চট্টগ্রাম মেডিকেলে ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ রোগীদের কাজে আসে সামান্যই
অনুদানের ৩০ লাখ টাকার সদ্ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন ডাক্তারদেরই
গরিব রোগীদের কল্যাণ করাই ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’র কাজ। কিন্তু বেশিরভাগ রোগীই জানেন না, এই রকম কোনো সংগঠন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আছে। হাতেগোনা কিছু রোগী এই সমিতিতে গেলেও মাত্র ওষুধের এক-তৃতীয়াংশ খরচ পান। বাকিটা বহন করতে হয় রোগীকে। এছাড়া মেডিকেলের স্টোরে সাধারণ রোগীরা ওষুধ আনতে গেলে কয়েকটি দিয়ে বেশিরভাগ ওষুধের নামের পাশে লাল ক্রস দিয়ে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোর বিস্ফোরণে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের জন্য অনুদান হিসেবে পাওয়া ৩০ লাখ টাকা সমিতিকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এইরকম খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা ‘অর্ধমৃত’ একটি সমিতির হাতে এতগুলো টাকা দেওয়াটা কতটুকু যৌক্তিক, সেই প্রশ্ন তুলেছেন একাধিক চিকিৎসক।
হাসপাতালের কয়েকজন চিকিৎসক জানান, হাতেগোনা কয়েকজন রোগী সমিতি থেকে সেবা হিসেবে পান এক-তৃতীয়াংশ ওষুধের খরচ। এত বড় অংকের টাকা তাদের হাতে তুলে না দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজ দায়িত্বে টাকাটা গরিবদের জন্য বণ্টন করলে অসহায় রোগী উপকৃত হতো। প্রয়োজনে অনুদানের অর্থ হাসপাতাল থেকে একটা ফান্ড গঠন করে সেখান থেকে পরিচালনা করা যেতো।
জানা যায়, সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পরিচালিত হচ্ছে এই রোগী কল্যাণ সমিতি। ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৩ লাখ টাকা সরকার অনুদান দিয়েছে এই সমিতিকে। আর যাকাত ও দান থেকে সংগ্রহ হয়েছে ১ কোটি ৩০ লাখ ২১ হাজার ৯৯৬ টাকা। এখান থেকে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৭২ লাখ ৩১ হাজার ৪৮৪ টাকা। সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ২৬ হাজার ৪৯২ জন।
এছাড়া ২০২০-২০২১ অর্থবছরে পেয়েছিল ১ কোটি ২০ লাখ ১৫ হাজার ৩৭৯ টাকা। ব্যয় দেখানো হয়েছে ৮২ লাখ ৮৬ হাজার ৭৮৬ টাকা। সেবা গ্রহণকারীর সংখ্যা দেখানো হয়েছে ১৯ হাজার ৭৪৮ জন।
রোগী কল্যাণ সমিতির দায়িত্বে আছেন সমাজসেবা কর্মকর্তা অভিজিৎ সাহা। তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যেসব গরিব রোগী ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ কিনতে পারেন না, তাদের বাছাই করে ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্টার পাঠিয়ে দেন রোগী কল্যাণ সমিতির অফিসে। সেখান থেকে ফরম নিয়ে সংশ্লিষ্ট সেই রোগী আবারও রেজিস্ট্রারের কাছে যান। তখন ডাক্তার রোগীর কী কী ওষুধ ও টেস্ট প্রয়োজন তা লিখে দেন ফরমে। এরপর সেই স্লিপ নিয়ে রোগী যান হাসপাতালের মেডিকেল স্টোরে। স্টোর অফিসার দেখে কোন ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিতে পারবে, কোনটা পারবে না সেটি সার্টিফাইড করেন। যে ওষুধগুলোর সরবরাহ নেই সেগুলো লাল ক্রস দিয়ে সমিতির অফিসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে রোগীকে স্লিপের অর্ধেক ওষুধ কিনে দেওয়া হয় সমিতি থেকে। বাকি ওষুধ রোগীর টাকায় কিনতে হয়। সেই হিসেবে ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ওষুধ দেওয়া হয় রোগীকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে থেকে গড়ে ৬০-৭০ জন রোগী সমিতিতে আসেন বিনামূল্যে ওষুধ নিতে। কিন্তু সেটি এক তৃতীয়াংশও না। কারণ ওয়ার্ড থেকে ডাক্তারের স্লিপ নিয়ে স্টোরে গেলে প্রায় সব ওষুধের পাশে সরবরাহ নেই বলে ক্রস চিহ্ন বসানো হয়। রোগী কল্যাণ সমিতি হাসপাতালের একটা সাপোর্টিভ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখান থেকেতো সব ওষুধ দেওয়া সম্ভব না। যদি স্টোর থেকে কিছু ওষুধ দিতো তাহলে আমরা বাকি ওষুধ দিতে পারতাম।’
এ সময় অভিজিৎ সাহার টেবিলে হাসিনা বেগম নামের এক রোগীর ফ্রি ওষুধের আবেদন ফরম দেখা যায়। হাসিনার বাড়ি কালামিয়াবাজার, চিকিৎসাধীন আছেন ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে। ফিস্টুলাজনিত সমস্যায় ভুগছেন হাসিনা, অপারেশন করতে হবে। রোগীর মোট ওষুধের দাম ৩ হাজার ৪০০ টাকা। রোগী কল্যাণ সমিতি থেকে এক হাজার টাকার ওষুধ কিনে দেওয়া হয়েছে। বাকি ওষুধ তার টাকাতেই কেনা হয়েছে বলে জানান এই সমাজসেবা কর্মকর্তা।
সেবাগ্রহীতার সংখ্যা কীভাবে হিসেব করা হয় জানতে চাইলে অভিজিৎ সাহা বলেন, ‘ওষুধ চাইতে আসা রোগী ছাড়াও অনেক রোগী আসেন চিকিৎসার বিষয়ে পরামর্শ নিতে। এদেরও সেবাগ্রহীতা ধরা হয়।’
এদিকে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন এমন অনেক গরিব ও অসহায় রোগী দেখা গেছে যাদের ওষুধ কেনার সামর্থ নেই। এমনও রোগী আছেন যারা ওষুধ ছাড়াই আছেন হাসপাতালে। এদেরই একজন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আছেন নোয়াখালীর বাসিন্দা ১৩ বছর বয়সী বাবুল। তার মা শাহিনুর জানান, বাবুল রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি মেরামতের কাজ করছিল। এ সময় গাড়ি পিষে দেয় বাবুলের পা। গত ২ জুন ভর্তি করালে ডাক্তার পায়ে অস্ত্রোপচার করেন। তারপর তাকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। কিন্তু বাড়ি নিয়ে গেলে তার পায়ে পচন ধরে। আবার হাসপাতালে এনে ভর্তি করানো হয়। এ নিয়ে ছয়বার বাবুলের পায়ে অস্ত্রোপচার করেছে ডাক্তার। সব মিলিয়ে শাহিনুরের খরচ হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। ছেলের চিকিৎসায় ধার-দেনা করে নিঃস্ব শাহিনুর।
চোখের পানি মুছতে মুছতে শাহিনুর বলেন, ‘প্রতিদিন ডাক্তার একগাদা ওষুধ লিখে দেন। হাসপাতাল থেকে শুধু নাপা আর গ্যাস্ট্রিকের ট্যাবলেট দেয়। কেউ যদি আমাকে সাহায্য করত, ওষুধ কিনতে গিয়ে পথের ফকির হতে হত না।’
শাহিনুরের সঙ্গে যোগ দেন বানু, রোজিনা, তাহেরাসহ আরও কয়েকজন নারী। তাদের সবার স্বজন হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন। চিকিৎসার খরচ চালানোর সামর্থ্য নেই তাদের।
তাহেরার বাড়ি নোয়াখালীর হাতিয়ায়। দুর্ঘটনার পর ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করান স্বামীকে। এরপর তার ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়েছে শুধুমাত্র ওষুধবাবদ। অপারেশনের সময় আলাদাভাবে রড, গজ, ব্যান্ডেজ কিনে দিতে হয়েছে। তারা কেউই জানেন না রোগী কল্যাণ সমিতির কথা।
অনুদানের ৩০ লাখ টাকা প্রসঙ্গে অভিজিৎ সাহা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রথমে আগুনে পোড়া রোগীরা প্রাধান্য পাবে। আমি বিচ্ছিন্নভাবে কোনো রোগীকে সাহায্য করতে চাই না। এ বিষয়ে বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক ডা. রফিক উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তিনি প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবেন বলেছেন। তবে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডে যদি এ টাকা না লাগে তাহলে হাসপাতালের গরিব রোগীদের সাহায্যে ব্যয় করবো।’
ডিজে