শুক্রবার গড়িয়ে মাত্রই শুরু হল শনিবারের চাকা। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা। গোটা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই। শহীদ মিনার, জিরোপয়েন্ট কিংবা সোহরাওয়ার্দী মোড়— সবখানেই পিনপতন নীরবতা। চারিদিক থেকে ধেয়ে আসছে ঝিঝি পোকার কানভাঙা আওয়াজ। এমন সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শহীদ মিনারের উত্তর-পশ্চিম কোণের পাহাড় থেকে নেমে আসছে আলো। কিছুক্ষণ পরই বড় জিপের হেডলাইটের আলোয় আলোকিত শহীদ মিনার। বুঝতে বাকি রইল না, আঁকাবাকা পাহাড়ি পথ বেয়ে বাংলো থেকে নামছে উপাচার্যের গাড়ি।
এই গভীর রাতে ওই গাড়িতে চড়ে নামলেন বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার। রাতের ক্যাম্পাস কেমন আছে- তা নিজ চোখে ঘুরে দেখতেই রমজানের গভীর রাতে উপাচার্যের ঘর ছেড়ে নেমে আসা।
শহীদ মিনারে একটু থেমে উপাচার্যের গাড়ি কাটা পাহাড় ধরে চলে গেল জিরো পয়েন্টের দিকে।
পেছনে আছে সাদা রঙের মাইক্রোবাস। তাতে বসা বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর প্রফেসর এসএম মনিরুল হাসান ও প্রক্টরিয়াল বডির কয়েকজন সদস্য।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, দুটি গাড়িই থামে শাহ আমানত হলের গেইটের সামনে। উপাচার্য শিরীণ আখতার নিজেই দরজা খুলে নেমে এলেন পাজেরো গাড়ি থেকে। আমানত হলের দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ ততক্ষণে ছানাবড়া! কারণ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এত রাতে এভাবে হলে আকস্মিক হাজির হবেন একজন উপাচার্য— তা হয়তো তারা ভাবেনইনি। স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই তাদের সঙ্গে কথা বললেন তিনি। সবকিছু দেখে রাখার পরামর্শ দিয়ে উঠে পড়লেন গাড়িতে।
করোনা যখন হানা দেয়নি দেশে, তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের রাতটা থাকতো অন্যরকম। জিরো পয়েন্টে গিটার হাতে বসে থাকতো একদল ছাত্র। গলা ছেড়ে গান ধরতো তারা। কোন হলের ছাদ কিংবা ব্যালকনি থেকে ভেসে আসতো বাঁশির সুর। মোড়ে মোড়ে গোল করে বসে চলতো ছেলেদের গল্প-আড্ডার আসর। আবার কেউ কেউ হলের রুমে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে বুদ হয়ে থাকতো পরীক্ষার পড়ায়।
কিন্তু করোনা পরিস্থিতি ক্যাম্পাসকে দিয়ে দিয়েছে ছুটি। তাই তারুণ্যের এই ক্যাম্পাসে ঘটেছে হঠাৎ ছন্দপতন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সবাই নিরাপদে থাকতে ছুটিতে আছেন বাড়িতে— আপনজনের সঙ্গে।
তবে একজন কিন্তু ছুটি নেননি। যদিও চট্টগ্রাম শহরে থাকার মত নিজস্ব ফ্ল্যাট-বাড়ি সবই আছে তাঁর। তবুও করোনা সংক্রমণের এই পরিস্থিতিতেও তিনি অবস্থান করছেন ক্যাম্পাসে। ২২ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাসে শহুরে সুবিধার অনেক কমতি থাকার পরও সার্বক্ষণিক ক্যাম্পাসে অবস্থান নেওয়া ব্যক্তি হলেন চবির প্রথম নারী উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার।
শুধু তাই নয়, ক্যাম্পাসের সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিতে রাতদুপুরেও তিনি রয়েছেন সক্রিয়। রাতদুপুরের এই তদারকি শাহ আমানত হলেই শেষ নয়, উপাচার্য এরপর উঠলেন পাশের শাহজালাল হলেও। সেখানেও কথা বললেন তিনি নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে।
শুধু শাহ আমানত কিংবা শাহজালাল হলই নয়, এই গভীর রাতে ক্যাম্পাসের প্রত্যেক হল ও ফ্যাকাল্টিসহ গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পরিদর্শন করলেন উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার।
উপাচার্য ফিরে যাওয়ার সময় শাহ আমানত হলের নিরাপত্তারক্ষীদের কয়েকজন বললেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দফতরে দায়িত্ব পালন করছি ২০ বছর। কোন উপাচার্যকে এমন অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে গভীর রাতে ক্যাম্পাস পরিদর্শন করতে দেখিনি। তাছাড়া আমাদের মত কর্মচারীদের এত মায়াভরে কথাও বলতে দেখিনি কোন উপাচার্যকে।’
করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে রাতদুপুরে ক্যাম্পাস পরিদর্শনে বের হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘ক্যাম্পাস ছুটি। শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যার যার মত বাড়িতে অবস্থান করছে। কিন্তু ক্যাম্পাস তো সুরক্ষিত রাখতে হবে।ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখতেই রাতে আমাদের বের হওয়া।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্যাম্পাসে কলোনিগুলোতে শত শত কর্মচারী থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে ও পাশের আবাসিক এলাকায় থাকেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারাও আমার পরিবারের সদস্যের মত। তাদের সুবিধা-অসুবিধা দেখাও আমাদের দায়িত্ব। কদিন আগে লাইব্রেরিতে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা ঘটে। এছাড়া যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন তারা যেন উৎসাহ পায়, সক্রিয় থেকে কাজ করে সে জন্য রাতে প্রক্টর মহোদয়কে নিয়ে ক্যাম্পাস পরিদর্শনে বের হয়েছি। মাঝেমধ্যে এভাবে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখতে আমার নিজেরও ভাল লাগে।’
উপাচার্য আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও জরুরি বিষয়গুলো আমাকে দেখতে হচ্ছে। যেমন বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে করোনা শনাক্ত কর্যে নমুনা পরীক্ষায় নিয়োজিত। আবার শিক্ষকদের কেউ কেউ নেমেছেন গবেষণায়। তাদের প্রতিনিয়ত আমরা খোঁজ রাখছি। এছাড়া তিন-চার হাজার শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর বেতনভাতা, ঈদের বোনাসসহ নানা কিছু সামাল দিতে হচ্ছে বন্ধের মধ্যেও। নানা বিষয় সচল রাখতে প্রক্টর অফিস, রেজিস্ট্রার দফতর, হিসাব নিয়ামক শাখা, ইঞ্জিনিয়ারিং অফিস, নিরাপত্তা দফতরের সদস্যরা ছুটি পাননি। আমি শহরে থাকলে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও স্বাক্ষরের জন্য তাদের আবার শহরে আসতে হতো। তাদের দায়িত্ব পালনের সুবিধার্থে আমিও তাই ক্যাম্পাসেই রয়ে গেলাম।’
এমএফও