চট্টগ্রাম বন্দরে নিরাপদ খাদ্য পরীক্ষার দায়িত্বে কর্মচারী, নারী কর্তার ঠিকানা বিমানবন্দর
ভাগবাটোয়ারা হাতছাড়া হওয়ার ভয়
২০১৮ সালের ১১ জানুয়ারি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে স্যানিটারি ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক শামসুন নাহার বদলি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাস্থ্য দফতরে যোগ দেন। তার দায়িত্ব ছিল বন্দরের জেটিতে বিদেশি জাহাজের নাবিক, কর্মচারী ও নিরাপদ খাদ্যের পরীক্ষা করা ও সনদ দেওয়ার। যোগদানের দুই বছরেও ওই দায়িত্ব পালন করতে পারেননি একদিনের জন্যও। ওই দায়িত্বের পরিবর্তে তাকে পাঠানো হয় শাহ আমানত বিমানবন্দরের ফার্মেসিতে। একটানা সেখানে দায়িত্ব পালন শেষে চলতি বছরের মে মাসেই বদলি হয়ে চলে যান এই পরিদর্শক।
গত ১৮ মে চট্টগ্রাম বন্দর স্বাস্থ্য কার্যালয়ে স্যানিটারি ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক হিসেবে যোগদান করেছেন পারভিন সুলতানা। বিদেশ থেকে বন্দরে আসা প্রতিটি জাহাজের স্যানিটারি ও নিরাপদ খাদ্যের দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও তাকেও ওই পদে কাজ করানো হচ্ছে না। আগের পরিদর্শক শামসুন নাহারের দায়িত্বে তিনিও বিমানবন্দরে একই দায়িত্ব পালন করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, শুধু এ দুই নারী কর্মকর্তা নন, প্রায় একযুগ ধরে স্যানিটারি ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক নারী বলে অজুহাত দেখিয়ে কাজ করাচ্ছেন অন্যত্র। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একটি অংশকে আড়াল করেই কাজগুলো সুকৌশলে পরিচালনা করা হচ্ছে কর্মচারীর মাধ্যমে। সেখানকার কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে চলছে এসব অপকর্ম। আর এই ফাঁকে জাহাজের পরির্দশন ও সনদ ইস্যুর আড়ালে চালিয়ে যাচ্ছেন নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি। জাহাজের নানা সমস্যার অজুহাত দেখিয়ে প্রতিটি জাহাজ থেকে নেওয়া হচ্ছে নগদ ১০০-১৫০ ডলার, বিদেশি মদ, গুঁড়ো দুধ, সিগারেটসহ নানান পণ্যসামগ্রী। রয়েছে আরও নানা উপটৌকন। মাস শেষে এ সবকিছু স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দফতরের টেবিলে ভাগবাটোয়ারা হয়।
চলতি বছরের ১২ জুলাই চট্টগ্রাম বন্দর স্বাস্থ্য কার্যালয়ের সকল নাবিকের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, কোয়ারেন্টাইন, স্যানিটেশন স্টেটাস দায়িত্ব বন্টনের এক সপ্তাহের কার্যবন্টনের তালিকায় দেখা যায় জাহাজের নাবিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্যানিটেশান স্টেটাস যাচাই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানকার সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নুরুল আবছারের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মোহাম্মদ শাহজাহান, মো. হাবিবুর রহমান, মো. কামাল সিদ্দিক লিটন, ভারপ্রাপ্ত প্রধান সহকারী মঈরুল কাদের, অফিস সহায়ক মো. আব্দুল খালেক ও মো. দিদার আলম।
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর ৫১ তে বলা হয়, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ বিশেষ প্রয়োজনে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনুমোদনক্রমে নিম্নোক্ত স্যানিটারি ইন্সপেক্টর পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত উল্লেখিত এলাকায় ‘নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক’ এর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, সরকারের প্রজ্ঞাপন অমান্য করে অফিসের কর্মচারীর মাধ্যমে ‘নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক’ এর কাজ চালানো হচ্ছে।
জানা যায়, প্রতিদিন প্রায় ১০টিরও বেশি বিদেশি জাহাজ আসে চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে। এসব জাহাজের নাবিক, কর্মচারী ও খাদ্যের পরীক্ষা সনদ দেন পৃথক সংশ্লিষ্ট দফতরের দুই কর্মকর্তা। সেখানে সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পাশাপাশি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক হিসেবে একজন নারী কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। অথচ ওই নারীকে সেখান থেকে সুকৌশলে অন্যত্র পাঠিয়ে অন্য একটি দায়িত্ব পালন করার ‘রেওয়াজ’ তৈরি করেছে সেখানকার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর স্বাস্থ্য কার্যালয়ের সাবেক স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক শামসুন নাহার বলেন, ‘বিদেশ থেকে আসা জাহাজের স্যানিটেশান স্ট্যাটাস পরিদর্শন ও নাবিক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খাদ্যের গুণগতমান যাচাই করবে প্রসিকিউশন অফিসার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক। খাদ্য ভেজাল বিষয়ক কোনো সমস্যা হলে খাদ্যপণ্য জব্দ, মামলা দেওয়া বা জরিমানা করার এখতিয়ার স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শকেরই রয়েছে। অন্য কারোর এ ক্ষমতা যাচাই করার সুযোগ নেই। অথচ স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শককে আড়াল করেই বন্দর স্বাস্থ্য কর্মকর্তার দপ্তর থেকে জাহাজের স্যানিটেশান স্ট্যাটাস সনদ ইস্যু হচ্ছে।’
জানতে চাইলে বর্তমান চট্টগ্রাম বন্দর স্বাস্থ্য দফতরের স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক পারভিন সুলতানা বলেন, ‘চলতি বছরের মে মাসে বিমানবন্দরের যোগদান করলেও নিয়োগপ্রাপ্ত পদে কাজ পাচ্ছি না। আমি স্যানিটারি ইন্সপেক্টর ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক পদে যোগদান করেছি। কিন্তু আমাকে অভিজ্ঞতা ছাড়াই কাজ করানো হচ্ছে ফার্মেসিতে। একজন ফার্মাসিস্ট ও স্যানিটেশান পরিদর্শক দুটোই আলাদা বিষয় ও পৃথক ডিপ্লোমাধারী কোর্স। কেন এমন হচ্ছে কর্তৃপক্ষই ভাল বলতে পারবেন।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের পরিচালক ড. সহদেব চন্দ্র সাহা বলেন, ‘এমনটা তো হতে পারে না। স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের যে দায়িত্বে রয়েছেন তাকে ওই দায়িত্ব পালন না করার বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখছি।’
চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোতাহের হোসেন বলেন, ‘প্রতিটি জাহাজে দুটি দিকে পরিদর্শন করতে হয়। তার মধ্যে জাহাজে থাকা নাবিক ও কর্মচারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তাকে সহযোগিতা করেন অফিস সহায়ক ও অফিস কাম-কম্পিউটার অপারেটর। তাই ওই নারী পরিদর্শককে বসিয়ে না রেখে আমাদের আওতাধীন বিমানবন্দরের ফার্মেসিতে দায়িত্ব পালন করানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন গড়ে ৭-৮টি মতো বিদেশি জাহাজে ভিড়ে বন্দর জেটিতে। এ দায়িত্ব পালনে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। কখনও কখনও ভোরেও জেটিতে উপস্থিত থাকতে হয়। একজন নারীর পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। তাই তাকে তার দায়িত্বটির পরিবর্তে অন্যত্র কাজ করোনা হচ্ছে। সামনে অফিস আদেশ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। আসলেই সংশ্লিষ্ট পরিদর্শককে তার মূল দায়িত্ব পালন করা হবে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে স্বাস্থ্য বিভাগে স্যানিটারি ও নিরাপদ খাদ্য পরিদর্শক পদে নিয়োগ কর্মকর্তাকে কাজ না করার বিষয়টি এখন শুনলাম। আমি ওখানকার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সঙ্গে আলাপ করে পরে জানাতে পারব।’
সিপি