চবিতে ‘তদন্ত কমিটি’র নামে প্রহসন বছরের পর বছর, প্রতিবেদন দেখে না আলোর মুখ
৮ ঘটনার রিপোর্ট মিললেও একটি ছাড়া সবই ধামাচাপা
২০১৮ সালের ১৫ মে রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তিনটি সেমিস্টারের প্রায় ৭০৯টি উত্তরপত্র পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনা তদন্তে পর দিনে ১৬ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্যের নির্বাহী আদেশে জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমানকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন সহকারী প্রক্টর হেলাল উদ্দিন ও লিটন মিত্র। এই কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। কিন্তু ওই পাঁচ কর্মদিবস পেরিয়ে এরপর আরও তিন বছর পেরোলেও সেই তদন্ত প্রতিবেদন জমা হয়নি এখনও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক ড. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা তদন্তের কাজ অনেকটা গুছিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে তা আর শেষ করা যায়নি।’
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের ১৯ মে থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মকর্তাকে মারধর, ছাত্র সংগঠনের গ্রুপিং সংঘর্ষ, ভর্তি পরীক্ষায় ত্রুটি, চুরিসহ বিভিন্ন ঘটনায় অন্তত ১৯টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৯টি কমিটিই প্রতিবেদন জমা দেয়নি। আবার বাকি কমিটিগুলো প্রতিবেদন দিলেও সেগুলো দেখেনি আলোর মুখ।
চার বছরের ঠিকুজি
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২১ সালে দুটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার একটিরও প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।
২০২০ সালে ৬টি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে তিনটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও বাকি তিনটির জমা দেওয়া হয়নি।
২০১৯ সালে ৮টি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে ছয়টির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও আলোচিত দুই ঘটনার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।
২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত অন্তত তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যার একটির প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।
তবে আটটি ঘটনার প্রতিবেদন জমা দেওয়া হলেও একটির বাদে বাকিগুলোর প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, কয়েকটি ঘটনায় প্রতিবেদন দিলেও এতে কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি কমিটি। শুধুমাত্র কিছু সুপারিশ করেই দায় সেরেছে কমিটি। যদিও সুপারিশগুলো বাস্তবায়নও করা হয় না।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, তদন্ত করতে গিয়ে তারা নানা সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হন। অনেক সময় অভিযোগকারী মুখ খুলতে ভয় পান। আবার কেউ সাক্ষ্য দিতেও এগিয়ে আসে না। তাই কাউকে শনাক্ত বা দোষী সাব্যস্ত করা সম্ভব হয় না। ফলে যতটুকু সম্ভব এর মধ্যেই প্রতিবেদন তৈরি করে কিছু সুপারিশ করে জমা দেন তারা।
তারা আরও জানান, তদন্ত কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে প্রশাসন তো তাগিদ দেয়ই না, উল্টো অনেক সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকেই তদন্ত কমিটিকে সময়ক্ষেপণ করতে বলা হয়।
অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা মনে করেন, প্রশাসনের অনীহার কারণেই মূলত প্রতিবেদন জমা দিতে আগ্রহ পান না কমিটির সদস্যরা। আবার অনেক সময় প্রতিবেদন জমা হলেও ব্যবস্থা নিতে হবে বলে তা আলোর মুখ দেখানো হয় না। ফলে প্রকৃত দোষীরা শনাক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হন না। তারা দ্বিগুণ উৎসাহে আবারও অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন।
চলতি বছর ২৩ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. রাহমান নাসির উদ্দিন ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইদুল ইসলামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কুৎসা রটানোর অভিযোগে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। এ ঘটনা তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে ও আইন বিভাগের অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল ফারুককে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়। তবে কমিটি গঠনের কয়েক মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি কমিটি। তবে অধ্যাপক বেনু কুমার গত ৬ মে উপ-উপাচার্য পদে নিয়োগ পেলে তিনি কমিটি থেকে সরে যান। তার জায়গায় অন্য আরেক শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন এখনও দিইনি। তদন্তের কাজ চলমান আছে।’
চলতি বছরের ১২ জানুয়ারি দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের চতুর্থ তলায় হিসাব নিয়ামক দপ্তরে হিসাব নিয়ামক (ভারপ্রাপ্ত) মো. ফরিদুল আলম চৌধুরীকে তার অফিস কক্ষে মারধর করে দুর্বৃত্তরা। ন্যাক্কারজনক এই আলোচিত ঘটনাটি তদন্তে একই দিন মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আবুল মনসুরকে প্রধান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়াকে সদস্য সচিব করে চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিকে চার দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও সাড়ে ৬ মাসেও তারা প্রতিবেদন জমা দেননি।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির প্রধান মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক আবুল মনসুর বলেন, ‘প্রতিবেদন অনেকটা তৈরি হয়ে গেছে। আমরা দিয়ে দিতে পারবো।’
২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাতে শাহজালাল ও শাহ আমানত হলের পশ্চিম পাশের পাহাড়ে লক্ষাধিক টাকা দামের বৈদ্যুতিক তার চুরি করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনা তদন্তে আমানত হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক কাঞ্চন চাকমাকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তবে কাঞ্চন চাকমা তদন্ত প্রতিবেদন আমানত হলের প্রভোস্টের কাছে জমা দিয়েছেন বলে জানালেও প্রভোস্ট এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেননি।
২০২০ সালের ২১ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের জানালার গ্রিল কেটে গ্রন্থাগারে ব্যবহৃত ১৪টি মনিটর চুরি হয়ে যায়। এছাড়া ৬টি সিপিইউ পাওয়া যায় বাইরে। এই ঘটনা তদন্তে ২৩ এপ্রিল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হককে আহ্বায়ক ও আইসিটি সেলের সিনিয়র অ্যাসিসটেন্ট সিস্টেম এডমিনিস্ট্রেটর মো. মজনু মিয়াকে সদস্য সচিব করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ১১ মাস পর চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও তাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা এড়াতে কিছু গঁৎবাধা সুপারিশ করা ছাড়া আর কিছুই উল্লেখ করেননি কমিটির সদস্যরা। দীর্ঘ তদন্তে তারা কাউকে শনাক্ত বা কোনো ক্লুই খুঁজে পাননি বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছেন।
২০২০ সালের ২ মার্চ আলাওল হলের একটি রুমে অবস্থান করাকে কেন্দ্র করে শাখা ছাত্রলীগের কনকর্ড ও বিজয় গ্রুপের দুই কর্মীর মধ্যে ঝামেলা হয়। এ ঘটনার জেরে পরদিন দুই গ্রুপের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ঘটনার রেশে সংঘর্ষ গড়ায় তৃতীয় দিনেও। রাত দেড়টার দিকে স্যার এএফ রহমান হলে ৮০টিরও বেশি কক্ষ ভাঙচুর করা হয়। এতে মোট আট লাখ টাকার মতো ক্ষয়ক্ষতি হয়।
এই ঘটনা তদন্তে ১১ মার্চ হলের প্রভোস্ট ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক মো. ফারুক হোসেনকে আহবায়ক ও প্রভাষক কাজী রবিউল ইসলামকে সদস্য সচিব করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন। তবে এই ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে হলের প্রভোস্ট ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী বলেন, ‘প্রতিবেদন তৈরি করা আছে। করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে জমা দিয়ে দেব।’
২০২০ সালের ২৭ জানুয়ারি ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন সিক্সটি নাইন ও আরএস গ্রুপের মধ্যকার মারামারির ঘটনা আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে সহকারী প্রক্টর মুহাম্মদ ইয়াকুব ও রিফাত রহমানকে সদস্য করা হয়েছে। এই ঘটনার দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও পর্যন্ত তদন্ত শেষ করতে পারেনি কমিটি।
কমিটির সদস্য সহকারী প্রক্টর মুহাম্মদ ইয়াকুব জানান, ‘কাজ শুরু করলেও করোনার কারণে আগাচ্ছে না।’
২০২০ সালের ২২ জানুয়ারি ছাত্রলীগের বগিভিত্তিক সংগঠন বিজয় ও সিএফসি গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে সহকারী প্রক্টর আহসানুল কবীর পলাশ ও এএইচএম জিয়াউল ইসলামকে সদস্য করা হয়। এই কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলেও কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য এএইচএম জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘যখন ঘটনাটি ঘটে তখন সিসিটিভি কম ছিল এবং সিসিটিভির স্টোরেজও কম ছিল। তাই আমরা কাউকে শনাক্ত করতে পারিনি। তবে আমরা সিসিটিভি বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করেছি।’
২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রীতিলতা হলের একটি কক্ষে এক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এতে সহকারী প্রক্টর মুহাম্মাদ ইয়াকুবকে প্রধান, সহকারী প্রক্টর মরিয়ম ইসলাম লিজা ও প্রীতিলতা হলের সিনিয়র আবাসিক শিক্ষক ড. শ্রীকান্ত চৌধুরীকে সদস্য করা হয়। এ ঘটনারও দেড় বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তদন্ত শেষ করতে পারেনি কমিটি। কমিটির প্রধান সহকারী প্রক্টর ইয়াকুব জানান, ‘আমরা কয়েকবার মিটিং করেছি। কিন্তু করোনার কারনে তদন্ত শেষ করতে পারিনি। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসলে প্রতিবেদন দিয়ে দেবো।’
২০১৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের উচ্চমান সহকারী আরমান হেলালীর বিরুদ্ধে এক ছাত্রীর বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার প্রলোভনে অনৈতিক প্রস্তাব ও যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। বিষয়টা জানাজানি হলে ওই ছাত্রীর পরিবারকে আরমান হেলালী প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছেন বলে প্রমাণসহ অভিযোগ করেন ছাত্রীর বোন। এ ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যদিও ওই কমিটির প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৯ সালের ৩০ নভেম্বর শহীদ আবদুর রব হলে তুচ্ছ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মারামারি, ০১ ডিসেম্বর হাটহাজারীর এগারমাইল এলাকায় দুই শিক্ষার্থীর ওপর দুর্বৃত্তের হামলা ও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চারটি, প্রক্টরের একটি গাড়ি এবং জিরো পয়েন্টে ওয়াচ টাওয়ার ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এই ঘটনায় পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. শ্যামল রঞ্জন চক্রবর্তীকে আহ্বায়ক, সহকারী প্রক্টর মো. আহসানুল কবীরকে সদস্য এবং তথ্য শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ হোসেনকে সচিব করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন।
২০১৯ সালের ২৭ থেকে ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রে অসঙ্গতি, প্রশ্নের সংখ্যা কম ছাপানো, মানোন্নয়ন দেওয়া শিক্ষার্থীদের ভর্তি জটিলতাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠে। ভর্তি পরীক্ষায় সার্বিক অনিয়ম, ত্রুটি খুঁজে বের করতে পরের মাসে তৎকালীন শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. অঞ্জন কুমার চৌধুরীকে আহ্বায়ক ও উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই কমিটি প্রতিবেদন জমা দিলেও সেই প্রতিবেদনে কী ছিল তা জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক ড. অঞ্জন কুমার চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। আপনি রেজিস্ট্রারের সাথে কথা বলতে পারেন।’ তবে রেজিস্ট্রার প্রতিবেদনে কী ছিল তা মনে নেই বলে জানিয়েছেন।
২০১৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে কুরুচিপূর্ণ পোস্টার প্রচারের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. এসএম খসরুল আলম কুদ্দুসীকে আহ্বায়ক, সহকারী প্রক্টর রেজাউল করিমকে সদস্য ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. হাছান মিয়াকে সদস্য সচিব করা হয়। তবে তদন্ত কমিটি গঠনের দুই বছর হতে চললেও এখনও প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি সেই কমিটি।
ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল এডুকেশন অ্যান্ড স্পোর্টস সায়েন্স বিভাগে অর্ডিন্যান্স সংক্রান্ত নানান অসঙ্গতি ও পরীক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় তদন্ত করতে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বহনকারী বাস দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন এবং বাসের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণের জন্য তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টারদা সূর্য সেন হলের তৎকালীন প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. খালেদ মিসবাহুজ্জামানকে আহ্বায়ক করা হয়। সদস্যরা হলেন— সহকারী প্রক্টর মুহাম্মদ ইয়াকুব, ডেপুটি রেজিস্ট্রার গিয়াস উদ্দীন। কমিটিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য বলা হয়। পরে ওই কমিটি প্রতিবেদন দিলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।
২০১৯ সালের ২০ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধীনে পিএইচডি গবেষণায় নিয়োজিত জামায়াত নেতা এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদকে নিয়ে ‘নিয়মবহির্ভূতভাবে’ সেমিনার আয়োজন করে বিভাগ কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি তদন্তে একই বছর ৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক (বর্তমান রেজিস্ট্রার) এসএম মনিরুল হাসানকে আহ্বায়ক এবং উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণা শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. দেলোয়ার হোসেনকে সদস্য সচিব করে দুই সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে কর্তৃপক্ষ। এই কমিটিও প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে এতে বড় ধরনের কোন অসঙ্গতি খুঁজে পায়নি বলে জানিয়েছেন কমিটির আহ্বায়ক এসএম মনিরুল হাসান।
২০১৯ সালের ১২ মে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. মাইদুল ইসলাম হুমকি পাওয়ার অভিযোগ করে নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করলে ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। ইংরেজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক গোলাম হোসেন হাবীব কমিটির আহ্বায়ক। সদস্য হিসেবে আছেন সহকারী প্রক্টর লিটন মিত্র ও হেলাল উদ্দিন আহমদ। এই কমিটি তদন্ত নিয়ে কোনো কাজই করেনি।
এ বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক গোলাম হোসেন হাবীব জানান, ‘আমরা আসলে এটা নিয়ে কাজই শুরু করতে পারিনি। আমাদের দায়িত্ব দেওয়ার পর প্রশাসন পরিবর্তনসহ বিভিন্ন ঝামেলা হয়।’
এছাড়া ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত আরও তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এদের মধ্যে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী এমদাদকে অপহরণের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন প্রকাশ করলে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়। এছাড়া আর কোনো প্রতিবেদন জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয়নি।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার কারণ কী?
তদন্ত প্রতিবেদন জমা না দেওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে কয়েকজন তদন্ত কমিটির সদস্য জানিয়েছেন, অনেক সময় প্রশাসন চায় না তদন্ত প্রতিবেদন জমা হোক। তারা চান আপোষে মীমাংসা হয়ে যাক। প্রতিবেদন জমা হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এর ফলে নতুন করে আবার ঝামেলা হবে। এর চেয়ে দুই পক্ষকে আপোষে মিলিয়ে দিলেই ঝামেলা শেষ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে একটি তদন্ত কমিটির প্রধান নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা প্রতিবেদন জমা দিতে চাই। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমাদের জানিয়েছে ভিকটিমের সঙ্গে অভিযুক্তদের সমঝোতার চেষ্টা হচ্ছে। আমরা যেন প্রতিবেদন তৈরিতে একটু সময়ক্ষেপণ করি।’
আরেকটি তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, ‘আসলে তদন্ত কমিটি গঠন অনেকটা আইওয়াশের মতো। কাজের কাজ কিছু হয় না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক একজন উপাচার্য নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন না দেওয়ার পিছনে কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, অনেক সময় সঠিক তথ্য প্রমাণ ও সাক্ষী পাওয়া যায় না। আবার অনেক সময় প্রতিবেদন দিয়ে কমিটির সদস্যরা কারও শত্রু হতে চান না।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কোন তদন্ত প্রতিবেদন জমা পড়লে অবশ্যই তার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। না হয় অপরাধীরা অপরাধ করতে আরও সুযোগ পায়।’
ভুক্তভোগীরা হতাশ
এদিকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে প্রতিবেদন জমা না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না প্রশাসন। কিন্তু তদন্ত কমিটির মেয়াদ শেষ হলে তারা নানান বাহানায় সময় বাড়িয়ে নেন। এভাবে এমনকি বছরের পর বছরও তদন্ত প্রতিবেদন ঝুলে থাকে। ফলে ভুক্তভোগীরা বিচার থেকে বঞ্চিত হন। এতে হতাশা ব্যক্ত করেছেন কয়েকজন ভুক্তভোগী।
দুর্বৃত্তদের হাতে মারধরের শিকার হিসাব নিয়ামক ফরিদুল আলম বলেন, ‘ঘটনার এত মাস পরেও তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়নি। দেবে কিনা সেটাও জানি না।’
সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মাইদুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবাসিক ভবনে আমি পরিবারসহ থাকি ২০১৯ সালের ১২ মে সেখানে কিছু লোক এসে হুমকি-ধামকি দেয়, অশ্রাব্য গালাগাল করতে থাকে। অনিরাপদ বোধ করায় আমি তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসনকে জানাই এবং পরদিন ১৩ মে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর বরাবর নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করি। নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন জমা দিতে গেলেও প্রক্টর সেই আবেদন গ্রহণ করেননি। দ্বিতীয় দফায় আবার গেলে প্রক্টর আবেদন গ্রহণ করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন জবাব পাইনি এবং ক্যাম্পাসে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রশাসন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। আমার আবেদনের কোন জবাবও দেয়নি। প্রক্টরকে ফোন করলে সে সময় তিনি কোন পদক্ষেপ না নিয়ে বলেছিলেন পুলিশকে জানাতে। পুলিশকে ফোন করলে তারা বলেছিল প্রক্টর থাকতে তারা এ বিষয়ে কিছু করতে পারবে না। পিংপং খেলা চললো, কোন পদক্ষেপই নেওয়া হলো না। এটি পরিস্কার যে ক্ষমতার অংশীদার প্রশাসন অন্যায়কারীর পক্ষ নিয়েছিলো।’
প্রশাসন যা বলছে
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক বেনু কুমার দে কোন মন্তব্য না করে উপাচার্য ও রেজিস্ট্রারের সাথে যোগাযোগ করতে বলেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর এস এম মনিরুল হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে চাই না। তবে এতটুকু বলবো, তদন্ত কমিটিকে কেউ সাহায্য করেন না। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও সাক্ষ্য দিতে এগিয়ে আসেন না অনেকেই। তাই তারা প্রতিবেদন জমা দিতে পারেন না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার অসুস্থ থাকায় তাঁর বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
এমআইটি/সিপি