কোটি কোটি টাকা মূল্যের যন্ত্রপাতি হেলাফেলায় ফেলে রেখে একসময় কৌশলে নাম ওঠানো হয় পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির তালিকায়। কেনার পর অনেক যন্ত্রপাতির প্যাকেটই খোলা হয়নি। সেগুলোও চলে যায় পরিত্যক্ত তালিকায়। এরপর নতুন করে সেই যন্ত্রপাতি কেনার তোড়জোড় চলে। মাঝখানে চলে কোটি কোটি টাকার ধান্ধা। বহুদিন ধরেই এমন ঘটনা ঘটছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে সাম্প্রতিক অন্তত ৮০০ পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির যে তালিকা এসেছে, সেখানে ২৫টি বেবি ইনকিউবেটর ছাড়াও অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) হাইড্রোলিক টেবিলই রয়েছে সাতটি। অথচ ওটি টেবিলের অভাবে হবু মাকে সিজারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ে আনা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে ফেলে রেখে পরিত্যক্ত বানানো ৪৯টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণযন্ত্রের পাশাপাশি পরিত্যক্ত জেনারেটরই আছে কমপক্ষে ১৭টি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির তালিকার বেশিরভাগই মেডিকেলে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির তালিকায় রয়েছে, নবজাতক ওয়ার্ডের বেবি ইনকিউবেটর ২৫টি, ফটোথেরাপি যন্ত্র ২০টি, ডেন্টাল চেয়ার ইউনিট ৩৫টি, অ্যানেস্থেসিয়া যন্ত্র ১৭টি, হাইড্রোলিক ওটি টেবিল ৭টি, ডেলিভারি টেবিল ১৮টি, হটএয়ার বাথ ২৩টি, অটোক্লেভ যন্ত্র ১৫টি, অস্ত্রোপচাররে জরুরি বাতি ১৫টি, সার্জিক্যাল ডায়াথার্মি যন্ত্র ১৩টি, এক্স-রে যন্ত্র ১২টি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ৪৯টি, জেনারেটর ১৭টি এবং অন্যান্য যন্ত্র ৫২০টি।
এ তালিকার মধ্যে থাকা যন্ত্রপাতির মধ্যে ওয়ার্ডের বাইরেই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে প্রায় ১৫ লাখ টাকার ১০টি এসি, সাড়ে পাঁচ লাখ টাকায় ৩টি ভায়াথোলজি মেশিন, তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকায় ৩টি অপারেশন লাইট, বাচ্চার শরীর উষ্ণ রাখার জন্য সাড়ে ৭ লাখ টাকার একটি মেশিন, পৃথক ওয়াশিং অ্যান্ড অটো ক্লিনিক স্পেস, রোগীদের জন্য পৃথক গাউন ও ক্যাপ।
এছাড়া গাইনি ওয়ার্ড আধুনিকায়নের সময় জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা এউএনএফপিএ প্রসব কক্ষের জন্য ২০টি বেড বরাদ্দ দিয়েছিল। তবে জায়গা না থাকায় সবগুলো বেড বসানো সম্ভব হয়নি। সেগুলো বারান্দায় ফেলে রাখার পর পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির তালিকায় নাম ওঠেছে।
অথচ চট্টগ্রাম মেডিকেলের গাইনি ওয়ার্ডকে বৃহত্তর চট্টগ্রামের প্রসবপূর্ব হবু মায়েরা সন্তান জন্মদানে জন্য নির্ভরযোগ্য মনে করেন। কিন্তু চিকিৎসা নিতে এসে তাদের পড়তে হয় নানা ভোগান্তিতে। বেশিরভাগ শারীরিক জটিল প্রসবপূর্ব হবু মায়েরা অন্য হাসপাতাল বা ক্লিনিক থেকে এখানে আসে রেফার্ড হয়ে। ততক্ষণে বাচ্চা পেটের মধ্যে পায়খানা খেয়ে ফেলে কিংবা উল্টো অবস্থান নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গর্ভের পানি বা এমনিওটিক ফ্লুইড ভেঙে গর্ভবতী হবু মায়ের অন্যান্য শারীরিক জটিলতা দেখা যায়। তখন সিজারিয়ান ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু সিজার করার জন্য ওটিতে গেলে রোগীকে ওটি টেবিলের জন্য সিরিয়ালে থাকতে হয়। এতে হবু মা ও গর্ভস্থ শিশুর জীবন সংকাটপন্ন হয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম মেডিকেল স্টোরের এক স্টাফ জানান, পরিত্যক্তের তালিকায় থাকা বেশিরভাগ যন্ত্রপাতি মেডিকেলে এখন খুঁজে পাওয়া যাবে না। মেডিকেলের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাইরে যেসব যন্ত্রপাতি রাখা আছে, তা পরিত্যক্ত তালিকার একটি অংশ। তালিকার বাকি জিনিসের হদিস নেই।
চট্টগ্রাম মেডিকেলের গাইনি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. সাহেনা আক্তার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওটি টেবিলের সীমাবদ্ধতায় সিজারিয়ান টেবিলে হবু মাকে সিজারের জন্য প্রয়োজনীয় সময়ে আনা সম্ভব হয় না। পরিত্যক্ত যেসব ওটি টেবিল আছে তা জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। যা রোগী ও চিকিৎসক দু’জনের জন্যই দুর্ভাগ্যজনক।’
চট্টগ্রাম মেডিকেলের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, ‘পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির যে তালিকা করা আছে, সেগুলো আগের পরিচালকের সময়ে চাহিদা দিয়ে কেনা যন্ত্রপাতি। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর তালিকাটা রিসাফল করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তালিকাটি অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, চেষ্টা করছি সম্পূর্ণ করতে। আসলে এত আগে কেনা যন্ত্রপাতি কোথায় আছে, সেটি খুঁজে পাওয়াও মুশকিল।’
ডিজে