চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্ট্রোকের রোগীর করুণ দশা, কমিশন নিয়ে সিটিস্ক্যান হয় প্রাইভেট ল্যাবে

ল্যাবের ‘কমিশন’ খেতে ডাক্তারদের প্রতিযোগিতা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিটিস্ক্যান করাতে গিয়ে প্রতিদিনই ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে স্ট্রোকের রোগীদের। মেডিকেলের রেডিওলজি বিভাগে সিটিস্ক্যান করানোর মেশিন থাকলেও রোগীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাইরের ল্যাবে। এতে টানা-হেঁচড়া করতে করতেই রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। আর এভাবে রোগী বিভিন্ন ল্যাবে পাঠিয়ে ‘কমিশন’ পকেটে ভরেন দায়িত্বরত ডাক্তাররা। আবার মেডিকেলে সিটিস্ক্যান করানো হলেও রিপোর্ট পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। ফলে স্ট্রোকের রোগীর চিকিৎসা পেতে পেতে অবস্থার আরও অবনতি হয়।

জানা গেছে, কোনো রোগী অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে এলে এর কারণ খুঁজতে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেন ডাক্তাররা। রোগ নির্ণয়ের জন্য করতে দেন সিটিস্ক্যান। কিন্তু সিটিস্ক্যানের জন্য ওয়ার্ডের সংশ্লিষ্ট সহকারী রেজিস্ট্রার তাদের পছন্দের ল্যাবে পাঠান রোগীকে। এরপর অজ্ঞান স্ট্রোকের রোগীকে টেনে-হিঁচড়ে স্ট্রেচারে করে লিফটে নিচে নামিয়ে তোলা হয় অ্যাম্বুলেন্সে। সেখান থেকে ল্যাবে নিতে নিতে রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়।

সিটিস্ক্যান রিপোর্টে ব্রেন স্ট্রোকের বিষয় নিশ্চিত হলে পাঠানো হয় ১৮ নম্বর নিউরোলজি ওয়ার্ডে। যদি রোগীর মাথায় রক্তক্ষরণের বিষয় নিশ্চিত হয়, তাহলে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয় নিউরোসার্জারি বিভাগে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. খুরশিদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অনেকে স্ট্রোককে হৃদরোগ মনে করলেও এটি মূলত মস্তিষ্কের রোগ। অজ্ঞান রোগী ওসেকে (ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি কেয়ার) নিয়ে আসলে ডাক্তার সমস্যা ইভাল্যুয়েট করেন, রোগীর হিস্ট্রি নেন। অনেক সময় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সরাসরি ২৮ অথবা ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দেন। তা না হলে পাঠানো হয় মেডিসিন ওয়ার্ডে। সেখান থেকে পরীক্ষার পর সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে পাঠানো হয়।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, কমিশন খেতে কোন্ সহকারী রেজিস্ট্রার কত দ্রুত পছন্দের ল্যাবে স্ট্রোকের রোগী পাঠাবেন—এ নিয়ে চলে রীতিমতো প্রতিযোগিতা। এরপর রোগীর রিপোর্ট এলে চিকিৎসা শুরু করতেও সময়ক্ষেপণ করেন ডাক্তাররা।

অথচ চট্টগ্রাম মেডিকেলে তৃতীয় তলার রেডিওলজি বিভাগে মাত্র ২ হাজার টাকায় করা যায় সিটিস্ক্যান। যেটি রিপোর্টসহ বেসরকারি ল্যাবে করাতে গেলে খরচ পড়ে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। বেসরকারি ল্যাবগুলোতে প্রতিদিন সিটিস্ক্যানের রোগীদের ভিড় লেগে থাকে। এসব রোগীর প্রায় অর্ধেকই যান চট্টগ্রাম মেডিকেল থেকে। সেই তুলনায় মেডিকেলে প্রতিদিন ১০ জন রোগীকেও সিটিস্ক্যান করানো হয় না।

মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে ১৮৯ জন। মস্তিষ্কে রক্তজমাট ও রক্তক্ষরণ হওয়া অপারেশন রোগী রয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ জন। তবে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী কয়েকটি ওয়ার্ড থেকে এই ওয়ার্ডে পাঠানো হয়।

১৮ নম্বর নিউরোলজি ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি আছে ১১৩ জন। মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছে ২১ জন। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে স্ট্রোকের রোগী এসেছে ৭ জন। ১৩ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে ৩ জন, ১৪ নম্বর থেকে ২ জন, ১২ নম্বর থেকে ১ জন রোগী এসেছে।

১৬ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ড সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (৬ ফেব্রুয়ারি) এই ওয়ার্ডে স্ট্রোকের রোগী ভর্তি হয়েছে ৪ জন।

এই চারজনের একজন মিরসরাইয়ের বাসিন্দা সুবল। সোমবার ভর্তির পর পরই তাকে সিটিস্ক্যান করতে বলা হয়। পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে তার সিটিস্ক্যান করিয়ে এনেছেন ছেলে সুজিত। সিটিস্ক্যান রিপোর্ট দেখে চিকিৎসকরা মঙ্গলবার জানান, বুধবার তাকে ১৮ নম্বর নিউরোলজিতে পাঠানো হবে। সুবল এখনও অচেতন, তাকে অক্সিজেন দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার দুপুর আড়াইটার দিকে একটি প্রাইভেট ল্যাবের আ্যাম্বুলেন্সে দেখা যায় খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা থেকে আসা সত্তরোর্ধ্ব রোকেয়া বেগমকে। আ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন তিনি।

আ্যাম্বুলেন্সে থাকা রোকেয়া বেগমের ছেলে মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘সোমবার রাত ৮টায় মা হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে যান। স্থানীয় হাসপাতালের ডাক্তার সম্ভাব্য স্ট্রোকের কথা জানিয়ে মাকে খাগড়াছড়ি অথবা চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। মঙ্গলবার সকাল ১১টায় মাকে চট্টগ্রাম মেডিকেলের আনলে সেখানে ঘণ্টাদেড়েক রাখার পর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে পাঠানো হয়। সেখানে সিট না পেয়ে দুই ঘণ্টা ওয়ার্ডের মেঝেতে শুইয়ে রাখা হয়। তারপর ওয়ার্ডবয়ের হাতে কিছু টাকা গুজে দিলে সিটে তুলে দেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘পরে চিকিৎসক এসে মাকে দেখে সিটিস্ক্যান করাতে বলেন। প্রাইভেট ল্যাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্যাডে লিখে দেন ওয়ার্ডের কর্তব্যরত ডাক্তার।’

চট্টগ্রাম মেডিকেলের রেডিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সুভাষ মজুমদারের কাছে সিটিস্ক্যানের রোগী কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় রোগীর চাপের কারণে রেডিওলজি বিভাগে সিটিস্ক্যান করাতে গেলে রিপোর্ট দিতে আমাদের দেরি হয়। কিন্তু স্ট্রোকের রোগীদের তাৎক্ষণিক রিপোর্ট দরকার।’

২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডের বিভাগীয় প্রধান ডা. রবিউল করিমের কাছে এই বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm