চট্টগ্রাম চেম্বার নির্বাচন স্থগিত, আদালতে ফের ভেস্তে গেল ‘পকেট ভোটে’র খেলা
এক পরিবারের পর আরেক পরিবারের দখলচেষ্টা
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির নির্বাচন স্থগিতের আদেশ দেওয়ায় শনিবার (১ নভেম্বর) নির্ধারিত ভোট আর হচ্ছে না। আট বছর পর ভোটের আয়োজন নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল চেম্বারপাড়ায়। তবে আপিল বিভাগের আদেশে আপাতত থেমে গেল সব প্রস্তুতি।
সাধারণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ছোট ভাই আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী গত এক বছর ধরে অনৈতিক উপায়ে টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপের ‘পকেট ভোট’ হাতে নিয়ে চেম্বারকে কব্জায় নেওয়ার চেষ্টা করছেন। এরই মধ্যে হাইকোর্ট বিতর্কিত ওই দুটি গ্রুপ ছাড়াই নির্বাচন করার আদেশ দেন। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আপিল করিয়ে আমীর হুমায়ুন গ্রুপ ‘পকেট ভোট’ পুনর্বহালের চেষ্টা করছেন—এমন অভিযোগ রয়েছে সাধারণ ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
আপিল বিভাগের আদেশ
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) দুপুরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ চেম্বার নির্বাচন স্থগিতের আদেশ দিয়ে বলেন, হাইকোর্টের রুল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চেম্বারের নির্বাচন স্থগিত থাকবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক। অন্যদিকে রিটকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার শিশির মনির, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল ও ব্যারিস্টার নিহাদ কবির।
হাইকোর্টের আদেশ ও বাণিজ্যের হঠাৎ আপিল
চিটাগং চেম্বারের অর্ডিনারি মেম্বার মোহাম্মদ বেলাল গত ১৯ অক্টোবর হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন। তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেওয়ার আদেশ চ্যালেঞ্জ করেন। শুনানি শেষে ২২ অক্টোবর হাইকোর্ট ওই নির্দেশ স্থগিত করে টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপ ছাড়া নির্বাচন করার আদেশ দেন।
এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত মঙ্গলবার চেম্বার জজ আদালতে আপিল করে। মঙ্গলবার ও বুধবার শুনানির পর আদালত হাইকোর্টের স্থগিতাদেশে হস্তক্ষেপ না করে বিষয়টি আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ‘দ্বৈত সিদ্ধান্ত’
২০ আগস্ট বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর ঘোষণা করে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ না দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ৪ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত বদলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়। অথচ চলতি বছরের ১৫ জুলাই প্রকাশিত তদন্ত প্রতিবেদনে এবং ২০ আগস্ট-এর আগের নির্দেশনায় এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে অযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এই ‘দ্বৈত অবস্থান’ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন চট্টগ্রামের সাধারণ ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রাম গার্মেন্টস এক্সেসরিজ গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ বেলাল এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে রিট করেন।
সালিশি ট্রাইব্যুনালের শুনানি
এর আগে ২৮ অক্টোবর এফবিসিসিআইয়ের সালিশি ট্রাইব্যুনালে টাউন অ্যাসোসিয়েশন ও ট্রেড গ্রুপ নিয়ে তিনটি অভিযোগের শুনানি হয়। তবে ট্রাইব্যুনাল কোনো আদেশ না দিয়ে বিষয়টি আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দেয়।
কারা এই টাউন ও ট্রেড গ্রুপ
চেম্বারের টাউন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য প্রতিষ্ঠান চারটি—পটিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বোয়ালখালী অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, হাটহাজারী অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং রাঙ্গুনিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি।
অন্যদিকে ট্রেড গ্রুপে আছে চিটাগাং ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ, চিটাগাং মিল্ক ফুড ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ, চিটাগাং টায়ার টিউব ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স গ্রুপ এবং চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্প মালিক গ্রুপ।
এই দুটি গ্রুপ থেকে নির্বাচনে ছয়জন পরিচালক হন—প্রতিটি ক্যাটাগরি থেকে তিনজন করে। সাধারণত প্রার্থিতা নিয়ে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় না; সমঝোতার ভিত্তিতেই প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হয়।
‘ভোট ছাড়াই পরিচালক’ প্রক্রিয়া নিয়ে ক্ষোভ
ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, এই দুটো গ্রুপের কারণে পুরো নির্বাচন বৈষম্যমূলক হয়ে যায়। ট্রেড গ্রুপে মাত্র ৯ জন ভোটার তিনজন পরিচালক নির্বাচিত করেন, আর টাউন গ্রুপে মাত্র ১১ জন নির্বাচিত করেন আরও তিনজন পরিচালক। অথচ ৪ হাজার ১ জন সাধারণ সদস্য ভোট দিতে পারেন মাত্র ১২ জন পরিচালক নির্বাচনে, আর ২ হাজার ৭৬৪ সহযোগী সদস্যের ভোটে নির্বাচিত হন আরও ৬ জন পরিচালক।
এই অস্বাভাবিক ভোট কাঠামোর মধ্যেই পকেট ভোট হিসেবে কুখ্যাত ট্রেড গ্রুপ থেকে বিনা ভোটে পরিচালক হওয়ার চেষ্টা করছিলেন মোহাম্মদ আমিরুল হক, এসএম সাইফুল আলম, মোহাম্মদ আকতার পারভেজ এবং টাউন অ্যাসোসিয়েশন থেকে মোহাম্মদ সাজ্জাদ উন নেওয়াজ, মো. মনির উদ্দিন ও আফসার হাসান চৌধুরী।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আহমেদ উল আলম চৌধুরী রাসেল বলেন, ‘ফ্যাসিবাদিদের দোসরদের আপিলের কারণে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাধারণ ব্যবসায়ীদের ভোটের মাধ্যমে ডাইরেক্টর নির্বাচন স্থগিত হয়ে গেল। বিনা ভোটে ফ্যাসিবাদি হাসিনার স্টাইলে ৬ জন ডাইরেক্টর হওয়ার ব্যর্থ অপচেষ্টা হচ্ছে এই আপিল।’
‘পকেট ভোট’ ও প্রভাবের অভিযোগ
চেম্বারের এই টাউন ও ট্রেড গ্রুপ একসময় আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ‘পকেট ভোট’ হিসেবে পরিচিত ছিল। তখন তাঁর মনোনীত প্রার্থীরাই বিনা ভোটে পরিচালক হতেন। এখন সেই প্রভাব নিয়েছেন সাবেক সভাপতি আমীর হুমায়ুন মাহমুদ চৌধুরী। অভিযোগ রয়েছে, বিএনপি নেতা বড় ভাইয়ের প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই ‘কাগুজে’ প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ‘ইউনাইটেড বিজনেস ফোরাম’ নামে একটি প্যানেল গঠন করেছেন।
এই প্যানেলের নেতৃত্বে আছেন সীকম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আমিরুল হক, যিনি এম এ লতিফের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে লতিফের প্যানেল থেকে বিনা ভোটে পরিচালক হয়েছিলেন।
অবাধ নির্বাচনের আশা সম্মিলিত ব্যবসায়ীদের
প্রতিদ্বন্দ্বী প্যানেল হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ‘সম্মিলিত ব্যবসায়ী পরিষদ’। নেতৃত্বে আছেন চেম্বারের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এসএম নুরুল হক, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এস এম ফজলুল হকের ছোট ভাই।
আপিল বিভাগের রায়ের প্রতিক্রিয়ায় এসএম নুরুল হক বলেন, ‘আমরা মনে করি এটি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত। হাইকোর্টের নির্দেশ বহাল থাকলে পকেট ভোটমুক্ত অবাধ নির্বাচন সম্ভব হবে।’
চট্টগ্রাম ব্যবসায়ী পরিষদের আহ্বায়ক শাজাহান মহিউদ্দিন বলেন, ‘গত ১৫ বছর চেম্বার একটি পরিবারের দখলে ছিল। এখন আরেকটি পরিবার একইভাবে চেম্বার দখলে নিতে চেয়েছিল। আদালতের রায়ে সেই অবৈধ প্রক্রিয়া থেমে গেছে।’
সিপি



