চট্টগ্রাম নগরে চার স্বতন্ত্রের সামনে কাঁপছে নৌকা, সংঘাতের আশঙ্কাও বেশি

দরজায় কড়া নাড়ছে এবারের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবার নির্বাচনে অংশ না নিলেও চট্টগ্রাম মহানগরীর ৬টি সংসদীয় আসনের তিনটিতেই হেভিওয়েট স্বতন্ত্ররাই যেন এবারের শক্তিশালী বিরোধী দল। গত অন্তত ১৫ বছরে এই প্রথম এই তিনটি সংসদীয় আসনে চার স্বতন্ত্র প্রার্থীর সামনে রীতিমতো কাঁপছে নৌকা, পড়েছে কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে। এই চার স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেন— জিয়াউল হক সুমন, মনজুর আলম, আবদুচ ছালাম এবং বিজয় কুমার চৌধুরী।

চট্টগ্রাম -৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও), চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং-হালিশহর-পাহাড়তলী), চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে আওয়ামী মনোনীত নৌকা প্রার্থীদের ভোটের মাঠে গলার কাঁটা এখন এই আসনের হেভিওয়েট স্বতন্ত্ররা। চট্টগ্রাম মহানগরীর এই তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঘটতে পারে বড় ধরনের সংঘাত। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিরোধ হওয়ার জোর সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে এই তিনটি আসনে সেই সাথে ভোটারদের ভোটকেন্দ্র আসা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করছে এসব আসনের ভোটাররা৷ অন্যদিকে চট্টগ্রাম-৯, চট্টগ্রাম-৪ ও চট্টগ্রাম-৫ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এই আসনের প্রার্থীরা অনেকটাই নির্ভার রয়েছে।

চট্টগ্রাম–১১ : লতিফ বনাম সুমন

এই আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামা সাত প্রার্থীর মধ্যে আলোচনায় দুই প্রার্থী। আসনটিতে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী এমএ লতিফের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩৯ নং কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। নির্বাচনের দিন ভোটের মাঠে সংঘাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আসনটিতে।

এই আসনটিতে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ প্রার্থী এম এ লতিফকে নৌকা প্রতীকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও প্রচারণা ও সমর্থনে এগিয়ে আছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন। ইতিমধ্যে জিয়াউল হক সুমন তার আসনে ১০টি ওয়ার্ডে উঠান বৈঠক, গনসংযোগ করে ব্যপক সাড়া ফেলেছেন। দুই প্রার্থীই আওয়ামী সমর্থিত হলেও ভোটের মাঠে লতিফের বিরোধী প্রার্থী জিয়াউল হক সুমন।

জিয়াউল হক সুমন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে ততই আমি মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছি। আমি দুইবারের কাউন্সিলর। জনগণের পাশে থাকাই আমার কাজ। এত বছর আমি ৩৯ ওয়ার্ডে কাজ করেছি এখন চাচ্ছি পুরো ১১ নম্বর আসনের মানুষের জন্য কিছু করতে। রাজনীতিতে আমার পাওয়ার কিছু নেই।

সুমন বলেন, ১১ আসনে মুখে মুখে এখন কেটলির গণজোয়ার। সুষ্ঠু ভোট হলে আমি জয়ী হব আশা করছি। এই আসনে ১০টি ওয়ার্ড। ১০টি ওয়ার্ডের ৮ জন কাউন্সিলরই আমার পক্ষে। এছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা নেতাকর্মীরা আমার সমর্থনে আছে৷

তিনি বলেন, লতিফের কর্মীরা আমার নির্বাচনী ক্যাম্প ভাংচুর করেছে, আগুন দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে, আমাকে সমর্থিত নাছির ভাইকে নিয়ে কথা বলে হুঁশিয়ারি দিচ্ছে, নূরী বাহিনী নামানোর হুমকি দিয়েছে। যত যাই করুক এই আসনের সবাই আমার পক্ষে। সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমার জয় নিশ্চিত।

এদিকে বর্তমান সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম-১১ আসনের নৌকা মনোনীত প্রার্থী এম এ লতিফকে নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না। সিটি মেয়রকে পাশে রেখে প্রচারণা, মতবিনিময় সভা, কথিত নূরী বাহিনী তৈরি, স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার অভিযোগ আছে এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে। ২০০৮ সাল থেকে এই আসনের সংসদ সদস্য এমএ লতিফ।

চট্টগ্রাম-১০ : মনজুর বনাম বাচ্চু

অন্যদিকে একই চিত্র চট্টগ্রাম-১০ আসনেও। প্রচারণা আর পরিচিতির দিক থেকে চট্টগ্রাম-১০ আসনে এক ধাপ এগিয়ে আছে আসনটির আওয়ামী লীগের স্বতন্ত প্রার্থী মোহাম্মদ মনজুর আলম। আসনটির ৮টি ওয়ার্ডের মধ্যে সবগুলো ওয়ার্ডেই সুপরিচিত এই প্রার্থী৷

মনজুর আলম চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচিত হওয়ার আগে ১৭ বছর ধরে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর ছিলেন। চট্টগ্রাম-১০ আসন ঘুরেও দেখা গেছে মনজুরের জনপ্রিয়তার চিত্র। উঠান বৈঠক, গণসংযোগ, পোস্টার, ব্যানার লাগিয়ে ইতিমধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করেছে এই স্বতন্ত্র প্রার্থী। চট্টগ্রাম-১০ আসনে মহিউদ্দিন বাচ্চুর নৌকার চ্যালেঞ্জ এখন স্বতন্ত্র মনজুরের ফুলকপি।

মনজুর বলেন, এই আসনে ৫ বছর মেয়র ছিলাম। সবাই আমাকে চেনে। আমি যখন ছিলাম না তখনো মানুষের জন্য করেছি এখন নির্বাচিত হলেও করব৷ সুষ্ঠু ভোট হলে এই আসনে আমি জয়ী হব আশা করছি।

এদিকে মনজুরের জনপ্রিয়তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চু। তবে তিনিও জয়ের ব্যপারে শতভাগ আশাবাদী।

মহিউদ্দিন বাচ্চু বলেন, তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি। নেত্রী আমাকে এই আসনে মনোনয়ন দিয়েছেন। রাজনীতির মানুষ হিসেবে আমি সবসময় মানুষের সঙ্গে ছিলাম, আছি আর থাকব।

নির্বাচনে মহিউদ্দিন বাচ্চুর পাশে রয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। আসনটির অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ওয়ার্ড কাউন্সিলররাও নৌকার পক্ষে মাঠে রয়েছেন।

চট্টগ্রাম-১০ আসনের সাংসদ ও সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমীনের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়ে পড়লে গত ৩০ জুলাই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে। মাত্র ১১ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে ওই নির্বাচনে ৫২ হাজার ৯২৩ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন নৌকার প্রার্থী মহিউদ্দিন বাচ্চু।

উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে ভোটার টানতে না পারলেও এবার ভোটকেন্দ্রে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে সবাই যাবেন বলে আশা করছেন মহিউদ্দিন বাচ্চু৷ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই আসনে সংঘাত হতে পারে ভোটের দিন৷

চট্টগ্রাম-৮ : ছালাম বনাম বিজয়

চট্টগ্রাম-৮ আসনের ত্রিমুখী ভোটযুদ্ধে জয়ের মালা কে পরবেন— এ নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা। চট্টগ্রাম-৮ আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য নোমান আল মাহমুদকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও শেষ মুহূর্তে এই আসনে জাতীয় পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান সোলায়মান আলম শেঠকে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ৷ তবে এই আসনে মূল আলোচনায় রয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) সাবেক চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুচ ছালাম এবং আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) সাবেক কাউন্সিলর স্বতন্ত্র প্রার্থী বিজয় কুমার চৌধুরী। দুজনই এই আসনের হেভিওয়েট স্বতন্ত্র। আবদুচ ছালাম চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) সাবেক চেয়ারম্যান হওয়ায় ভোটের বাজারে ফেসভ্যালু আছে ঠিক, তবে নানান অনিয়মের অভিযোগে বিতর্কিতও তিনি। নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগও আছে এই স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিরুদ্ধে।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজনসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা ছালামকে সমর্থন দিচ্ছেন। অপরদিকে চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের অপর একটি গ্রুপ বিজয় কুমার চৌধুরীকে সমর্থন দিচ্ছেন।

এই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য নোমাল আল মাহমুদও বিজয় কুমার চৌধুরীর পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছেন। বিজয় বলেন, আমাকে সবাই সমর্থন দিচ্ছে। সুষ্ঠু ভোট হলে আমার জয় নিশ্চিত। শেষ পর্যন্ত ত্রিমুখী ভোট লড়াইয়ে কার জয় হবে— সেটিই এখন দেখার বিষয়।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm