চট্টগ্রাম রেলে ভুয়া বিলে কোটি টাকা হাওয়া, ঠিকাদার জানেই না
৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্ত, তদন্তে কমিটি
রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রামে ভুয়া বিল-ভাউচারে কোটি টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাতের ঘটনায় চলছে ‘লুকোচুরি’। এ ঘটনায় সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
তবে এ ঘটনায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দোষী দাবি করে রেলের পক্ষ থেকে বিলের চেক ফেরত দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারীকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দাবি, কোনো ধরনের বিলের চেক তারা পাননি। এমনকি যে ব্যক্তি ওই চেক উত্তোলন করেছেন, তিনি প্রতিষ্ঠানের কেউ নন। তাদের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া সিল-ভাউচার বানিয়ে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। এছাড়া টাকা উত্তোলনের সময় প্রতিষ্ঠানের কোনো কনফরমেশন নেওয়া হয়নি এবং উত্তোলনকারীর পরিচয়ও যাচাই করা হয়নি।
এ ঘটনার পর গত ৭ ফেব্রুয়ারি অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তার (পূর্ব) কার্যালয়ের (এফএঅ্যান্ডসিএও) ওই সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে প্রথমে বদলি করা হয়। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি তাদের সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারী হলেন হিসাব কর্মকর্তা মামুন হোসেন, হিসাবরক্ষক শিমুল বেগম, অডিটর (ডিএফএ) পবন কুমার পালিত, হিসাব কর্মকর্তা (প্রশাসন) মো. আবু নাছের, হিসাবরক্ষক (প্রশাসন ও সংস্থাপন) সৈয়দ সাইফুর রহমান, জুনিয়র অডিটর ইকবাল মো. রেজাউল করিম এবং অফিস সহায়ক মাকসুদুর রহমান।
জানা গেছে, রেল পূর্বাঞ্চলের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান (সাপ্লাইয়ার) ‘দ্যা কসমোপলিটন কর্পোরেশন’ ৩ কোটি ৬২ লাখ ৬১ হাজার টাকার কাজের বিল পায়। তাদের গত ১৮ ডিসেম্বর ৯৭ লাখ ৭৫ হাজার টাকা, ১৯ ডিসেম্বর ৯০ লাখ ৪৪ হাজার টাকা এবং ২০ ডিসেম্বর ৯৬ লাখ ৯০ হাজার ও ৭৭ লাখ ৫২ হাজার টাকার চেক দেওয়া হয়। চেকগুলো নগদায়ন করা হয় ২১ ডিসেম্বর। এসব চেকের নম্বর ছিল যথাক্রমে আরএ-১১৩৯৩০৪, ১১৩৯৩০৬, ১১৩৯৩০৫ এবং ১১৩৯৩০৭।
কিন্তু আরএ-১১৩৯০৮৫ নম্বরের আরেক চেক দিয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর ৯৬ লাখ ৯০ হাজার টাকার একটি বিল আগ্রাবাদের সীমান্ত ব্যাংক থেকে নগদায়ন করা হয়। বিলটি উত্তোলন করেন সোহাগ আলী নামের এক ব্যক্তি। এই বিলটি নগদায়ন করার জন্য ওই ব্রাঞ্চে কসমোপলিটনের নামের একটি নতুন অ্যাকাউন্টও খোলা হয়। যেটিতে শুধুমাত্র ওই পঞ্চম চেকটি নগদায়ন করা হয়।
এদিকে দেখা গেছে, ৩১ ডিসেম্বর উত্তোলন করা চেকের নম্বরটি আগে দেওয়া বিলের চারটি চেকেরও আগের সিরিয়ালের।
অথচ চেকের নম্বরের ধারাবাহিকতা অনুযায়ী চারটি চেকের পরের সিরিয়াল অনুযায়ী হওয়ার কথা পঞ্চম চেকটি। এছাড়া পঞ্চম চেকের বিষয়টি রেলের খাতায় রেজিস্ট্রারে লিপিবদ্ধ নেই, এমনকি প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) দপ্তর থেকেও কোনো বিলের কপি ডিভিশনাল ফাইন্যান্স অফিসে (ডিএফও) ফরোয়ার্ড করা হয়নি বলেও জানা গেছে।
এ ঘটনার পর বিষয়টি জানাজানি হলে গত ১১ ফেব্রুয়ারি রেল কর্তৃপক্ষ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক বরাবরে ওই পঞ্চম চেকটি ফেরত চেয়ে চিঠি ইস্যু করে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া বিল-ভাউচার দাখিল করে জালিয়াতির মাধ্যমে টাকা নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় হিসাব ও স্টোরস শাখার একটি চক্র কাজ করেছে। অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তার অফিসের অস্থায়ী কর্মচারী হাবিব নামের এক ব্যক্তি এতে জড়িত। অস্থায়ী কর্মচারী হলেও অফিসের কম্পিউটারের গোপন পাসওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে তাকে।
দ্যা কসমোপলিটন কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী নাবিল আহসান চৌধুরী বলেন, ‘আমাকে কাজের টাকা বাবদ রেলওয়ে থেকে চারটি চেক দেওয়া হয়েছে। আমি সেই চেকগুলো নগদায়ন করেছি। এরপর হঠাৎ রেল কর্তৃপক্ষ আমার কাছ থেকে ৯৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যের একটি চেক ফেরত চেয়ে চিঠি দেয়। সেখানে উল্লেখ আছে, সোহাগ আলী নামের এক ব্যক্তি চেকটি ৩১ ডিসেম্বর নগদায়ন করেছেন। কিন্তু আমার এখানে সোহাগ আলী নামে কোনো ব্যক্তি নেই। আর এই ধরনের বিল চেয়ে আমি কোনো চিঠিও রেলওয়ে বরাবরে দিইনি।’
পঞ্চম চেকের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমিই রেলের নজরে আনি। এখন তারা আমাকেই বলির পাঁঠা বানাচ্ছে। আমার ঘাড়েই টাকা আত্মসাতের দোষ চাপাতে চাইছে। তারা কিন্তু এর মধ্যে সাত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বরখাস্তও করেছে। এদিকে সোহাগ আলী নামের ওই ব্যক্তির কাছে চেক হস্তান্তরের সময় আমার কাছ থেকে রেল কর্তৃপক্ষ কোনো অথরাইজেশন নেয়নি। নিয়ম অনুযায়ী, চেক হস্তান্তরের সময় তার এনআইডি যাচাই করার পর আমার প্রতিষ্ঠানের নামে চেক তাকে দেওয়ার সময় আমার অথরানাজাইশন নিতে হবে। রেলের এফএঅ্যান্ডসিএও নিজে তাদের গাফেলতির কথা আমার কাছে স্বীকার করেছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের ভুয়া অ্যাকাউন্ট তৈরি করে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। ব্যাংক থেকেও আমার সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করা হয়নি।’
পঞ্চম চেকের বিষয়ে জানতে চাইলে পাহাড়তলীর প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক (পূর্ব) ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘এই ধরনের কোনো বিল হিসাব শাখায় পাঠানো হয়নি।’
অতিরিক্ত অর্থ উপদেষ্টা ও প্রধান হিসাব অধিকর্তা (পূর্ব) সাইদুর রহমান সরকারের কাছে সরেজমিন বক্তব্য নিতে গেলে তিনি ব্যস্ততার কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে যান।
এদিকে এ বিষয়ে জানতে চার সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান জয়শ্রী করের দপ্তরে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি ছুটিতে আছেন বলে জানান পাহাড়তলীর সহকারী হিসাব কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন। কমিটির অপর সদস্য জহিরুল হোসেন গতকাল রোববার থেকে তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানান।
ডিজে