চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্লিপটাই সরকারি, আর সবই ‘গলাকাটা’ বেসরকারি

অত্যাধুনিক ল্যাব থাকলেও সে খবর জানানো হয় না রোগীদের

1

চট্টগ্রামের প্রধান সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের আউটডোরে ১০ টাকা মূল্যের টিকেটে ডাক্তার দেখিয়ে শুধু প্রেসক্রিপশনটাই পান রোগীরা। আর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেতে হয় উচ্চমূল্যের বেসরকারি ল্যাবে। অথচ সরকারি এই হাসপাতালে রয়েছে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার অত্যাধুনিক ল্যাব। হাজার টাকার এক্সরে এই ল্যাবে করানো যায় সর্বনিম্ন ২০০ টাকায়। কিন্তু রোগীরা এই ল্যাবের খবরই জানেন না। জানলেও তার আগেই দালালের খপ্পরে পড়ে চলে যেতে হয় বেসরকারি ল্যাবে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোরে (বহির্বিভাগ) ১০ টাকার টিকিট বিক্রি শুরু হয় সকাল ৮টা থেকে। সেটা চলে দুপুর ১টা পর্যন্ত। হাসপাতালের পশ্চিম পাশে নতুন বিল্ডিংয়ের নিচতলা, দোতলা ও তিনতলায় বিভিন্ন বিভাগের বর্হিবিভাগ। তবে রোগীর ভিড় বেশি থাকে নিচতলাতেই।

রোগীদের অভিযোগ, ১০ টাকা মূল্যের টিকেটে ডাক্তারকে দেখিয়ে শুধু প্রেসক্রিপশনটাই নেওয়া হয়। আর সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য যেতে হয় ল্যাবে। কারণ হাসপাতালে নতুন ভবনের চারতলায় যে আধুনিক ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি ল্যাবে রোগীদের সব পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ রয়েছে— এই তথ্য বেশিরভাগ রোগীই জানেন না। আবার সরকারি ওই ল্যাবের খবর জানাতে হাসপাতাল সংশ্লিষ্টদেরও উদ্দেশ্যমূলক অনীহা দেখা যায়। ফলে রোগী আউটডোরের ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হতেই পড়তে হয় হাসপাতালের আউটসোসিং কর্মী, দালাল ও ল্যাব এজেন্টদের খপ্পরে। সরকারি হাসপাতালে এসেও এদের খপ্পরে পড়ে প্রাইভেট বা বেসরকারি চিকিৎসা খরচের মতোই খরচ হয় রোগীদের।

s alam president – mobile

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এসএম হুমায়ুন কবীর মুঠোফোনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আমি হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ড ও বর্হিবিভাগে প্যাথলজি ওয়ার্ডের পরীক্ষা-নিরীক্ষার দামসহ তথ্য টাঙ্গিয়ে রাখার জন্য চিঠি দিয়েছি। তারপরও কেন সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না সেটি আমি খোঁজ নেবো।

গত সোমবার (১৪ জুন) সকাল সাড়ে দশটা থেকে দুপুর ১টা। সাড়ে তিন ঘন্টার অবস্থানে দেখা গেল— ১০ টাকার একটি টিকিট সরকারি সাশ্রয়ী মূল্যে কিনে রোগীকে বাকি সবকিছুর জন্যই যেতে হচ্ছে বেসরকারি ল্যাবে।

গার্মেন্টসকর্মী হাজেরা খাতুন এসেছিলেন রাহাত্তারপুল থেকে। জ্বর ও কাশির সমস্যা তার। বর্হিবিভাগের বাইরে জ্বর ও কাশির রোগীদের জন্য আলাদা কর্নার করা হয়েছে। সেখান থেকে হাজেরা বের হলেন সকাল ১১টা ১০ মিনিটে। ডাক্তার তাকে কফ পরীক্ষা করতে দিয়েছেন। সঙ্গে আরও কয়েকটি রক্ত পরীক্ষা। তবে বর্হিবিভাগের চিকিৎসক এসব পরীক্ষা করতে তার পছন্দের ল্যাবের কথা বলে দিয়েছেন হাজেরাকে। গেটেই যেন অপেক্ষায় ছিলেন আউটসোর্সিং কর্মী প্রদীপ। বেলা সাড়ে ১১টায় হাজেরাকে তিনি পাঠিয়ে দিলেন নগরীর বেসরকারি ল্যাব শেভরনে।

Yakub Group

গেট থেকে প্রদীপ একটা হিসেব দিয়ে দিলেন হাজেরাকে— টেস্ট করতে ১৬০০ থেকে ১৭০০ টাকা লাগবে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের পুরোনো বিল্ডিংয়ের তিনতলার রেডিওলজি বিভাগে বুকের এক্সরে করার সুযোগ থাকলেও হাজেরাকে সেটা করতে যেতে হল বেসরকারি ল্যাবে। হাজেরার জানাই ছিল না যে, চমেক হাসপাতালেই বুকের এক্সরে পরীক্ষাটি মাত্র ২০০ থেকে ৪৫০ টাকার মধ্যে করানো যায়। বেসরকাবি ল্যাবে যা করাতে খরচ পড়ে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে হাজেরার মতো এরকম শত শত রোগী প্রতিদিনই ১০ টাকার সরকারি স্লিপ কেটে ডাক্তার দেখিয়ে বেসরকারি ল্যাবের খরচে পড়ে যান। সরকারি হাসপাতালে এসেও খরচ পড়ে যায় প্রাইভেট চেম্বারে গিয়ে চিকিৎসক দেখানোর মতোই।

চমেক হাসপাতালের নতুন বিল্ডিংয়ের ৪ তলায় প্যাথলজি ও হেমোটোলজি ল্যাব। সেখানে রক্ত ও ইউরিনসহ নানা রকম পরীক্ষার সুযোগ আছে কম খরচে। অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধায় সেখানে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষার সুযোগও রয়েছে। কিন্তু রোগী বহির্বিভাগ থেকে চারতলার এই প্যাথলজিক্যাল ল্যাবের খবর পান না।

জানা যায়, কোন্ পরীক্ষা কোথায় করা হয় তার তথ্যসম্বলিত একটি তালিকা টাঙ্গানো আছে প্যাথলজিতে। কিন্তু ওই ল্যাবের কোনো তথ্যতালিকা বর্হিবিভাগে টাঙ্গানো নেই।

চারতলায় টাঙ্গানো তথ্যতালিকা অনুযায়ী ব্লাড ব্যাংক রয়েছে পুরাতন বিল্ডিংয়ের নিচতলায়, এক্সরে ও সিটি স্ক্যান পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে পুরাতন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় ১৫ নং ওয়ার্ডে, আলট্রাসনোগ্রাম পরীক্ষা করা যায় পুরাতন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় ১৫ নং ওয়ার্ডে পরমাণু কেন্দ্র লাল বিল্ডিংয়ে, ইসিজি পরীক্ষা হয় নতুন বহির্বিভাগ ভবনের নিচতলায়, হরমোন পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে পরমাণু কেন্দ্র লাল বিল্ডিংয়ে, এন্ডোসকপি পরীক্ষা করানো যায় ১৬ নং ওয়ার্ডের সামনে পুরাতন বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায়, ইকো পরীক্ষা হয় পুরাতন বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয় তলায় ১২ নং ওয়ার্ডে, ডটস কর্নার ও মেডিসিন স্টোর রয়েছে ব্লাড ব্যাংকের সামনে পুরাতন বিল্ডিংয়ের নিচতলায়।

দেখা গেছে, বহির্বিভাগ ও আন্তবিভাগের রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চমেক হাসপাতালে উন্নত সুবিধা থাকলেও শুধুমাত্র তথ্য না জানা কারণে নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি ল্যাবের কর্মীরা হাসপাতালে উপস্থিত থেকে তাদের ল্যাবে নিয়ে গিয়ে গলাকাটা অর্থ আদায় করছেন।

বর্হিবিভাগের ঠিক গেটের কাছেই সকাল আটটা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকে জেনেটিক ল্যাবের টেকনিশিয়ান আলাউদ্দিন। গায়ে তার সাদা শার্ট। এই পোশাকেই তাকে চেনা যায়। আলাউদ্দিন তার আসল নাম হলেও তার রয়েছে কয়েকটি ছদ্মনামও।

গত সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় আলাউদ্দিনের কথোপকথন খেয়াল করে শোনা গেল তিনি রোগীকে বলছেন, ‘তাকে গেটে সাদা শার্ট পরা অবস্থায় তাকে দেখলেই যেন চেনে। গেটের মাঝখানেই তিনি দাঁড়িয়ে আছেন— এ কথাও বলতে শোনা গেল তাকে।

চমেক হাসপাতালের বহির্বিভাগে এমনিতেই রোগীদের হট্টগোল থাকে। তবে বেশি হট্টগোল শোনা যায় রোগীকে নিয়ে টানাহেঁচড়াতে। হাসপাতালে নিয়োগপ্রাপ্ত আউটসোর্সিং কর্মী, দালাল, ল্যাবের এজেন্টরা ডাক্তার থেকে দেওয়া রোগীর ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশিকা সম্বলিত কাগজ হাতে নিয়ে রোগীকে বোঝাতে থাকেন। রোগী বুঝতে না চাইলেই শুরু হয় টানাটানি। শনিবার থেকে বৃহস্পতিবার বর্হিবিভাগের বিভিন্ন বিভাগের সামনে এমন দৃশ্য চোখ পাতলেই দেখা যায়।

২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীনস্থ চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল চট্টগ্রাম কার্যালয়ে ১০৯ জন আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগ করা হয়। এই ১০৯ জনের মধ্যে অফিস সহকারী ৭৫ জন, পরিচ্ছন্নকর্মী ২৯ ও বাবুর্চি রয়েছে ৭ জন।

২৮ নং নিউরো সার্জারি ওয়ার্ডের একজন সিনিয়র নার্স নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল হাসপাতালে রোগী ও হাসপাতালের কার্যক্রমে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা আনার জন্য। কিন্তু এ আউটসোর্সিংই এখন আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরাই দালাল ও ল্যাবের এজেন্টদের হাতে রোগীদের তুলে দিয়ে চিকিৎসা খরচ বাড়িয়ে রোগীকে ভোগান্তিতে ফেলে। রোগী ভর্তি হওয়ার পরপরই কাছে থাকা সব টাকা খরচ করে ফেলতে বাধ্য হয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!