চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে শত শত রোগী ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, ভর্তি-অপারেশন সবই বন্ধ

সাধারণ রোগীরা কোথায় যাবে?

ঘোষণা অনুযায়ীই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে জরুরি রোগী ছাড়া ওয়ার্ডে সাধারণ রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হল। বন্ধ হয়ে গেছে সব ধরনের রুটিন অপারেশনও। ইতিমধ্যে ভর্তি হওয়া রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়ারও হিড়িক পড়ে গেছে। তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ গাইনি ও সার্জারির জটিল অপারেশনের রোগীদেরও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে হাসপাতাল থেকে। গত সোমবার ও মঙ্গলবার দু্ই দিনে বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে এভাবে শত শত রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে বিদায় করা হয়েছে। হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীতে করোনাভাইরাস ঠেকানোর পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চলেরই প্রধান চিকিৎসাকেন্দ্র। চট্টগ্রামই শুধু নয়, আশেপাশের জেলাগুলো থেকেও এখানে বিভিন্ন রোগের রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। এই অঞ্চলের রোগীদের ভরসার সেই জায়গাটিই হঠাৎ করে সীমাবদ্ধ হয়ে গেল। অথচ সারা দেশের কোনো বিভাগীয় হাসপাতালেই চমেক হাসপাতালের মতো চিকিৎসাসেবা এভাবে সীমিত করা হয়নি বলে জানা গেছে।

এমন নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত নিয়ে সাধারণ রোগীরা তো বটেই, এমনকি চিকিৎসকরাও প্রশ্ন তুলেছেন— যে হাসপাতালে প্রতিদিন দুই হাজারের মত রোগী ভর্তি থাকে, সেসব রোগীর কী হবে? নন-কোভিড রোগীরা এই চট্টগ্রামের কোথায় যাবে চিকিৎসা করাতে?

যে কোভিড মোকাবেলার পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এমন সিদ্ধান্ত এসেছে, গত মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) পর্যন্ত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেই কোভিড রেডজোনে রোগী ভর্তি ছিলেন মাত্র ১৬৯ জন আর ইয়েলো জোনে মোটে ৭৫ জন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে শত শত রোগী ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে, ভর্তি-অপারেশন সবই বন্ধ 1

জানা গেছে, তিনদিন আগে শনিবার (১০ জুলাই) চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবীর ও উপ-পরিচালক ডা. আফতাবুল ইসলাম স্বাক্ষরিত অফিস আদেশ হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের পৌঁছানোর পর থেকে ভর্তি থাকা রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে। গাইনি ও সার্জারি বিভাগের জটিল অপারেশনের রোগী যারা দীর্ঘদিন সিরিয়ালে ছিলেন, তাদেরও ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

চমেক হাসপাতালের ওই অফিস আদেশে চারটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনা অনুযায়ী, কেবলমাত্র জরুরি রোগীদের ভর্তি ব্যতীত অন্যান্য রুটিন অপারেশন স্থগিত থাকবে। জরুরি রোগীদের ভর্তি করা হলেও বন্ধ থাকবে রুটিন ভর্তি। ইতিমধ্যে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে যারা জরুরি নন এবং দীর্ঘমেয়াদী রোগে আক্রান্ত তাদের আপাতত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও ব্যবস্থাপত্র দিয়ে বাড়িতে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হবে। সকল স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, নার্সিং কর্মকর্তা, কর্মচারী ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ডিউটিকালে মাস্ক পরিধান করা অত্যাবশ্যক বলে উল্লেখ করা হয়েছে ওই আদেশে।

কিন্তু গত দুদিনের সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, অফিস আদেশে বলা নির্দেশনাগুলোর অপব্যবহারই হচ্ছে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে। অনেক রোগী আগে ভর্তি হয়ে অপারেশনের জন্য নির্দিষ্ট তারিখও পেয়েছেন, অথচ তাদেরকেও ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এমনকি এই আদেশের আগে জটিল অপারেশনের রোগীদের অপারেশন সম্পন্ন হলেও তাদের ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ গাইনি ও সার্জারি ওয়ার্ডের রোগীদের অপারেশনের পর হাসপাতালে অবস্থান করেই পরবর্তী চিকিৎসা নিতে হয়। কিন্তু তাদেরও ছাড়পত্র দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে দেওয়া হচ্ছে ওয়ার্ড থেকে। গত দুদিনের লকডাউনে গাড়ি না পেয়ে অনেক রোগী হেঁটেই অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হন।

হাসপাতালের গাইনি ও সার্জারি ওয়ার্ডের একাধিক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই দুই বিভাগের ডাক্তারদের কোভিড ওয়ার্ডে কোনো কাজ নেই। মেডিসিন ওয়ার্ডের চিকিৎসকরাই এ ওয়ার্ডে মূলত কাজ করছেন। তাহলে রোগী ভর্তি ও রুটিন অপারেশন কেন বাদ রাখা হল?’

জানা গেছে, চমেক হাসপাতালে স্ত্রীরোগের চিকিৎসা নিতে গিয়ে স্ত্রীরোগীদের আগে থেকেই পড়তে হয় দীর্ঘ সিরিয়ালে। শুধুমাত্র অপারেশনে দেরি হওয়া কিংবা অপারেশন সফল না হওয়ায় স্ত্রীরোগে ভোগা অনেক রোগীকেই পড়তে হয় নতুন সমস্যায়। এর মধ্যে রুটিন অপারেশন বন্ধ হওয়ায় গত সোমবার ও মঙ্গলবার দু্ই দিনে গাইনি ওয়ার্ডের শতাধিক স্ত্রীরোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্ত্রীরোগ বিভাগ ৩১ নং ওয়ার্ড। প্রজনন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিলতার কারণে প্রায় প্রতিদিনই এখানে অসংখ্য রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। সেখানে শয্যা আছে মোটে ৬৪টি। কিন্তু প্রতিদিনই ১২০ থেকে ১৩০ জন রোগী ভর্তি থাকেন ওই ওয়ার্ডে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সূত্রে জানা গেছে, জরায়ুর সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে গাইনি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীদের অনির্দিষ্টকাল পর অপারেশন টেবিলে নিয়ে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এ রোগের অপারেশন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা উচিত বলে মনে করেন তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গাইনি ওয়ার্ডে অপারেশনের জন্য জুলাইয়ের চলতি সপ্তাহে অপারেশনের রোগীর সিরিয়াল ছিল ৩৫ জনের। কিন্তু নতুন অফিস আদেশ আসার পর তাদের অপারেশনের সিরিয়াল বাতিল করে ছাড়পত্র দিয়ে একে একে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

হাসপাতালের ১২ নং সিসিইউ ওয়ার্ডে সোমবার (১২ জুলাই) খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ওয়ার্ড থেকে সোমবার কেবল একদিনেই ৬৫ জন রোগীকে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে আরও ৬০ জন রোগীকে। প্রতিদিন এই ওয়ার্ডে রোগী ও তাদের স্বজনদের ভিড় লেগে থাকলেও রোববার (১১ জুলাই) অফিস আদেশের কথা জানাজানি হওয়ার পর দুপুর থেকেই ওয়ার্ডটি অনেকটাই ফাঁকা হয়ে যায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাধারণ রোগীদেরও ছাড়পত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়ায় হাসপাতালটিতে খালি পড়ে আছে অনেক বেড। গত দুইদিনে হাসপাতালের করোনা ইউনিট ছাড়া সার্জাারি, নিউরোসার্জারি, গাইনি, অর্থোপেডিক্স ও শিশু বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, ওয়ার্ডগুলোতে একের পর এক সিট খালি হয়ে যাচ্ছে। হাসপাতালের গাইনি বিভাগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডাক্তার জানান, পরিচালকের নতুন আদেশের পর থেকে রোগীদের ছাড়পত্র দেওয়ার হিড়িক পড়ে গেছে হাসপাতালে।

একই অবস্থা সার্জারি ওয়ার্ডেও। গলব্ল্যাডারে পাথর নিয়ে চট্টগ্রামের আনোয়ারা বটতলী থেকে ২৭ নম্বর সার্জারি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলেন নারায়ণ দাশ। ভর্তির সময় চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তার অপারেশন প্রয়োজন। কিন্তু সোমবার (১২ জুলাই) দুপুরে তাকেও চিকিৎসকরা ছাড়পত্র দিয়েছেন।

এ ব্যাপারে রোগীর ভাই গৌতম দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডাক্তাররা বলেছেন অপারেশন পরে করলেও হবে। আমার ভাইকে একমাসের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে তারপর হাসপাতালে আনতে বলেছেন ডাক্তাররা। অথচ ভর্তির দিনই ডাক্তার বলেছিলেন আমার ভাইয়ের তাড়াতাড়ি অপারেশন না করলে লিভারে সমস্যা হবে। লিভার ফুটো হয়ে যাবে। তাই ধারদেনা করে আমরা অপারেশন ও চিকিৎসার টাকা জোগাড় করে এনেছিলাম। এখন তাকে নিয়ে আমরা কোথায় যাব? আর হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আনোয়ারা যাবই বা কিভাবে?’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার (১১ জুলাই) হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তি ছিলেন মোট ৩৯৩ জন। নতুন ভর্তি ও পুরাতন রোগী মিলে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১ হাজার ৮৮৯ জন। আর একই দিন ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ৩৫২ জন রোগীকে।

পরদিন সোমবার (১২ জুলাই) নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৪৪ জন। এর বিপরীতে ওইদিনই ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে ৩৮৬ জন রোগীকে। এদিন হাসপাতালে মোট রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন ১ হাজার ৮১৪ জন।

সবশেষ মঙ্গলবার (১৩ জুলাই) রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন ১ হাজার ৮২৬ জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪৫ জন। আর ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে ৩৯৫ জন রোগীকে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেপুটি নার্সিং সুপারিনটেনডেন্ট ইলা দাশ জানান, আগে প্রতিদিন পুরো হাসপাতাল মিলে ৭০০ থেকে ৯০০ জন নতুন রোগী ভর্তি হতো। পুরো হাসপাতালে আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী চিকিৎসাধীন থাকতো। কিন্তু পরিচালকের নতুন আদেশের পর রোগী ভর্তি হচ্ছে কম। আর ছাড়পত্রও দেওয়া হচ্ছে বেশি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. আবুল বাশার মো. জামাল হোয়াটসঅ্যাপের কথোপকথনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবাও এভাবে সীমিত করার কথা বলা হয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। আমরা বিরোধিতা করেছি। আমাদের বক্তব্য ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সারা দেশ থেকে রোগী আসে। অন্তত এই হাসপাতাল কোভিডের পাশাপাশি নন-কোভিড রোগীদের জন্য রাখা হোক। না হলে নন-কোভিড রোগীরা কোথায় যাবে চিকিৎসা করাতে?’

তিনি বলেন, ‘এই করোনাকালেও আমরা নিয়মিত অপারেশন করে যাচ্ছি।’

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোভিডের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালে জরুরি রোগী ছাড়া ভর্তি ও রুটিন অপারেশন বন্ধ করার কোনো মানে হয় না। হাসপাতালে প্রতিদিন দুই হাজারের মত রোগী ভর্তি থাকে। এসব রোগীর কী হবে? তাদের জোর করে ছাড়পত্র দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত কয়েকদিন লকডাউনে যানবাহনের ব্যবস্থাও ছিল না। কী অসহনীয় দুর্ভোগ রোগীদের— বুঝিয়ে বলা যাবে না।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবীর সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতি সম্পর্কে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘হাসপাতালে করোনা রোগীর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য যা করতে হয় তাই করেছি আমি। করোনারোগীর চিকিৎসার জন্য হাসপাতালের অনান্য চিকিৎসাসেবা বন্ধ রাখতে হলে সেটাই করবো।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!