রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল চট্টগ্রামে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) বদলি নিয়ে বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। অক্টোবর মাসে প্রায় একশ জনকে চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে বদলি করা হয়েছে। এদের মধ্যে এক জায়গায় আট থেকে নয় মাস না যেতেই অনেককে বদলি করা হয়েছে আবার অনেকে ১৫ বছর ধরে একই জায়গায় বহাল তবিয়তে আছেন। হঠাৎ এভাবে বদলি ঠেকাতে অনেকে তদবির করতে ছুটছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে। আবার অনেকে পছন্দের জায়গায় বদলির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘পকেট ভারী’ করছেন।
বদলির সংখ্যা নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে চলছে লুকোচুরি, একেক সময় একক তথ্য দিচ্ছেন তারা। কেউ বলছেন চট্টগ্রাম থেকে বদলি করা হয়েছে ৫০ জনকে, আবার কেউ বলছেন সেই সংখ্যা একশ’র কাছাকাছি। তবে প্রকৃত বদলির সংখ্যা এরচেয়ে বেশি বলে জানা গেছে।
আর এসব বদলি বাণিজ্য নিয়ে আরএনবির অনেকে আঙুল তুলছেন চিফ কমান্ড্যান্ট ও কমান্ড্যান্টের দিকে।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলে এ পর্যন্ত প্রায় দেড় শতাধিক আএনবি সদস্যকে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগের ছিল প্রায় একশ সদস্য। যাদের মধ্যে অনেকে আট মাস আগে বদলি হয়ে এসেছেন, তাদেরও বিভাগীয় বদলির আদেশ দেওয়া হয়। আবার অনেকে ১৫ থেকে ২০ বছর ধরেও একই জায়গায় কাজ করে গেলেও তাদের প্রতি দৃষ্টি পড়েনি বদলির আদেশদাতাদের।
বদলি আদেশগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে। এতে দেখা গেছে, ১৪ অক্টোবর এক আদেশে ১৯ জনকে বদলি করা হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ছিল ১০ জন। যাদের একজন হাবিলদার এবং ৯ জন সিপাহী। একইদিন আরেক আদেশে ১৬ জনকে বদলি করা হয়, যাদের ১০ জনই চট্টগ্রাম থেকে। এর মধ্যে একজন নায়েক, একজন হাবিলদার ও আটজন সিপাহী।
১৬ অক্টোবর এক আদেশে দেখা গেছে, ২৩ জনের একটি বদলি আদেশে চট্টগ্রামের আছেন আটজন। যাদের সবাই সিপাহী। আরেকটি আদেশে ২০ জনকে বদলি করা হয়, যাদের মধ্যে চট্টগ্রামের আছেন ১১ জন। এদের ২ জন হাবিলদার এবং ৯ জন সিপাহী। এছাড়া একইদিন আরেকটি আদেশে আরও ২০ জনকে বদলি করা হয়। যাদের মধ্যে চট্টগ্রামের ১১ জনের নাম ছিল, এদের ২ জন হাবিলদার এবং অপর ৯ জন সিপাহী।
১৭ অক্টোবর এক আদেশে ২০ জনকে বদলি করা হয়। যাদের মধ্যে চট্টগ্রামের ছিল ৮ জন। এর মধ্যে ২ জন এসআই, একজন হাবিলদার ও ৫ জন সিপাহী।
আরও জানা গছে, এসব আদেশ ছাড়ার আরও বেশ কিছু সদস্যকে বিভিন্ন সময়ে বদলি করা হয়। তবে এসব বদলির আদেশে কতজনের নাম রয়েছে তা নিয়ে লুকোচুরি করা হয়। পছন্দের জায়গা ও পদবি অনুযায়ী বদলির জন্য ৫০ হাজার থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষের লেনদেন হয়েছে। ইন্সপেক্টর পদে পছন্দের জায়গায় বদলির জন্য ৭ লাখ টাকা, এএসআই পদের জন্য ৪ লাখ টাকা, হাবিলদার পদের জন্য ৪০ হাজার টাকা ও সিপাহি পদের জন্য ৩০ হাজার টাকা করে নেওয়া হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলামের হয়ে চট্টগ্রামে এসব বদলি বাণিজ্যের ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে আছেন আরএনবির চিফ কমান্ড্যান্ট অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইমাম হোসেন, গোয়েন্দা শাখা চট্টগ্রামের ইন্সপেক্টর মো. ইয়াসিন উল্লাহ ও লাকসামের ইন্সপেক্টর মো. সালামত উল্লাহ। এছাড়া ঢাকায় রয়েছেন কমান্ড্যান্ট শহীদুল্লাহ। এদের মধ্যে আশাবুল ইসলাম ও শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিফ কমান্ডেন্ট আশাবুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে ১৮৫ জন সিপাহী নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে দুদকে অভিযোগ দায়ের হয়। ২০২২ সালের ২৮ আগস্ট দুদক তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। অন্যদিকে কমান্ডেন্ট শহীদুল্লাহর বিরুদ্ধে চলতি বছরের ২৭ জুলাই ইস্যু করা চিঠিতে ৮টি অভিযোগের ওপর নথিপত্র চায় দুদক। ৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ ছাড়াও সিপাহী নিয়োগে দুর্নীতি ও ঢাকায় ৫টি ফ্ল্যাট, কুমিল্লায় ৩০ বিঘা জমি, শাশুড়ির নামে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট থাকার বিষয়ে অনুসন্ধান করছে দুদক।
বদলির বিষয়ে জানতে চাইলে আরএনবির চিফ কমান্ড্যান্ট অফিসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইমাম হোসেন বলেন, ‘১ অক্টোবর থেকে এখনও পর্যন্ত প্রায় শতাধিক সদস্যকে বদলি করা হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আরএনবি সদস্য বলেন, সিজিপিওয়াই আরএনবি ইন্সপেক্টর মো. ইয়াসিনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় রেলওয়ের তেল ও মালামাল চুরি অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া আগস্ট মাসে সে মালামাল চুরিতে ধরা পড়ে। কিন্তু তাকে বদলি করা হয়েছে সিআরবি গোয়েন্দা শাখায়। সে ৮ লাখ টাকায় পছন্দের এই বদলি বাগিয়ে নিয়েছে বলে জেনেছি। সেই ইয়াসিন এখন বদলি বাণিজ্যের ক্যাশিয়ার হয়েছে। অন্যদিকে সিনিয়র ইন্সপেক্টর থাকার পরেও সিজিপিওয়াইয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে সাব ইন্সপেক্টর আবু সুফিয়ানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ইয়াসিন ছাড়াও ক্যাশিয়ার হিসেবে রয়েছেন কুমিল্লা লাকসাম ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. সালামত উল্লাহ।
তারা আরও বলেন, কুমিল্লার লাকসামের পোস্টিং হাবিলদার মো. ইকবাল হোসেনকে টাকার বিনিময়ে তার নিজ এলাকা কুমিল্লায় বদলি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ক্যারেজ ওয়াগনের কোটি টাকার মালামাল চুরিতে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।
সিপাহি পদে ময়মনসিংহ বদলি হওয়া কয়েকজন আরএনবি সদস্য চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের বিরুদ্ধে কোনো দলীয় লেজুড়বৃত্তি ও অনিয়মের অভিযোগ নেই। টাকা না দেওয়ার কারণে আমাদের ময়মনসিংহে বদলি করা হয়েছে। চিফ কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলাম ও কমান্ড্যান্ট শহীদুল্লাহর নামে মো. ইয়াসিন আমার কাছে দুই লাখ টাকা চেয়েছে। দেইনি বলে চট্টগ্রাম থেকে দূরে বদলি করেছে।’
এক জায়গায় বছরের পর বছর
চট্টগ্রাম জেনারেল শাখা (রেলওয়ে স্টেশন) এলাকায় হাবিলদার মো. ইউসুফ প্রায় ২০ বছর ধরে ঘুরেফিরে একই শাখায় জায়গায় আছেন। সিপাহি কামরুজ্জামান, নজরুল, আবু তাহের মো. ইমরান, সুমন দাশগুপ্ত, শাহাদাত হোসেন, জাকির হোসেন, আবদুল্লাহ আল মাহফুজ, খন্দকার শাহিন, লুৎফর রহমান, সেলিম মিয়া, তপন চন্দ্র ভৌমিক, সোহেল, তপন চাকমা, হাবিলদার মাহমুদুল হক ১৫ বছর ধরে জেনারেল শাখায় দায়িত্ব পালন করছেন।
পাহাড়তলী কারখানা শাখায় সিপাহীদের মধ্যে রবিউল ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, টিপু সুলতান, এনামুল হক, বাবলা দাশ, হাবিলদার রাহুল দাশ প্রায় ১০ বছর ধরে বহাল তবিয়তে আছেন।
পাহাড়তলী স্টোর শাখার সিপাহি রিয়াদ হোসেন, তারেক রহমান, হাবিলদার আবুল হোসেন আছেন ১০ বছর ধরে। বিভিন্ন সময় চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত হাবিলদার সাদ্দাম হোসেন, আবদুল মালেক ১০ বছর ধরে আছেন।
চট্টগ্রাম অস্ত্র শাখায় হাবিলদার রকিবুল ইসলাম, জহিরুল ইসলাম, পান্না লাল দে এবং সিপাহী ফজলুর রহমান, কামাল উদ্দিন, আবদুল বাতেন, মোস্তাফিজুর রহমান আছেন ১০ বছর ধরে। এছাড়া শাহাবুদ্দিন জিতু ওই শাখা কর্মরত আছে ২০ বছর ধরে।
এছাড়া চট্টগ্রাম স্টেশনে সিপাহীদের মধ্যে রমজান আলী, সমীর তালুকদার, তুহিন বিশ্বাস, দ্বীন ইসলাম, সোহেল রানা, আরিফুল ইসলাম, আরিফুর রহমান, আমান উল্লাহ কর্মরত আছেন প্রায় ১০ বছরের বেশি সময় ধরে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘যেকোনো বদলি স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বদলি ঠেকানো বা পছন্দের জায়গায় বদলির জন্য আর্থিক লেনদেন ভিন্ন, এ বিষয়ে আমার জানা নেই। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে, তদন্তে প্রমাণিত হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চল আরএনবির চিফ কমান্ড্যান্ট মো. আশাবুল ইসলাম বলেন, ‘যেসব স্থানে জনবল সংকট আছে, ওখানে লোকবল পূরণ করা হচ্ছে। পছন্দের জায়গায় যেতে না পেরে সুবিধাভোগীরা এসব অভিযোগ করছেন। সারা বছর আরাম করে খেয়েছে, এখন সমস্যা হচ্ছে। আমার নামে বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা।’
আরএনবির অনেকে ১০ থেকে ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে এক জায়গায় আছেন। তাদের কেন বদলি করা হচ্ছে না—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যাকে প্রয়োজন হচ্ছে এবং যেখানে প্রয়োজন হচ্ছে সেখানে বদলি করা হচ্ছে।’
ডিজে