চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প কুমিল্লায় নিতে চান স্বাস্থ্যের ডিজি

চট্টগ্রামে জায়গা সংকটের অজুহাত

জায়গা স্বল্পতার অজুহাত দেখিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জন্য নেওয়া চারটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট নিজের এলাকা কুমিল্লায় সরিয়ে নিতে চান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি)। এমন সিদ্ধান্তের কথা জেনে ইতিমধ্যে চট্টগ্রামভিত্তিক কয়েকটি সংগঠন উদ্বেগ জানিয়েছে। তবে চট্টগ্রাম সফরে এসে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, স্বাস্থ্যের ডিজি কখনও সেভাবে বলেননি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে জায়গা সংকটের কথা বলা হলেও শুধু চট্টগ্রাম মেডিকেলেরই অন্তত ৮০০ কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হয়ে আছে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী গোয়াছি বাগান এলাকাতেই রয়েছে মেডিকেলের বিপুল পরিত্যক্ত জায়গা।

জানা গেছে, সরকারি সিদ্ধান্তে দেশের আটটি বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ‘নিউরোসায়েন্স, অর্থোপেডিক, মানসিক ও স্কিন ইউনিট স্থাপন’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নতুন করে চারটি ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই চারটি ইউনিট হল নিউরোসায়েন্স, অর্থোপেডিক, মানসিক ও স্কিন। এরই মাঝে এ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই সম্পন্ন হয়েছে। তবে এখনও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়নি।

এর আগে ৪ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রস্তাব দেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বদলে নতুন ওই চারটি ইউনিট কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। ওই সভায় প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথা উল্লেখ করে জানানো হয়, চট্টগ্রামসহ সিলেট ও ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে হাসপাতাল সম্প্রসারণের জন্য জায়গার সংকট রয়েছে।

কুমিল্লার বাসিন্দা ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সভায় জানান, চট্টগ্রাম মেডিকেলে নতুন ভবন স্থাপন করা হলে হাসপাতালে বাতাস চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া চট্টগ্রামে স্কিনের চিকিৎসার জন্য একটি আলাদা হাসপাতাল রয়েছে— এমন কথা উল্লেখ করে সভায় জানানো হয়, যেহেতু স্কিনের ওই হাসপাতাল সম্প্রসারণের জন্য জাইকার পক্ষ থেকে অর্থায়নের প্রস্তাব রয়েছে সে কারণে স্কিন ইউনিটটি চট্টগ্রাম মেডিকেলে না করলেও হবে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই সভায় আলোচনার প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিবর্তে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিউরোসায়েন্স, অর্থোপেডিক, মানসিক ও স্কিন ইউনিট স্থাপন করা যায় কিনা সেটা যাচাই করার সিদ্ধান্ত হয়।

চট্টগ্রামে জমি পাওয়া না গেলে কুমিল্লায় প্রকল্পটি বাস্তবায়নের বিষয়টি পরীক্ষা করা যেতে পারে বলে মতামত দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও।

তবে সোমবার (১০ অক্টোবর) বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রকল্প কুমিল্লায় স্থানান্তরের বিষয়ে বলেছেন, ‘এটা সত্য নয়। উনি (স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক) কখনও সেভাবে বলেন নেই। এই প্রজেক্টের ডিপিপির কাজ চলছে। যেটা চিটাগংয়ে হওয়া দরকার, সেটা চিটাগংয়েই হবে। যেটা কুমিল্লায় হওয়া দরকার, সেটা কুমিল্লায় হবে। তবে চট্টগ্রামে যখন কিছু করতে যাই, তখনই জমি-জমা অধিগ্রহণ নিয়ে অনেক সমস্যা হয়।’

জানা গেছে, এর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেলে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতালের জায়গা পাওয়া নিয়ে নানা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই ক্ষোভ থেকে চট্টগ্রামের প্রকল্প কুমিল্লায় স্থানান্তরের প্রস্তাবনা রেখেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। চট্টগ্রাম সফরে এসে দেওয়া বক্তব্যেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথায় এমন ইঙ্গিত ছিল।

জানা গেছে, জায়গা সংকটের কথা বলা হলেও অন্তত ৮০০ কোটি টাকার সম্পত্তি অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে উদ্ধার করতে পারছে না চট্টগ্রাম মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী গোয়াছি বাগান এলাকাতেই রয়েছে বিপুল পরিত্যক্ত জায়গা, যা বছরের পর বছর ধরে অবৈধ দখলদাররা ভোগ করে যাচ্ছে।

এদিকে চট্টগ্রামে জায়গা সংকটের কথা বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম তার নিজের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় প্রকল্প স্থানান্তরের খবরে উদ্বেগ প্রকাশ করে অবিলম্বে এ প্রস্তাব বাতিল করে চট্টগ্রামেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) চট্টগ্রাম বিভাগ ও মহানগর কমিটি।

সোমবার (১০ অক্টোবর) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে ক্যাব কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন, সাধারন সম্পাদক কাজী ইকবাল বাহার ছাবেরী, মহানগর সভাপতি জেসমিন সুলতানা পারু ও সাধারণ সম্পাদক অজয় মিত্র শংকু, দক্ষিন জেলা সভাপতি আবদুল মান্নান প্রমুখ এই দাবি জানিয়েছেন।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল শুধুমাত্র চট্টগ্রাম জেলার জন্য উচ্চতর চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান নয়। রেফারেল হাসপাতাল হিসাবে এটি এ অঞ্চলের বিশেষ করে কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলা, নোয়াখালী ও ফেনী জেলার সাধারন মানুষের জন্য সর্বশেষ আশ্রয়স্থল। তাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের উন্নয়ন মানে চট্টগ্রামের উন্নয়ন নয়। চট্টগ্রাম বিদ্বেষী কিছু মানুষের রোষানলে পড়ে, সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড চট্টগ্রামে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জায়গা সংকটের কথা বলে অন্যত্র এবং নিজের গ্রামের বাড়িতে এই প্রকল্প স্থানান্তরের হীন প্রচেষ্টা থেকে সরে আসতে হবে।

বিবৃতিতে নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটি এতদঞ্চলের চিকিৎসা ব্যবস্থায় একমাত্র ভরসাস্থল হবার কারণে প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার রোগী ভর্তি থাকেন। হাসপাতালে অপ্রতুল শয্যা সংখ্যা হলেও রোগীরা বারান্দায় ও মেঝেতে থেকে চিকিৎসা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। চট্টগ্রামের জরাজীর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বারবার প্রধানমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। তাই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজকে ঘিরে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ কোটি মানুষ উপকৃত হবে। একই সাথে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোসহ অনেক শিক্ষার্থীও প্রকল্প থেকে উপকৃত হতে পারবে।

বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের সভাপতি আমিনুল হক বাবুও চট্টগ্রামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দাবি জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলেন, ‘এই প্রস্তাবে মূল কারণ দেখানো হয়েছে জায়গার সংকট। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং মিথ্যাচার। বড় সড় জায়গা নিয়ে বাংলাদেশে যে কয়টি হাসপাতাল আছে তার মধ্যে চমেক হাসপাতাল অন্যতম। আমরা মনে করি, বর্তমানে চমেকের যে খালি জায়গা আছে তাতে নতুন ভবন করা সম্ভব। আমরা আশা করছি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে নজরে আনবেন এবং চট্টগ্রামেই এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চট্টগ্রামবাসীর আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত করবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm