিও চুনকাম থেকে বাদ যায়নি।

জানা গেছে, চবি প্রশাসন একদিকে চুনকাম করলেও দুটি আবাসিক ছাত্র হলের সামনে সেই চুনকামের ওপর ছাত্রশিবির তাদের মতো করে দেয়ালচিত্র এঁকেছে নতুন করে।

কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের তিনটি দেয়ালে জুলাই বিপ্লবের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ ভবনের তিনটি দেয়ালে জুলাই বিপ্লবের সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের বিপ্লব যাদের পছন্দ হয়নি, তারা একে মুছে দিয়ে আড়াল করতে চায়। জুলাই বিপ্লবকে তারা নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চায়। আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে এর বিরুদ্ধে।’

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারও মুছে দেয়া হয়েছে চুনের প্রলেপে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারও মুছে দেয়া হয়েছে চুনের প্রলেপে।

অন্য এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনের গ্রাফিতিগুলো সংরক্ষণ করতে হবে, যেন আগামীতে আর কোনো শাসক স্বৈরশাসক হওয়ার সাহস না পায়।’

সেন্ট্রাল লাইব্রেরি চত্বরেও সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
সেন্ট্রাল লাইব্রেরি চত্বরেও সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

ওই শিক্ষার্থী প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন, ‘জুলাইয়ে কাঁচা হাতে দেয়ালে প্রাণের আকুতি লিখে যে শিক্ষার্থী বন্দুকের নলের মুখে প্রাণ দিয়েছে, চবি প্রশাসন তার সেই আকুতি মুছে দিয়ে তার কণ্ঠটাকেই কি গলা টিপে মারলো?’

কম্পিউটার সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ছাত্র ইউনিয়নের দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
কম্পিউটার সায়েন্স ফ্যাকাল্টিতে ছাত্র ইউনিয়নের দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

চবিতে একযোগে জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা নিয়ে চবির প্রক্টর ড. তানভীর মোহাম্মদ হায়দার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সৌন্দর্য্যবর্ধন কমিটির সিদ্ধান্তে কিছু কিছু জায়গায় দেয়াল নতুন করে রঙ করা হয়েছে। তাও আমার জানামতে শুধু কলাভবন ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনের দেয়ালে। অনেক দেয়াল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, রঙ ওঠে গিয়েছিল। তাছাড়া কিছু দেয়ালে রাজনৈতিক শ্লোগান ছিল, সেগুলোও মোছা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরং গ্রাফিতি সংরক্ষণে সহযোগিতা করছে।’

খোদ প্রক্টর অফিসের সম্মুখেও ছিল গণঅভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্র। সেগুলোও চুন মেরে সব সাফ করে ফেলা হয়েছে।
খোদ প্রক্টর অফিসের সম্মুখেও ছিল গণঅভ্যুত্থানের দেয়ালচিত্র। সেগুলোও চুন মেরে সব সাফ করে ফেলা হয়েছে।

এর আগে শনিবার (২৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষককেন্দ্র (টিএসসি)-সংলগ্ন মেট্রোরেলের পিলারে থাকা শেখ হাসিনার গ্রাফিতি (‘ঘৃণাস্তম্ভ’) মুছে ফেলা হয়। ঘটনাটি জানাজানি হলে শিক্ষার্থীরা তাৎক্ষণিকভাবে টিএসসিসংলগ্ন রাজু ভাস্কর্যের পাশের ‘ঘৃণাস্তম্ভের’ সামনে জড়ো হন।

সেন্ট্রাল লাইব্রেরি চত্বরেও সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।
সেন্ট্রাল লাইব্রেরি চত্বরেও সব গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্র মুছে ফেলা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের অনুমতি নিয়ে এই কাজ করা হয়েছে জেনে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। তারা প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেন। পরে প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সব ধরনের গ্রাফিতি সংরক্ষণ করবে। কেউ মুছে ফেললে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm