চট্টগ্রাম মেডিকেলে সহপাঠী পিটিয়ে বিজয় উল্লাসের পাল্টায় আকিবের মাথায় চলে ক্ষুর

‘নাড়িভুঁড়ি বাইর’ করার হুমকিও ছিল ফেসবুকে

আগের রাতেই দুই সহপাঠীকে মেরে রক্তাক্ত করার পর ‘বিজয়’ উদযাপন করার অংশ হিসেবে ফেসবুকে হুমকি দিয়ে ছবি পোস্ট করেছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) ছাত্রলীগ একাংশের কর্মীরা। ‘বিজয়ী’ হয়ে প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে তারা হুঁশিয়ারিও দিয়েছিলেন পরেরবার ‘নাড়িভুঁড়ি বাইর’ করে দেওয়ারও।

এর কয়েক ঘন্টা না পেরোতেই ‘পরাজিত’ সেই প্রতিপক্ষের হামলায় গুরুতর আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেরই আইসিইউ ওয়ার্ডে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আগের দিন সহপাঠীকে রক্তাক্ত করে ‘বিজয় উল্লাস’ করা শিক্ষার্থীদেরই একজন। নির্মমভাবে পিটিয়ে ভাঙা কাঁচের বোতল ও ক্ষুর দিয়ে ছুরির আঘাত করা হয় মাহাদী জে আকিব নামের ওই শিক্ষার্থীর মাথায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মতো একটি বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেধাবী শিক্ষার্থীদের এমন মরণখেলায় মেতে ওঠা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বিগ্ন চট্টগ্রামের সচেতন নাগরিকরা। হতাশার কথা বলছেন বিবাদমান দুই পক্ষের সিনিয়র নেতারাও।

জানা গেছে, গত ২৯ অক্টোবর রাতে অতর্কিতভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীদের ওপর হামলা করে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারীরা। এ সময় নাইমুল ও মাহফুজ নামে দুই ছাত্রলীগকর্মী আহত হন। আহত হয়ে চমেক হাসপাতালের স্টুডেন্ট কর্নারে ভর্তি হন তারা। তারা যখন আহত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন, ঠিক ওই সময় তাদের কক্ষে বেপরোয়া ভাংচুর চালায় প্রতিপক্ষ গ্রুপের কর্মীরা।

সেই হামলার পর সম্মিলিতভাবে ভিক্টোরি বা বিজয়সূচক চিহ্ন দেখিয়ে ফেসবুকে ‘বিজয় উল্লাস’ করেন শিক্ষা উপমন্ত্রীর অনুসারীরা। এছাড়াও ‘পরাজিত’ প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে নানা হুঁশিয়ারিসহ তীর্যক মন্তব্যও ফেসবুকে পোস্ট করেন তারা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এসব পোস্টের বেশ কিছু স্ক্রিনশট চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে আহত হয়ে আইসিইউতে থাকা মাহাদী জে আকিবও এসব ছবিতে ছিলেন— এমনটাই দেখা গেছে।

শনিবার (২৯ অক্টোবর) প্রথম হামলার পর দিবাগত রাত ১টার দিকে সাজেদুল ইসলাম হৃদয় নামে একজন ফেসবুক সেবা ‘মাই ডে’তে প্রতিপক্ষকে উদ্দেশ্য করে লিখেন, ‘ফেসবুকে চাপা না মারাইয়া হাসপাতালে যাও। জুনিয়র দুইটার খেয়াল রাখো। পরেরবার নিজের নাড়িভুঁড়ি বাইর হই গেলে কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না চর্বি ভাইয়া।’

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিবাদমান গ্রুপের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার রাতের সেই ঘটনার মীমাংসা করতে পরদিন(৩০ অক্টোবর) সকালে দুই গ্রুপের নেতাদের নিজের কক্ষে ডাকেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. সাহেনা আক্তার। ওই সময়ে ৬২ ব্যাচের আরও কয়েকজনসহ ক্যাম্পাসে ছিলেন মাহাদী জে আকিব। ঠিক সেই সময় আগের রাতের হামলার শোধ নিতে তাদের ধাওয়া করে আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা। দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় একপর্যায়ে সিএনজির সাথে ধাক্কা লেগে রাস্তায় পড়ে যান আকিব। এ সময় তাকে ঘিরে ধরে বেধড়ক মারধর করে আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারীরা। আকিবের রাজনৈতিক সহকর্মীদের অভিযোগ, তাকে কাঁচের ভাঙ্গা বোতল দিয়ে মাথায় উপর্যুপরি আঘাত করার পাশাপাশি ক্ষুর দিয়েও আঘাত করা হয়।

হামলায় গুরুতর আহত হলে তাৎক্ষণিক মস্তিস্কে অপারেশন করতে হয় আকিবের। এরপরই তাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে আইসিইউতে রাখা হয়। একদিন পর রোববার (৩১ অক্টোবর) তার ভেন্টিলেটর সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের এমন যুদ্ধংদেহী অবস্থান অবাক করেছে চট্টগ্রামের সকল স্তরের মানুষকেই। আর এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, কী কারণে হঠাৎই এমন উত্তপ্ত হয়ে উঠল এই ক্যাম্পাসের পরিবেশ?

এ নিয়ে অনেকেই অনেক অভিমত ব্যক্তিগতভাবে জানালেও চলমান পরিস্থিতিতে এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্য কথা বলতে রাজি হচ্ছেন না কেউই।

এদিকে গুরুতর অবস্থায় আইসিইউতে চিকিৎসাধীন থাকা আকিবের ভেন্টিলেটর সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন নিউরোসার্জন ডা. ছানাউল্লাহ শামীম।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে এই নিউরোসার্জন বলেন, ‘আকিবের যে ধরনের কন্ডিশন ছিল, সেই ধরনের রোগীর অপারেশনের সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ ৪ ঘন্টার মধ্যে নিতে হয়। ভাগ্যক্রমে আমরা আড়াই ঘন্টার মধ্যেই অপারেশন শুরু করতে পেরেছিলাম। পরে তাকে ভেন্টিলেটর সাপোর্টে রাখা হয়। রোববার (৩১ অক্টোবর) সকালে তার ভেন্টিলেটর সাপোর্ট সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। আমরা আশা করছি আস্তে আস্তে সে সুস্থ হয়ে উঠবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!