চবিতে করোনার বন্ধেই কটেজ-মেসে ৫০টি চুরির ঘটনা, বাড়িমালিকদের যোগসাজশ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী সারোয়ার আলম দীপ। তিন বছর ধরে ভাড়া থাকেন ক্যাম্পাসের পাশে নজরুল কটেজে। করোনা সংক্রমণের শংকায় গেল মার্চে ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করা হলে মূল্যবান সব জিনিসপত্র কটেজে রেখেই চলে যান বাড়িতে। সাত মাস পর গত ২১ অক্টোবর কটেজে গিয়ে দেখেন রেখে যাওয়া গিটার, তিনটা নতুন পেনড্রাইভ, কার্বলিক এসিডের দুটো বোতলসহ অনেক কিছু নেই। এছাড়া দুটি তবলা, টেবিল ফ্যান, লাইট ভেঙে রাখা, বিছানা চাদর, চারটা পাঞ্জাবিও ছেঁড়া। তবে বই-খাতা, নোট, সার্টিফিকেট, শিক্ষাগত সার্টিফিকেট, মার্কশিট সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। এ ঘটনা কটেজ মালিককে জানালে তিনি এর কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। যদিও দীপের সন্দেহ কটেজ মালিকের যোগসাজশেই এমনটা হয়েছে।

রসায়ন বিভাগের শিরিণ আক্তার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সৈয়দা সাদিয়া রহমান—এই দুই বান্ধবী থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) সাউথ ক্যাম্পাসের পাহাড়িকা হাউজিং সোসাইটির কামাল উদ্দিন ভবনের চতুর্থ তলায়। গত ৩০ সেপ্টেম্বর শিরিণ আক্তার বান্দরবান এবং ১ অক্টোবর সাদিয়া রহমান কক্সবাজারে ভ্রমণে যান। ২ অক্টোবর সাদিয়া বাসায় ফিরে তালাবদ্ধ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখেন ভেতরের জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। পরে দেওয়ালে ঝোলানো তার ব্যাগ খুলে দেখেন, সেখানে রাখা ১১ হাজার টাকা মূল্যের একটি স্বর্ণের আংটি ও নগদ কিছু টাকা নেই। এ ঘটনা বান্ধবী শিরিণকে জানালে তিনি ৪ অক্টোবর বাসায় এসে দেখেন, তার ট্রলিব্যাগে রাখা একটি স্বর্ণের চেইন, একটি লকেট, দুই জোড়া স্বর্ণের কানের দুল, একটি ডায়মন্ডের নাকফুল ও নগদ কিছু টাকা পাওয়া যাচ্ছে না। সবমিলিয়ে এক লাখ দুই হাজার ৩০০ টাকার মালামাল খোয়া যায় শিরিণের। এ ঘটনা বাড়ি মালিককে জানালে তিনি উল্টো বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেন। প্রক্টর অফিস ও থানায় অভিযোগ করার পরও কোনো সুরাহা হয়নি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে ঘটনার কয়েকদিন পরেই ওই বাসা ছেড়ে দেন তারা।

দীপ, শিরিণ কিংবা সাদিয়ার বাসা চুরির এই দুটি ঘটনা কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা বাড়ি চলে যাওয়ায় মা কটেজ, মোনাফ কটেজ, মুক্তাদির স্যারের বাসাসহ বিভিন্ন কটেজ-বাসার অন্তত অর্ধশতাধিক রুমে ঘটেছে এমন চুরির ঘটনা। এতে খোয়া গেছে শিক্ষার্থীদের লাখ লাখ টাকার মূল্যবান জিনিসপত্র। এখনও প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো কটেজ থেকে এ ধরনের অভিযোগ আসছে।

চবিতে করোনার বন্ধেই কটেজ-মেসে ৫০টি চুরির ঘটনা, বাড়িমালিকদের যোগসাজশ 1

শিক্ষার্থীদের দাবি, কটেজ বা বাড়ি মালিকদের যোগসাজশেই ঘটেছে এসব চুরির ঘটনা। চুরির ঘটনা বাড়ি মালিকদের জানালে তারা তো কোন প্রতিকার করেনই না, উল্টো হুমকি ধমকি দেন শিক্ষার্থীদের। কটেজ মালিকদের অনেকে এসব ঘটনাকে পাশ কাটান হাস্যকর নানা কথা বলে। কেউ বলেন এগুলো বিড়ালের কাজ, কেউবা বলেন শত্রুদের কাজ, আবার কেউ বলেন ছাত্রলীগের কাজ। এসব ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা পুলিশকে জানিয়েও কোনো সুরাহা হচ্ছে না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করছেন তারা।

শিক্ষার্থীরা বলেন, তিন বছর ধরে প্রশাসন আবাসিক হলে আসন বরাদ্দ দিচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়েই তাদের কটেজে বা বাসায় ভাড়া থাকতে হচ্ছে। যেখানে নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। প্রশাসন যদি হলে আমাদের আসন বরাদ্দ দিতো তাহলে আমাদের এই জিনিসগুলো চুরি হতো না।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আ ন ম আব্দুল মুক্তাদিরের বাসায় ভাড়া থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের বিভিন্ন মালামাল চুরি হয়। চুরির ঘটনাটি অধ্যাপক মুক্তাদিরকে ছাত্রীরা জানালে তিনি এসব ‘বিড়ালের কাজ’ বলে জানান। এ ঘটনায় ১৯ অক্টোবর দুপুরে ভুক্তভোগী ছাত্রীরা প্রক্টর বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। পরে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।

মুক্তাদির স্যারের ভাড়া বাসার ভুক্তভোগী এক ছাত্রী জানান, ‘করোনার ছুটিতে বাড়ি চলে যাওয়ার দীর্ঘদিন পর দরকারি জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য কুমিল্লা থেকে ১৮ অক্টোবর ক্যাম্পাসে আসি। আমরা বাড়ি যাওয়ার সময় আমাদের বিছানা ও জিনিসপত্র সব গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু বাসায় এসে দেখি বাসার সব জিনিসপত্র এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। বাসার সিলিংফ্যান, মাল্টিপ্লাগ, ছাতাসহ আরও অনেক ব্যবহারের জিনিস আমরা আসার পর খুঁজে পাচ্ছি না। এ নিয়ে আমরা তাৎক্ষণিক বাড়িওয়ালাকে জানালে উনি বললেন এসব বিড়ালের কাজ। অথচ বাসার দরজা জানালা সব কিছু বন্ধ ছিল। বিড়াল প্রবেশের প্রশ্নই আসে না।’

এর আগে গত মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল পাহাড়ের পাশে ‘মা কটেজে’ তৈমুর উদ্দীনের (ছদ্মনাম) কক্ষসহ ওই কটেজের ৬টি বাসায় চুরি হয়। এতে তৈমুরের ১০ হাজার টাকা দামের একটা লেন্স, ক্যামেরা স্ট্যান্ডসহ আরও কিছু দামি জিনিসপত্র চুরি হয়। এছাড়া পাশের অন্যান্য বাসা থেকে সাইকেল, ইলেক্ট্রনিক মালামালসহ হাজার হাজার টাকার জিনিস চুরি হয়।

তৈমুর চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেদিন ভার্সিটি বন্ধ দিল সেদিন আমি ক্যামেরা বিক্রি করে দিয়েছি। তবে লেন্স আর ক্যামেরা স্ট্যান্ডসহ কিছু জিনিস রুমেই রেখে বাড়ি চলে যাই। কিন্তু গত মাসের শেষের দিকে রুমে গিয়ে দেখি এসবের কিছুই নেই। খোঁজ নিয়ে জানলাম অন্য পাঁচটি বাসারও একই অবস্থা।’

সারওয়ার আলম নামের আরেক শিক্ষার্থী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ঢাকা থেকে সাত মাস পর রুম ছেড়ে দেওয়ার জন্য ক্যাম্পাসে আসি। ক্যাম্পাসে এসে মালিকের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। ভেবেছি তাকে নিয়েই কটেজে ঢুকবো এবং সব জিনিসপত্র থেকে যেগুলো ভাল আছে সেসব একসাথে করে এক বন্ধুর বাসায় রাখবো আর নষ্ট গুলো ফেলে দেবো। কটেজে গিয়ে দেখি পুরো সবুজ জঙ্গল। কটেজের দিকে যাওয়ার পথে মালিক আমাকে বলেন, তুমি তো এতদিন ছিলা না। এদিকে তোমার রুমে কারা যেন এসে তোমার সব জিনিসপত্র তছনছ করে গেছে, খাট উল্টিয়ে সব কিছু এলোমেলো করে গেছে। তোমার সাথে শত্রুতা আছে বোধহয় কারও— এরাই এসব করে গেছে। আমি বললাম, এসব আপনারাও করতে পারেন বিশ্বাস নেই আপনাদের। এ সময় ওনার কথাবার্তা, আর চেহারায় চোরের ছাপ লক্ষ্য করছিলাম। উনাকে বলছি আপনারা ছাড়া কারও কাজ না। ওনি বলেন, না এগুলা তোমার কোনো শত্রুর কাজ, নাহলে লীগের পোলাপান করে গেছে।’

কামাল উদ্দিন ভবনের বাসিন্দা শিরিণ বলেন, ‘বাড়ির মালিকের কাছে বিকল্প চাবি থাকতো। বিভিন্ন সময় আমরা বাইরে থেকে ফিরে দেখতাম রুমের জিনিসপত্র এলোমেলো। মালিক ও তার দুই মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে তারা কিছু জানে না বলতো। এখানে ছোটখাটো জিনিসপত্র হারানো ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এই ঘটনার পরও মেইন দরজার তালা ও ঘরের জানালা, দরজা অক্ষত ছিল।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কটেজ মালিক সমিতির সভাপতি মো. শাহ আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রশাসন অনেক চাপাচাপি করে ৪০ শতাংশ ছাড় নিয়েছে। এখন দারোয়ান রেখে শিক্ষার্থীদের মালামাল পাহারা দেওয়া সম্ভব না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেন এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে। আর শিক্ষার্থীরা যেন তাদের মালামাল নিয়ে যায়। তাদের বলা আছে কোথাও গেলে যেন মূল্যবান জিনিস কটেজে না রাখে।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভুঁইয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ ঘটনাগুলো যেহেতু কটেজে ঘটছে সেহেতু এর দায় কটেজ মালিকদের। শিক্ষার্থীরা কটেজে থাকুক বা না থাকুক, শিক্ষার্থীদের মালামাল নিরাপদে রাখার দায়িত্ব তাদের।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!