চট্টগ্রাম মেডিকেলেই শিক্ষার্থীসহ ৭৭ আহতের ‘এন্ট্রি’, বেশিরভাগই চলে গেছেন প্রাইভেট হাসপাতালে

মেডিকেলের ওষুধ পাচ্ছে না আহতরা

চট্টগ্রাম নগরীতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে তিনজন নিহত হওয়ার পরও শিক্ষার্থীসহ আহতের সংখ্যা প্রায় ৮০ জনে পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই এ পর্যন্ত শিক্ষার্থীসহ ৭৭ জনের নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেলেই শিক্ষার্থীসহ ৭৭ আহতের ‘এন্ট্রি’, বেশিরভাগই চলে গেছেন প্রাইভেট হাসপাতালে 1

এদের মধ্যে বর্তমানে আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকা ১৩ জনকে নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে, সাতজনকে অর্থোপেডিকস বিভাগের অপারেশন থিয়েটারে এবং দুজনকে ক্যাজুয়ালটি রাখা হয়েছে। শিক্ষার্থীসহ বাকি আহতদের বেশিরভাগকেই দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের স্বজনরা নগরীর বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেছে।

এদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কোটাবিরোধী আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসার সব ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে স্বজনদের নিজের পকেটের টাকা খরচ করে। কিনতে হচ্ছে ওষুধ ও স্যালাইন। কিন্তু হাসপাতাল প্রশাসন দাবি করছে, হাসপাতাল থেকে সব ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়েছে। প্রতি বছর চট্টগ্রাম মেডিকেলে রোগীদের বিনামূল্যে দেওয়ার জন্য কোটি কোটি টাকার ওষুধ কেনা হয়।

চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও ইন্টারন্যাশনাল ডেন্টাল মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ইনতিসার আলামিন। কলেজ থেকে বের হয়ে পথ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় তার মাথায় এসে ভারি একটি ইট পড়ে। এতে তার মাথার পিছনে বেশ আঘাত লাগে। পরে তাকে ধরাধরি করে এনে চট্টগ্রাম মেডিকেলের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। ভর্তি হওয়ার পর নার্স আলামিনের বাবার হাতে ওষুধের তালিকা ধরিয়ে দেন। সেখানে সারজেল ও ব্যাথানাশক ট্যাবলেট রয়েছে। রয়েছে স্যালাইন ও ইনজেকশনও।

বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেলে ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন কোটাবিরোধী আন্দোলনে আহত ১৩ জন। গুরুতর আহত হওয়ায় সবারই অপারেশনের প্রয়োজন পড়ছে।

ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্টার ডা. সৌমেন বলেন, ‘আঘাত মাথায় লেগেছে আহতদের। প্রথমত অবজারভেশন শেষে সিটি স্ক্যান করতে পাঠাবো রোগীদের। তাদের অবস্থা ক্রিটিক্যাল।’

ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ডের নার্স ইনচার্জ মজনু মিয়া বলেন, ‘৭৭ জনের নাম এন্ট্রি করা হয়েছে। আহতদের ক্যাজুয়ালিটি ওয়ার্ড থেকে নিউরো সার্জারি ও অর্থাপেডিকসে পাঠানো হয়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মেডিকেলের চারতলার অর্থোপেডিকস ওয়ার্ডের অপারেশন থিয়েটারে অপারেশন চলছে। কিন্তু অপারেশন পরবর্তী ওষুধপত্র কিনতে হচ্ছে আহতদের স্বজনদেরকেই।

এদিকে হাসপাতালে বহিরাগতদের আনাগোনায় ডাক্তার ও নার্সদের সেবা প্রদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আসছেন তাদের কর্মীরাও। এতে চিকিৎসায় ব্যাঘাত ঘটছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন খান বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ডাক্তার ও নার্স পর্যাপ্ত রয়েছে। আহতদের সুচিকিৎসায় আমরা সতর্ক রয়েছি।’

চট্টগ্রাম নগরীতে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগের দফায় দফায় সংঘর্ষে অন্তত তিনজন নিহত হন। সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ৭৭ জনেরও বেশি আহত শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হয়। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা এমনই করুণ যে, নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন সূত্রে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। নিহত তিনজনের মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এবং অন্য দুজনের একজন একটি ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী, পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত অপর একজনের বিস্তারিত পরিচয় মেলেনি। এদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই অস্ত্রধারীকে ধরে গণপিটুনি দিয়েছে। এদের অবস্থাও গুরুতর বলে জানা গেছে।

এদিকে আহত শিক্ষার্থীদের আর্তচিৎকারে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে জরুরি বিভাগে ডাক্তার ও নার্সরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছেন। চিকিৎসা ছাড়াই গুরুতর আহত অনেক শিক্ষার্থীকে ভ্যানের ওপর পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বেলা তিনটার পর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর-মুরাদপুর এলাকায় গুলি ছুঁড়ে তিনজনকে হত্যা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে মুরাদপুর ফরেস্ট গেট এলাকায় বিচ্ছিন্নভাবে সংঘর্ষ চলে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে টানা সংঘর্ষে ছাত্রলীগ-যুবলীগের অনেক নেতাকর্মীকে প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতে গুলি চালাতে দেখেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে ককটেলও ছুঁড়ে মারা হয়। অন্যদিকে পুলিশও শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট ও কাদাঁনে গ্যাসের সেল ছুঁড়েছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের মুরাদপুরের সংঘর্ষে নিহত ওয়াসিম আকরাম (২২) চট্টগ্রাম কলেজের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তার বাড়ি কক্সবাজারের পেকুয়ায়। অন্যদিকে ফার্নিচার দোকানের কর্মচারী ফারুকের (৩২) বাড়ি নোয়াখালীতে। মুরাদপুরের বিসমিল্লাহ হোটেলে নাস্তা করে বের হতেই একটি গুলি ওড়ে এসে তার বুক বিদীর্ণ করে চলে যায়। সেখানেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। এছাড়া মৃত অবস্থায় আরও একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নিয়ে আসা হয়েছে। ২৪ বছর বয়সী ওই যুবকের নাম ফিরোজ বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। এছাড়া আরও একজনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ নুরুল আলম আশেক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘তিনজনের বাইরে আমরা আর কোনো লাশ এখন পর্যন্ত পাইনি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm