চট্টগ্রাম যুবলীগের ঝগড়া মেটানোর মিশনে রেজাউল, এক সপ্তাহ টার্গেট

অবশেষে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের দুই গ্রুপের মধ্যকার ‘কাজিয়া’ মিটমাটের চেষ্টা চলছে জোরেসোরেই। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে উদ্যোগটি নিয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। দীর্ঘ এক বছর ধরে নিজেদের মতো করে আলাদা পথে হাঁটা চট্টগ্রাম নগর যুবলীগের এই দুই গ্রুপের নেতাদের এক টেবিলে দেখা যাচ্ছে আগামী সপ্তাহেই— যদি সব কিছু ঠিকঠাক থাকে।

নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চুর বিরুদ্ধে সংগঠন পরিচালনায় স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে গত এক বছর ধরেই জোট বেধে আলাদাভাবে সাংগঠনিক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছেন কমিটির চার যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকা, ফরিদ মাহমুদ, দিদারুল আলম ও মাহবুবুল হক সুমন। এই সময়ে দুই পক্ষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটলেও বড় ধরনের অঘটন ঘটা নিয়ে বরাবরই চিন্তিত ছিল রাজনৈতিক সচেতনমহল।

তবে এবার এই বিরোধ মিটানোর জন্য দুই পক্ষের সাথে সাথে আলাপ আলোচনা সেরে নিয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম।

বিবাদমান যুবলীগের দুই অংশের মধ্যে ‘ঐক্যের সুবাতাসের’ বিষয়টি রেজাউল করিম চৌধুরী নিজেই জানিয়েছেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে। এদিকে দুই গ্রুপের মধ্যে যুগ্ম আহ্বায়কদের পক্ষ থেকে সমঝোতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলেও আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলছেন এমন উদ্যোগের বিষয়ে কিছুই জানেন না তিনি।

যুবলীগের দুই পক্ষের মধ্যকার দুরত্ব কমিয়ে ঐক্যবদ্ধ অবস্থানের বিষয়ে রেজাউল করিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটি খুব বড় কোনো ঝামেলা নয়। তাদের মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল। একটা মান-অভিমানের ব্যাপার। ফলে বেশ কিছুদিন ধরেই তারা আলাদা আলাদা কর্মসূচি পালন করছিল। যেটা আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। আমি দুই পক্ষের সাথেই কথা বলেছি ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য। তারাও ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। খুব শীঘ্রই আমরা তাদের আবার এক সাথে দেখবো।’

চসিক নির্বাচনকে সামনে রেখেই রেজাউলের এমন ঐক্যের ডাক কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল বলেন, ‘উনারা নৌকার পরীক্ষিত কর্মী। নৌকার পক্ষে তাদের অবস্থান ও আন্তরিকতা প্রশ্নাতীত। যেকোন পরিস্থিতিতে নৌকার বিজয়ের জন্য কাজ করতে উনারা বদ্ধপরিকর। তাদের বিরোধের প্রভাব নির্বাচনে পড়বে এমনটা আমি মনে করি না। তবে দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আমি তাদের সাথে আলাপ করেছি। তারাও সাড়া দিয়েছে। এটা অতো বড় কোনো বিরোধও ছিল না।’

তবে এমন কোনো উদ্যোগের বিষয়ে জানেনই না মন্তব্য করে যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘রেজাউল করিম ভাই এই ধরনের কোন উদ্যোগ নিয়েছেন এমনটা জানা নাই আমার। আমি জানলে আপনাকে অবশ্যই জানাবো।’

তবে একাধিক সূত্র চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছে, বিরোধ মেটানোর ব্যাপারে রেজাউল করিমের সঙ্গে কয়েক দফা আলাপ হয়েছে মহিউদ্দিন বাচ্চুর সঙ্গে। নগর এই যুবলীগের আহ্বায়ক কেন বিষয়টি অস্বীকার করছেন— এ নিয়ে অনেকে ‘রহস্য’ খুঁজে পাচ্ছেন। তাদের অনেকে মহিউদ্দিন বাচ্চুর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন।

নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকা বলেন, ‘আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল। কোনো বিরোধ নয় এটা। কিছু বিষয়ে আমাদের মনে হয়েছে সংগঠন ঠিকভাবে চলছে না। এখানে কোনো স্বার্থের ব্যাপার ছিল না। আমরা আগেও বলেছি যেসব বিষয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছিল, সেগুলো সমাধান হলে আমরা একসাথে রাজনীতি করবো। রেজাউল ভাই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সাথে আলাপ করেছেন। যদ্দুর জানি তিনি আহ্বায়কের সাথেও আলাপ করেছেন। আমরা উনাকে ঐক্যের বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছি।’

নিজেদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী হিসেবে দাবি করে খোকা বলেন, ‘আমরা একটানা প্রায় ১৫ বছর ধরে এক সাথে যুবলীগের রাজনীতি করছি। এই কমিটিতেই আমরা প্রায় ৭ বছর একসাথে আছি। গত এক বছর ধরে কিছু বিষয়ে আমাদের মনে হয়েছে সংগঠন তার গতি অনুযায়ী চলছে না। তাই আমরা বিকল্প পথে হেঁটেছি। এখন এটা ঠিক হলে আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করা ও সম্মেলন অনুষ্ঠিত করার বিষয়ে গুরুত্ব দেবো।’

সাত বছর আগে ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই নগর আওয়ামী লীগের আমৃত্যু সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী মহিউদ্দিন বাচ্চুকে আহ্বায়ক এবং দেলোয়ার হোসেন খোকা, দিদারুল আলম, ফরিদ মাহমুদ ও মাহবুবুল হক সুমনকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ১০১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় যুবলীগ।

তিন মাসের জন্য গঠিত ওই আহ্বায়ক কমিটি সাত বছর পার করলেও নগর যুবলীগের অন্য কোনো নেতা পাননি পদপদবির পরিচয়। নগর যুবলীগের এই পাঁচ শীর্ষ নেতার বিভক্তির প্রভাব আছে থানা এবং ওয়ার্ড পর্যায়েও। গত বছর লালদীঘিতে নগর যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি পণ্ড হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘ বিরোধের মধ্যে গত একমাসেই চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের দু দুটি আয়োজন পালিত হয়েছে আলাদা আলাদাভাবে। এর মধ্যে একটি আয়োজন নিয়ে উত্তেজনাও তৈরি হয়েছিল।

গত ১১ নভেম্বর নগরীর চট্টেশ্বরী রোডস্থ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভার আয়োজন করেন মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু। অন্যদিকে একই দিন বিকেলে একই কমিটির চার যুগ্ম আহ্বায়ক মিলে আলাদা আলোচনা সভার আয়োজন করেন স্টেশন রোডের সৈকত কনভেনশন হলে। এর আগেও চার যুগ্ম আহ্বায়ক মিলে মহিউদ্দিন বাচ্চুকে বাদ দিয়ে ২২ অক্টোবর আয়োজন করেন শেখ রাসেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। বিনা দাওয়াতে সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে হট্টগোলের চেষ্টা করেন মহিউদ্দিন বাচ্চু। এ সময় সভা সংক্ষিপ্ত করে সংঘাত এড়ানোর চেষ্টা করেন ফরিদ মাহমুদরা।

এই ধরনের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের জন্য মহিউদ্দিন বাচ্চুর একক ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা, সংগঠনের রীতি-নীতি লঙ্ঘন, আধিপত্য বিস্তার, পদ-পদবি ব্যবহার করে কৌশলে ক্ষমতার অপব্যবহারকে দায়ী করছেন বিদ্রোহী ৪ যুগ্ম আহবায়ক। অন্যদিকে মহিউদ্দিন বাচ্চু বলছেন, কেন কী জন্য এভাবে আলাদা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে সেটাই জানেন না তিনি।

এ বিষয়ে নগর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ফরিদ মাহমুদ সে সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেছিলেন, ‘নগর যুবলীগের আহ্বায়ক সাহেব দীর্ঘদিন যুবলীগের ব্যানারে নিজে নিজে কর্মসূচি পালন করেন। আমরা সেখানে দাওয়াত পাইনি। তাই যাইনি। এর আগেও আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন, আওয়ামী লীগের প্রয়াত প্রেসিডিয়াম সদস্য আতাউর রহমান খান কায়সারের মৃত্যুদিবসসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি।’

যুগ্ম আহ্বায়কদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেছিলেন, ‘দলীয় কর্মসূচির দাওয়াত পেয়েই আমি কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছি। আর আলাদা প্রোগ্রামের বিষয়টি হলো করোনায় আমি নিজ উদ্যোগে ত্রাণ দিয়েছি। দলের নির্দেশনাও ছিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। তখন অনেকেই ঘর থেকে বের হননি। আমার কর্মসূচিতে অংশ নিতে পারেননি। এটাতে আমি দোষের কিছু দেখি না।’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!