চট্টগ্রাম ওয়াসায় কী মধু সোলায়মান শেঠে!

চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি (গ্রাহক প্রতিনিধি) নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। এই পদে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সোলায়মান আলম শেঠের অর্ন্তভূক্তি, মেয়াদ পূর্তির পরও চার বছর অবৈধভাবে ওয়াসা বোর্ডে থেকে যাওয়া, মন্ত্রণালয় থেকে তার মেয়াদপূর্তির পর নতুন নাম আহবানের পর আবারও বিতর্কিত এই ব্যক্তির নাম পাঠানো নিয়ে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে।

ওয়াসার বোর্ড সদস্য, গ্রাহকসহ সংশ্লিষ্ট সবার একই প্রশ্ন—চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডে সোলায়মান আলম শেঠে কী মধু পেয়েছেন ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম ফজলুল্লাহ?

স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে ২৯ জুলাই জারি করা এক আদেশে চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে বলা হয়, ‘গ্রাহক প্রতিনিধি’ হিসেবে চট্টগ্রাম ওয়াসা বোর্ডের সদস্য সোলায়মান আলম শেঠের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ ওই পদে নিয়োগের লক্ষ্যে ৭ কর্মদিবসের মধ্যে পানি ব্যবহারকারীদের একজন প্রতিনিধি মনোনয়ন করে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণের জন্য নির্দেশনা দেয়।

একই তারিখে দেওয়া আরেকটি চিঠিতে ওয়াসা বোর্ডে পানি ব্যবহারকারীদের সদস্য হিসেবে ভোক্তা প্রতিনিধি অন্তর্ভূক্তির জন্য কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) চিঠির বিষয়ে সাত কার্যদিবসের মধ্যে মতামত পাঠানোর জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।

নতুন গ্রাহক প্রতিনিধি মনোনয়নের বিষয়টি নিয়ে গত ৯ আগস্ট ওয়াসার বোর্ড সভায় আলোচনা হয়। এতে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন প্রতিনিধিসহ মোট তিন জনের নাম প্রস্তাব করার সিদ্ধান্ত হয়।

এরপর গত ২ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবর চট্টগ্রাম ওয়াসা থেকে মন্ত্রনালয়ে পানি ব্যবহারকারীদের প্রতিনিধি হিসেবে তিন জনের নাম পাঠানো হয়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে যাকে ঘিরে এত বিতর্ক, সেই সোলায়মান আলম শেঠের নাম আবারও রাখা হয়েছে সেই তালিকায়। সোলায়মান শেঠ ছাড়া গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রণালয়ে বাকি যাদের নাম পাঠানো হয়েছে তারা হলেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম এবং রাজীব বড়ুয়া।

জানা গেছে, এর মধ্যে রাজীব বড়ুয়া ওয়াসার মদুনাঘাট ডব্লিউ ৪ প্রকল্পের উপ-ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি ওয়াসার এমডি কেএম ফজলুল্লাহর ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে তিনি সম্পৃক্ত—এমন জনশ্রুতিও রয়েছে।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজুল ইসলাম বর্তমানে বয়সের ভারে ন্যুজ্ব। প্রবীণ এই নেতা চট্টগ্রাম শহর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করার পর রাজনীতিতে আর সক্রিয় হননি তিনি।

এদিকে গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে সোলায়মান আলম শেঠের নাম পুনরায় মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কথা জানাজানি হলে ওয়াসার বোর্ড সদস্যরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ওয়াসা বোর্ডের একাধিক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সোলায়মান আলম শেঠের সঙ্গ ছাড়তে পারছেন না ওয়াসার এমডি কেএম ফজলুল্লাহ।

তারা প্রশ্ন করেন, শেঠের কাছে কী এমন মধু আছে, এত বিতর্কের পরও ওয়ার্সা বোর্ড সদস্য থেকে তার সরাতে চান না ওয়াসার এমডি?

বোর্ড সদস্যরা অভিযোগ করেন, ওয়াসার বিগত সময়ের সকল উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম দুর্নীতির অনেকাংশেই জড়িত সোলায়মান আলম শেঠ। গ্রাহক প্রতিনিধি হয়ে উল্টো তিনি গ্রাহকদের স্বার্থবিরোধী কাজে জড়িত ছিলেন। সেই শেঠ ওয়াসা বোর্ডে না থাকলে এমডির অসুবিধা। তাই এত সমালোচনার পরও ওয়াসা এমডি নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়ে ফের সোলায়মান আলম শেঠের নাম প্রস্তাব করেছেন।

অন্যদিকে গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে নাম পাঠানো রাজীব বড়ুয়ার বিষয়ে নানা অভিযোগ তুলেছেন ওয়াসার বোর্ড সদস্যরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলছেন, রাজীব বড়ুয়া ওয়াসার একটি প্রকল্পের উপ-ঠিকাদার। তার সাথে ওয়াসা এমডির গোপন সখ্যের কথা কারও অজানা নয়।

বোর্ড সদস্যরা বলছেন, গ্রাহক প্রতিনিধি হিসেবে বিতর্কিত দুই জনের নাম পাঠিয়ে ওয়াসা এমডি নির্লজ্জতার পরিচয় দিয়েছেন।

এদিকে প্রকৃত গ্রাহক প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে ওয়াসা এমডি তার আজ্ঞাবহদের নাম প্রস্তাব করায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে গ্রাহকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন কনজ্যুমার এসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশ ক্যাব। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, অনিয়ম দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য ওয়াসার এমডি পুনরায় সোলায়মান আলম শেঠের নাম পুনরায় পাঠিয়েছেন। ওয়াসা এমডি আইন এবং মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে গ্রাহকদের স্বার্থবিরোধী কাজের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে পুনরায় তালিকায় রেখেছেন। ওয়াসা এমডির সময়ে চলা উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে লুটপাট করা হয়েছে। এসব বিষয়ে তদন্ত করতে প্রধানমন্ত্রী এবং দুদকের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

অভিযোগ প্রসঙ্গে ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী কে এম ফজলুল্লাহ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘৭৫ হাজার গ্রাহক থেকে ৩ জনের নাম পাঠাতে হয়। আমি কী করে বুঝবো কে গ্রাহক প্রতিনিধি হতে চায়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ জনের নাম পাঠানো হয়েছে।’

এত বিতর্কের পরও কেন সোলায়মান আলম শেঠের নাম পুনরায় পাঠানো হলো—এমন প্রশ্নের জবাবে ওয়াসা এমডি বলেন, ‘এখান থেকে কাকে মনোনীত করা হবে অথবা তালিকার বাইরে থেকে কাউকে মনোনীত করা হবে কিনা সেটি মন্ত্রণালয়ের বিষয়।’

তবে ওয়াসার এমডি কে এম ফজলুল্লাহ সোলায়মান আলম শেঠ কিংবা রাজীব বড়ুয়ার সাথে সঙ্গে তার ব্যবসায়িক পার্টনারশিপ কিংবা নিয়মবর্হিভূত লেনদেনের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন।

ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ৩ জনের নাম পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রনালয় তাদের মনোনীত ব্যক্তির নামও দিতে পারে। এখানে বোর্ড থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসে না। তালিকায় সোলায়মান আলম শেঠের নাম দিলেই বোর্ড সদস্য মনোনীত হয়ে গেল আমি এটা বিশ্বাস করি না।’

এসসি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!