১২ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের চৌমুহনীতে একটি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করতেন জনি কুমার ভূঞা। এরপর তিনি প্রেমের সম্পর্ক গড়ে বিয়ে করেন খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের এক ঠিকাদারের মেয়েকে। আর এতেই ভাগ্য পরিবর্তন হয় জনির। শ্বশুরের হাত ধরে নিজেও জড়িয়ে পড়েন ঠিকাদারি ব্যবসায়। জামাই-শ্বশুর মিলে ঠিকাদারিতে বিস্তার করেন আধিপত্য। দু’জন মিলে গড়ে তোলেন অন্তত ১৫টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যেগুলো সব অন্তর্ভুক্ত খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ঠিকাদারের তালিকায়। এসব প্রতিষ্ঠানের কিছু তাদের নামে আবার কিছু স্ত্রীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামেও।
তাদের বিরুদ্ধে অসাধু খাদ্য কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে কাজ বানিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি কাজ না করে বিল তুলে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। একইসঙ্গে বিভিন্ন ঠিকাদারের কাজ চুক্তির ভিত্তিতে জনি পরিচালনা করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
মেসার্স জনি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জনি কুমার ভূঞার বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের হাজীপুর এলাকায়।
জানা গেছে, প্রায় ১২ বছর আগে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানা এলাকায় চৌমুহনীর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘আলম ট্রেডার্সে’ অফিস সহায়ক হিসেবে চাকরি করতেন জনি কুমার ভূঞা। সেখানে থেকে এক ঠিকাদারের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্র ধরে বিয়ে হয় তার। এরপরই কপাল খুলে যায় জনির। শ্বশুরের কাছ থেকে ব্যবসা বুঝে নিয়ে নেমে পড়েন চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তরের পরিবহন ঠিকাদারি ব্যবসায়। ২০১৮ থেকে এখনও পর্যন্ত শ্বশুরকে সঙ্গে নিয়ে ঠিকাদারি ব্যবসা করছেন তিনি। জনির নামে আটটি এবং শ্বশুরের নামে সাতটিসহ মোট ১৫টি খাদ্য পরিবহন ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া তালিকায় ঠিকাদারের প্রতিনিধির জায়গায় নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে আরও চারটি ঠিকাদারি কাজ ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করছেন জনি।
আরও জানা গেছে, চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক দপ্তরের ২০১৮-২০১৯ এবং ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে নিয়োগকৃত পরিবহন ঠিকাদারের সংখ্যা ৪৬৯টি প্রতিষ্ঠান (বিআরটিসিসহ)। এর মধ্যে ৪৫৭টি পরিবহন ঠিকাদার হিসেবে বর্তমানে কাজ করছে। ২০১৮ অর্থবছরেই জনি ও তার শ্বশুর মিলে ১৫ প্রতিষ্ঠানের নামে বাগিয়ে নেন ঠিকাদারি কাজ।
এদিকে চাল চুরি সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও অভিযুক্ত ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থায় নেয়নি খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ। আর এই কারণেই অনিয়মের সুযোগ পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন এসব ঠিকাদাররা।
জনির নিয়ন্ত্রণে যেসব প্রতিষ্ঠান
খাদ্য অধিদপ্তরের ঠিকাদারি তালিকার ১৮৩ নম্বর রয়েছে ‘জনি এন্টারপ্রাইজ’। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জনি কুমার ভূঞা। তালিকার ১৮৪ নম্বরে থাকা ‘নীল এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারী জনির স্ত্রীর প্রিয়াংকা দাশ গুপ্ত। ১৭১ নম্বরে থাকা ‘এ কে এন্টারপ্রাইজ’ জনির নামে।
তালিকার ২১৭ নম্বরে ‘সাহা এন্টারপ্রাইজ’ নামের প্রতিষ্ঠানটির ঠিকাদার প্রতিনিধির তালিকায় আছে জনির মোবাইল নম্বর। প্রতিষ্ঠানটি তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বলে জানা গেছে।
তালিকায় ২৪৯ ও ২৫০ নম্বরে রয়েছে ‘নবীন স্টোর’ এবং ‘মো. সিদ্দিকুর রহমান’। প্রতিষ্ঠান দুটির ঠিকাদার প্রতিনিধি হিসেবে খাদ্য তালিকায় রয়েছে জনির মোবাইল নম্বর। ২৯৯ ও ৪২৪ নম্বরে থাকা ‘জলি এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘হ্যাপি কর্পোরেশন’ নামের প্রতিষ্ঠান দুটিও নিয়ন্ত্রণ করেন জনি। এভাবে এই আট প্রতিষ্ঠানের কাজ বিভিন্নভাবে বাগিয়ে নেন জনি।
ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের খাদ্য তালিকায় ৩১২ নম্বরে ‘শাঈনী লাইন’, ৩৯৪ নম্বরে ‘করিম অ্যান্ড কোং’, ৩৯৫ নম্বরে ‘রশিদ অ্যান্ড কোং’ এবং ২৯৮ নম্বর রয়েছে ‘জাহাঙ্গীর আলম অ্যান্ড কোং। সেখানে জাহাঙ্গীর আলম অ্যান্ড কোংয়ের প্রতিনিধি হিসেবে মোবাইল নম্বর দেওয়া হয়েছে জনির। জানা গেছে, এই চার প্রতিষ্ঠান চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে পরিচালনা করে আসছেন জনি।
শ্বশুরের নামে যেসব প্রতিষ্ঠান
খাদ্য পরিবহন ঠিকাদরের তালিকায় ১৩ নম্বরে রয়েছে মেসার্স দিপালী এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জনির শ্বশুর ধীরেন্দ্র দাশ গুপ্ত। এছাড়া তালিকার ৬৫ নম্বরে থাকা ‘দীপু ট্রেডিং’ নামের প্রতিষ্ঠানটি ধীরেন্দ্র দাশ গুপ্তের স্ত্রীর নামে। তালিকার ২১৬ নম্বরে থাকা ‘পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ’ নামের প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির নামের তালিকায় রয়েছে ধীরেন্দ্র দাশ গুপ্তের মোবাইল নম্বর। একইসঙ্গে তালিকায় ৬৬ নম্বরে ‘রুপা এন্টারপ্রাইজ’, ১২৩ নম্বরে ‘সিদ্দিক অ্যান্ড ব্রাদার্স’, ১২৪ নম্বরে ‘কারিমা এন্টারপ্রাইজ’ এবং ৪১৯ নম্বরে থাকা ‘অভি এন্টারপ্রাইজ’র স্বত্বাধিকারী ভিন্ন ভিন্ন নামে হলেও সেখানে তালিকার প্রতিনিধির ঘরে দেওয়া মোবাইল নম্বরটি ধীরেন্দ্র দাশ গুপ্তের।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ঠিকাদার জনি কুমার ভূঞা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি ও আমার স্ত্রীর নামে দুটি ঠিকাদারি কাজ নিয়েছি। আমার শ্বশুর ও শাশুড়ির নামে আরও দুটি ঠিকাদারি কাজ করছি। বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে আমার লোকজন কাজ করে, সেখানে আমার মোবাইল নম্বরটি উল্লেখ করা হয়। একইসঙ্গে খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের তালিকায় কিছু ভুল তথ্য আছে।’
আপনি কিভাবে ঠিকাদারিতে এসেছেন, জানতে চাইলে জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি ১২ বছর আগে একটি প্রতিষ্ঠানে অফিস সহায়ক হিসেবে কাজ করেছি। আমার শ্বশুরের মাধ্যমে আমি ঠিকাদারি ব্যবসায় এসেছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক এসএম কায়ছার আলী বলেন, ‘আমি মোবাইলে এভাবে কাজ কারা করছেন সেটি তো বুঝতে পারব না। বিষয়টি অভিযোগ আকারে আমাকে দেন, তাহলে আমার বুঝতে সহজ হবে।’
ডিজে