চট্টগ্রাম মেডিকেলের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সের জুলুম, সিন্ডিকেটে জিম্মি মানুষ

ট্রাকে করে চট্টগ্রামের কাজির দেউড়ি থেকে ঢাকার গাজীপুরে যাচ্ছিলেন হামিম আহমেদ পাটোয়ারী (২০)। ৩১ মে রাত ১১টার দিকে ট্রাক থেকে পড়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এরপর তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসার পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে। তার বাবা আবু ইউসুফ পাটোয়ারী ছেলের হঠাৎ মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন। ছেলের লাশ মর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি কম দামে অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করলে জরুরি বিভাগের বাইরে অবস্থান নেওয়া কয়েকজন ব্যক্তি বাধা দেন। তাদের একজন জানিয়ে দেন, নূরু সিন্ডিকেটের অ্যাম্বুলেন্সই নিতে হবে। অন্য অ্যাম্বুলেন্স নিলে হবে না। সেই রাতে জরুরি বিভাগ থেকে ছেলের লাশ মর্গে পাঠাতে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয় নূরু সিন্ডিকেটের অ্যাম্বুলেন্সকে।

এমনই ঘটনা ঘটেছে কীটনাশক খেয়ে মারা যাওয়া ইপিজেডের বাসিন্দা জাফর নামে এক তরুণের বেলায়ও। ভুল করে কীটনাশক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় রাত সাড়ে ১২টায় চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে আসা হয় জাফরকে। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ছেলের লাশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে মর্গে নিয়ে যেতে তার বাবাকে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে হয় তিন হাজার টাকা দিয়ে। ওই সময় জরুরি বিভাগের বাইরে থাকা কয়েকজন লোক তাকে জানান, তাদের ঠিক করা অ্যাম্বুলেন্সে না গেলে লাশ নিয়ে যাওয়া যাবে না। আর ভাড়াও দিতে হবে তাদের চাহিদামতোই।

এভাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ঘিরে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে চলছে অমানবিক এক ব্যবসা। সংঘবদ্ধ একটি চক্রই সেখানে ঠিক করে দেয়, কোন্ অ্যাম্বুলেন্স কখন যাবে, কোন্ অ্যাম্বুলেন্স লাশ বহন করবে আর সেই বাবদ ভুক্তভোগীদের কতো টাকা শোধ করতে হবে। চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ নূরু এই চক্রের মূল হোতা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ও হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে কিংবা মৃত রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে মূল বাণিজ্যের হোতা তিনিই। চট্টগ্রাম মেডিকেলের জরুরি বিভাগের সামনে তার লোক সারা দিন সারা রাতই ওঁৎ পেতে বসে থাকে। অস্বাভাবিক মৃত্যু কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় কারও মৃত্যু হলে তাদের চোখ চকচক করে ওঠে। এ ধরনের লাশের ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছেমতো অংকের টাকা হাতানোর ছক কষে জরুরি বিভাগের সামনে বসে। পুরো মেডিকেলকে জিম্মি বানিয়ে রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করছে তার চক্রটি। ভাড়া দিতে ব্যর্থ হলে সমিতির অফিসে নিয়ে গিয়ে মারধর করার অভিযোগও রয়েছে এই নূরুর বিরুদ্ধে।

৮ মাস আগে চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন নূর মোহাম্মদ নূরু। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তার নেতৃত্বে ১৫ থেকে ২০ জনের একটি সিন্ডিকেট চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সারাদিন পাহারা দেয়। কোনো রোগীর স্বজন তাদের পছন্দমতো দরদাম করে ওই সিন্ডিকেটের বাইরে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করতে পারে না। আর নূরু সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়লে তাদের ইচ্ছেমত ভাড়া গুণতে হয় রোগী ও তাদের স্বজনদের।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে আলাপকালে নূর মোহাম্মদ নূরু জানান, তার সমিতির অধীনে ১৩০টি অ্যাম্বুলেন্স রোগী পরিবহনে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভাড়া খাটে। হাসপাতালের বাইরে সমিতির নিজস্ব অফিস থেকেই সব দেখভাল করা হয়।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গ ঘিরেই মূলত অমানবিক বাণিজ্য চলে অ্যাম্বুলেন্স সমিতির। মেডিকেলের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে কোনো লাশ ময়নাতদন্তের জন্য অ্যাম্বুলেন্স করে নিয়ে যেতে গলাকাটা দর হাঁকে নূরু সিন্ডিকেট। মাত্র ২০০ গজ দূরে মর্গে লাশ নিয়ে যেতে ভাড়া হাঁকে ইচ্ছেমতো। দরিদ্র অনেক পরিবার সেই টাকা দিতে না পারলে সমিতির অফিসে নিয়ে তাদের মারধরও করা হয়— অভিযোগ রয়েছে এমনও।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, লাশ পরিবহনের জন্য নির্ধারিত ভাড়ার তালিকাও মানে না নূরু সিন্ডিকেট। এর আগে আনোয়ার হোসেন লিটন ছিলেন সমিতির সভাপতি এবং আকতারুজ্জামান ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। ওই সময় অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে রোগী ও স্বজনদের জিম্মি করে রাখার বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেলের মর্গে দালালদের দৌরাত্ম্য ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম আদালত–২ এর তৎকালীন বিচারক মোহাম্মদ রহমত আলী স্ব–প্রণোদিত হয়ে সুয়োমোটো রুল (সুয়োমোটো পিটিশন মামলা নং ০১/২০১৪) জারি করেন। রুলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন সিআইডি মেট্রো জোনের সহকারী পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির সরকার।

সিআইডির সেই প্রতিবেদনে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া নিয়ে অমানবিক বাণিজ্যের বিষয়টি ‘প্রতীয়মান হয়’ বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, অ্যাম্বুলেন্সের মালিকরা একজোট হয়ে ‘চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি’ (রেজি: নং– ১১২৯২) গড়ে তুলেছেন। পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার শাহনাজ ম্যানশনে সমিতির অফিস স্থাপন করা আছে। এই সমিতির মাধ্যমে সকল অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রিত হয় উল্লেখ করে সিআইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘যখনই কোনো অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন হয়, তাহাদের সমিতির বাহির হইতে কেহ অ্যাম্বুলেন্স নিতে সক্ষম হয় না। এক্ষেত্রে বাহির হইতে অ্যাম্বুলেন্স নেওয়ার ক্ষেত্রে তাহাদের বাধাও রহিয়াছে। এই সুযোগে তাহারা ইচ্ছেমাফিক ভাড়া নির্ধারণ করিয়া দেয়, যাহা ভুক্তভোগী লোকজন মানিয়া নিতে বাধ্য হন। ফলে লোকজন ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হইয়া আসিতেছে বলিয়া তদন্তকালে প্রকাশ পায়।’ ভুক্তভোগীদের এই জিম্মিদশা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে একাধিক প্রস্তাবনার কথাও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

সিআইডির প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি কর্তৃক অ্যাম্বুলেন্স নিয়ন্ত্রণ ও গন্তব্যের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি চালু থাকার কারণে ভুক্তভোগীরা ব্যাপকভাবে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হইতেছে। এক্ষেত্রে হয় কিলোমিটার অনুযায়ী ভাড়া নির্ধারণ করা প্রয়োজন, নয়তো প্রতিযোগিতামূলক খোলা মূল্য নির্ধারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।’ মালিক সমিতি কোন বিধিবলে ইচ্ছেমাফিক অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নির্ধারণ করিয়া ভূক্তভোগীদের অ্যাম্বুলেন্স নিতে বাধ্য করিতেছে তাও খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে সিআইডির প্রতিবেদনে।

২০১৬ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির যৌথ উদ্যোগে রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা তৈরি করা হয়। এ জন্য চালকদের জন্য কিছু নির্দিষ্ট শর্তও আরোপ করা হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ওই নীতিমালা পুরোপুরি অকার্যকর হয়ে যায়। করোনার সময়ে রোগী বা মরদেহ পরিবহনে ‘বাড়তি সতর্কতা’ অবলম্বনের অজুহাতে নেওয়া হয়েছে দ্বিগুণ-তিনগুণ বেশি ভাড়া।

ছয় আগের সেই নীতিমালা অনুযায়ী তিনটি ক্যাটাগরিতে নন-এসি, এসি ও ফ্রিজার ভ্যানের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছিল ওই সময়। আসা-যাওয়া মিলে ১০ কিলোমিটার নন এসি ছোট ও বড় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া ৮০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ৯০০ টাকা, ২০ কিলোমিটারে নন-এসি ছোট ও বড় ১ হাজার ২০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ১ হাজার ৩০০ টাকা, ৩০ কিলোমিটারে নন-এসি ছোট ও বড় ১ হাজার ৮০০ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ১ হাজার ৯০০ টাকা, বিমানবন্দর পর্যন্ত ৪৫ কিলোমিটারে নন-এসি ছোট ও বড় ২ হাজার ২০০ টাকা এবং এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ভাড়া ২ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়।

এছাড়া আন্তঃনগরে নন-এসি ছোট গাড়ি (১৮০০ সিসির নিচে) ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৪ টাকা, বড় গাড়ি (১৮০০ সিসি ও তার চেয়ে বেশি) ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৭ টাকা, এসি ও ফ্রিজার ভ্যান ১ হাজার ৫০০ টাকা স্থির খরচের সঙ্গে প্রতি কিলোমিটারে ১৯ টাকা, পাহাড়ি অঞ্চলে প্রতি কিলোমিটারে ১০ শতাংশ বেশি এবং ফ্রিজার ভ্যানের ওয়েটিং চার্জ গন্তব্যে পৌঁছানোর পর প্রথম ঘণ্টা ফ্রি থাকার কথা নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এরপর বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ টাকা, পরিবহনের বিদ্যুৎ ব্যবহারে প্রতি ঘণ্টায় ৩৫০ টাকা ও অক্সিজেনের জন্য নতুন সিলিন্ডার প্রতি ২২০ টাকা গ্রাহককে পরিশোধের নিয়ম চালু করা হয়। পাশাপাশি গাড়িগুলো নির্দিষ্ট জায়গায় পার্কিং ও সর্বোচ্চ পাঁচটি গাড়ি পার্কিংয়ে অবস্থান করতে পারবে— এমন কথা উল্লেখ করে নীতিমালায় বলা হয় অপেক্ষমাণ গাড়িগুলো সিরিয়াল অনুযায়ী ভাড়া পাবে।

এদিকে উত্থাপিত অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম অ্যাম্বুলেন্স পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি নূর মোহাম্মদ নূরু বলেন, রোগী ও মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুযায়ী স্বজনদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আগের কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কী করেছে তার দায়ভার আমি নেবো না। আমার দায়িত্বে থাকাকালীন কোনো অনিয়ম আমি করতে দিচ্ছি না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!