চট্টগ্রাম মেডিকেল ক্যান্টিনে চার লাখ টাকা বকেয়া রেখে ছাত্রলীগ নেতারা আত্মগোপনে
টাকা চাইলে মার খেতেন ক্যান্টিন মালিক
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসের ক্যান্টিন ‘বেলাল স্মৃতি মেস’। ২০০৭ থেকে এ ক্যান্টিনের দায়িত্বভার নেন মো. রফিকুল ইসলাম। কিন্তু মেস থেকে আয় করে লাভের চেয়ে ক্ষতির পাল্লা ভারী হয়েছে তার। এ পর্যন্ত তার বাকির খাতায় উঠেছে চার লাখ টাকার বেশি। গত পাঁচ বছরেই বেড়েছে টাকার পরিমাণ। এসব টাকার বেশিরভাগই ছাত্রলীগ নেতাদের কাছ থেকে পাওনা। বিভিন্ন সময়ে খাবার খেয়ে টাকা না দিয়ে চলে যেতো ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। টাকা চাওয়ায় ছাত্রলীগ নেতাদের মারধরের শিকারও হন রফিকুল।
তবে শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির পর ছাত্রলীগ নেতারা আত্মগোপনে চলে গেছে রফিকুলের বাকি টাকা আদায়ও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
রফিকের ভাষ্য মতে, বাকিখোরদের দলে ছিল প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ জন। তবে নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের নাম বলতে চাননি তিনি।
বৃহস্পতিবার (৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরীর চট্টেশ্বরীর প্রধান ছাত্রাবাসে গেলে কথা হয় ক্যান্টিনের ব্যবস্থাপক রফিকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৭ সালে তিনি ক্যান্টিন পরিচালনার দায়িত্ব নেন। গ্রাহক ছিল এমবিবিএস ৪৬ তম ব্যাচ থেকে ৬২তম ব্যাচ এই সময়ের ছাত্ররা। এই ১৭ বছরে ক্যান্টিনে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা খেয়ে বিল পরিশোধ না করায় বকেয়া জমেছে ৪ লাখ টাকার ওপরে।
রফিক বলেন, এর মধ্যে ২০২৩ সালে বকেয়া বিলের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। ওই এক বছরে ছাত্রলীগের বাকির খাতায় লিখিয়েছে আড়াই লাখ টাকা।
জানা গেছে, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রতিদিন খাওয়ার বিল পরিশোধ না করলেও সব ভালো খাবারগুলো তারা রুমে নিয়ে যেতো। ৪৫ থেকে ৫০ জন বাকিখোরদের দলে ছিল। প্রতিদিন সকালে খিচুড়ি, ডিম ওমলেট পাওয়া যায় ক্যান্টিনে, দাম ৪৫ টাকা। দুপুরের মেন্যুতে ফার্মের মুরগি, ভাত, ডাল, সবজির প্যাকেজ দাম নির্ধারিত ছিল ৮০ টাকা। দেশি মুরগি থাকলে দাম ৯০ টাকা। আর প্যাকেজে গরুর মাংস থাকলে দাম পড়ে ১০০ টাকা। সপ্তাহে পোলাও শুক্রবার ও খিচুড়ি নির্ধারিত রয়েছে মঙ্গলবার। এরসঙ্গে মাছ, সবজি, ভাত মিলে প্যাকেজ ৭০ টাকা।
আরও জানা গেছে, ক্যান্টিনে খাবার দেওয়া শুরু হয় সকাল ৭টা থেকে ১০টা , দুপুরে সাড়ে ১২টা থেকে আড়াইটা ও রাতে ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। কিন্তু ছাত্রলীগ নেতারা নির্ধারিত সময়ের আগেই মেসে এসে রান্নাঘর থেকেই রান্না করা ভালো খাবারগুলো নিয়ে রুমে চলে যেত। পোলাও, গরুর মাংস কখনোই ছাত্রাবাসের সাধারণ ছাত্রদের কপালে জুটত না। বিল চাইলে ছাত্রলীগ নেতারা বলত, ‘টাকা তো দিবই। না দিয়ে থাকব নাকি?’ দুই-তিন মাস পর পর এক-দেড় হাজার টাকা দিয়ে পুনরায় বাকির খাতায় নাম লিখাতো এরা।
বাকি টাকা আদায় প্রসঙ্গে ক্যান্টিনের ব্যবস্থাপক রফিক বলেন, ‘যারা বাকি খেয়েছে, তারা জানে কত টাকা বাকি খেয়েছে। আমি গরিব মানুষ। ক্যান্টিনে ব্যবসা করে সংসার চালাই। আমার টাকা যদি পরিশোধ করে আলহামদুলিল্লাহ। না দিলেও আলহামদুলিল্লাহ। কারণ আমি প্রতিবাদ করতে পারব না। আমাকে রাস্তাঘাটে মেরে ফেলে রাখবে। তাই আমি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে রাখছি।’
টাকা চাইলে করতো মারধর
জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৩১ জুলাই ছাত্রলীগের একাংশের নেতা আসেফ বিন তাকির বেধড়ক পেটান রফিককে। বাকি টাকা চাওয়ার কারণেই এভাবে মারধর করা হয় তাকে। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ডা. সাহেনা আক্তারের কাছে লিখিত অভিযোগে রফিক ‘চাঁদা না দেওয়ায়’ তাকে মারধর করা হয় বলে উল্লেখ করেন। তাকির তখন হাসপাতালের ইন্টার্ন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন।
এভাবে আরও দু’বার টাকা চাইতে গিয়ে মারধরের শিকার হন রফিকুল।
এদিকে সরেজমিন ছাত্রাবাসে দেখা গেছে, সাধারণ ছাত্ররা তাদের পছন্দমতো খাবার নিয়ে খেতে পারছেন। বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বাকি খাওয়া বন্ধ ঘোষণা করেছে কলেজ প্রশাসন। কলেজ থেকে ছাত্রবাসে ভুর্তকির ব্যবস্থা করা হবে। এতে খাবারের মূল্য তালিকা কম রাখা হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হাবিব হাসান বলেন, ‘আমরা ছাত্র ও ক্যান্টিন ব্যবস্থাপক রফিককে নিয়ে একটা কমিটি করে দিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে কমিটির একেকজন রফিকের সঙ্গে বাজার করতে যাবে। তাহলে বাজারদরের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে। কমিটির সুপারিশ মোতাবেক খাদ্য তালিকার থাকা খাবারের দাম নির্ধারণ করা হবে। কলেজ থেকে ক্যান্টিনে ভর্তুকি দেওয়া হবে। যাতে খাবারের মান ভালো হয়। আর কোনোভাবেই ছাত্ররা ক্যান্টিনে বাকি খেতে পারবে না।
ডিজে