চট্টগ্রাম যুবলীগে কাজিয়া, অভিমানী চারের জোটে বাচ্চু একঘরে

সব কর্মসূচিই আলাদা আলাদা

চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়কের সঙ্গে চার যুগ্ম আহ্বায়কের দ্বন্দ্ব যেন কিছুতেই মিটছে না। দিন দিন সেটি বরং আরও দগদগে হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু-পুত্র শেখ রাসেলের জন্মদিনে আলাদা কর্মসূচির পর এবার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করলো চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক-যুগ্ম আহ্বায়করা। আর এতেই স্পষ্ট হয়ে গেল, এই দ্বন্দ্ব সহসা আর কাটছে না।

এর মধ্যে বুধবার (১১ নভেম্বর) সকাল ১০টায় চট্টেশ্বরী রোডস্থ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভার আয়োজন করেন মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু। অন্যদিকে একই দিন বিকেলে একই কমিটির চার যুগ্ম আহ্বায়ক মিলে আলাদা আলোচনা সভার আয়োজন করেন স্টেশন রোডের সৈকত কনভেনশন হলে। আলাদা কর্মসূচি পালন করা এই চার যুগ্ম আহ্বায়ক হলেন দেলোয়ার হোসেন খোকা, ফরিদ মাহমুদ, দিদারুল আলম ও মাহবুবুল হক সুমন।

এই ধরনের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের জন্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর একক ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা, সংগঠনের রীতি-নীতি লঙ্ঘন, আধিপত্য বিস্তার, পদ-পদবি ব্যবহার করে কৌশলে ক্ষমতার অপব্যবহারকে দায়ী করছেন বিদ্রোহী ৪ যুগ্ম আহবায়ক। অন্যদিকে মহিউদ্দিন বাচ্চু বলছেন, কেন কীজন্য এভাবে আলাদা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে সেটাই জানেন না তিনি।

মহিউদ্দিন বাচ্চুর সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য নঈম উদ্দিন। প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যুবলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মাহমুদুল হক। নগর যুবলীগের শীর্ষ ৫ নেতার পাল্টাপাল্টি অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে সৈয়দ মাহমুদুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যুবলীগ একটা বড় সংগঠন। একটা পরিবারেও ভুল বোঝাবুঝি হয়। এখানেও কিছু বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। তবে এটাকে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর কোন ঘটনা ঘটবে না এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। আমরা এই ভুল বোঝাবুঝি সমাধানের বিষয়ে সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করছি।’

দ্বিধাবিভক্ত যুবলীগের ক্ষেত্রে আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চুই সৈয়দ মাহমুদুল হকের সমর্থন পাচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাকে দুই পক্ষই দাওয়াত করেছে। যেহেতু আমাদের সংগঠনে চেয়ারম্যান, সভাপতি-আহ্বায়করা একটু বেশি গুরুত্ব পান, তাই আমি আহ্বায়কের ডাকা অনুষ্ঠানে এসেছি। খোকাদের সাথেও আমার কথাবার্তা হয়েছে। আমরা সমাধানের চেষ্টা করছি।’

এদিকে পাল্টাপাল্টি অনুষ্ঠান করলেও এটিকে দ্বন্দ্ব বা বিরোধ হিসেবে মানতে রাজি নন ‘বিদ্রোহী’ চতুষ্টয়ের অন্যতম দেলোয়ার হোসেন খোকা। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়েছে। এজন্য আমরা আলাদা কর্মসূচি করছি। শুরুতে আমরা দীর্ঘদিন এক সাথে কর্মসূচি পালন করেছি। এক পর্যায়ে আহ্বায়ক নিজের মত করে কর্মসূচি প্রণয়ন শুরু করলেন। তখন আমরা উনাকে বাদ দিয়ে কর্মসূচি পালন করছি। আমাদের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা হয়েছে। উনারা সমস্যা সমাধান করলে আবার আমরা একত্রে কাজ করবো। এটা শুধুই মতপার্থক্য, বিরোধ নয়। কারো চরিত্রহননের ইচ্ছে আমাদের নেই।’

তবে এককভাবে সংগঠন চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে উল্টো যুগ্ম আহ্বায়কদের দায়ী করে আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, ‘এই যে আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন হচ্ছে সেটা কেন হচ্ছে তাই জানি না আমি। কারও কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা বলারও কিছু নিয়ম আছে। দলীয় ফোরামে কিছু না জানিয়ে এই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়াটা সাংগঠনিক নয়। তাছাড়া আমাদের গঠনতন্ত্রের নিয়মই হচ্ছে আহ্বায়কের পরামর্শে যুগ্ম আহ্বায়করা সভা সমাবেশ ডাকবেন। আমি নিয়ম অনুযায়ী তাদের সভা ডাকার পরামর্শ দিয়েছি। তারা যখন সাড়া দেয়নি তখন আমি নিজেই সভা ডেকেছি।’

প্রসঙ্গত এর আগেও চার যুগ্ম আহ্বায়ক মিলে মহিউদ্দিন বাচ্চুকে বাদ দিয়ে ২২ অক্টোবর আয়োজন করেন শেখ রাসেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। বিনা দাওয়াতে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে হট্টগোলের চেষ্টা করেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। এ সময় সভা সংক্ষিপ্ত করে সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করেন ফরিদ মাহমুদরা।

এ বিষয়ে নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ সে সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘নগর যুবলীগের আহ্বায়ক সাহেব দীর্ঘদিন যুবলীগের ব্যানারে নিজে নিজে কর্মসূচি পালন করেন। সর্বশেষ একদিন আগেও করেছেন। আমরা সেখানে দাওয়াত পাইনি। তাই যাইনি। আজকে কর্মসূচি ছিল আমাদের। আমরা তাকে এখানে আসতে বলিনি। এর আগেও আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন, আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সারের মৃত্যুদিবসসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি। আজকের গ্রোপ্রামে বাচ্চু সাহেব যুবলীগ করে না— এমন ছোট ভাইদের সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এসে উনি তাদের দিয়ে হট্টগোল সৃষ্টি করেছেন। আমরা সংঘাত এড়াতে সভা সংক্ষিপ্ত করেছি।’

যুগ্ম আহ্বায়কদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেছিলেন, ‘দলীয় কর্মসূচির দাওয়াত পেয়েই আমি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। আর আলাদা প্রোগ্রামের বিষয়টি হলো করোনায় আমি নিজ উদ্যোগে ত্রাণ দিয়েছি। দলের নির্দেশনাও ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তখন অনেকেই ঘর থেকে বের হননি। আমার কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেননি। এটাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। আর হট্টগোল সৃষ্টির বিষয়টি সত্য নয়। স্লোগান হলো মিটিংয়ের প্রাণ। মিটিং সমাবেশ হবে, সেখানে স্লোগান হবে না— তা কিভাবে হয়? আমার সাথে যারা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছে সবাই সংগঠনের। যেহেতু কমিটি নেই, তাদের পদ-পদবির পরিচয় নেই। কিন্তু তারা ছাত্র রাজনীতি করে আসা ছোট ভাই।’

সাত বছর আগে নগর আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী মহিউদ্দিন বাচ্চুকে আহ্বায়ক এবং দেলোয়ার হোসেন খোকা, দিদারুল আলম, ফরিদ মাহমুদ ও মাহবুবুল হক সুমনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ১০১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় যুবলীগ। তিন মাসের জন্য গঠিত ওই আহ্বায়ক কমিটি সাত বছর পার করলেও নগর যুবলীগের অন্য কোনো নেতা পাননি পদপদবির পরিচয়। নগর যুবলীগের এই পাঁচ শীর্ষ নেতার বিভক্তির প্রভাব আছে থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়েও। গত বছর লালদীঘিতে নগর যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পণ্ড হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে।

এআরটি/এমএহক/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!