চট্টগ্রামে ৭০ সনের জাল দলিল মিলছে টাকা ছাড়লেই

চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে ভূমিদস্যুচক্র ভুয়া দলিল জাল-জালিয়াতি করছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই জালিয়াতি এমনই যে, চক্রটি হুবহু সত্তর সনের ভুয়া দলিল বানিয়ে নিচ্ছে। আইনের ভাষায় যা ‘জাল দলিল’ হিসেবে বিবেচিত। এসবের খপ্পরে পড়ে হয়রানি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অথচ চক্রটির হাতে নামজারি, ডিসিআর, খাজনা রশিদ কিংবা ভূমি অফিসের কোনো রেকর্ডপত্রই নেই, তবু চলছেই নকল দলিল তৈরির যজ্ঞ।

কিভাবে এসব ভূয়া দলিল তৈরি করা হচ্ছে— এমন অনুসন্ধানে নেমে জানা গেছে, এক ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করে আসল দলিলের লেখা তুলে ফেলে নতুন দলিল লেখা হয়। তারপর টাকার বিনিময়ে সেসব দলিল দিয়ে নামজারি ও দখলকারীদের সরবরাহ করা হয়। ধারণা করা হচ্ছে, ওই চক্রটির কাছে মজুদ রয়েছে সরকারি পুরনো স্ট্যাম্প, জাল দলিল করার উপকরণ, রেজিস্ট্রার ও ভূমি অফিসের সিল।

এদিকে জমিজমার জটিল হিসাব-নিকাশ যারা বোঝেন না, তাদের ফাঁদে ফেলে এই চক্রটি অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অন্যের জমি নিজেদের বলে দাবি করছে। আদালতে আবার মামলাও ঠুকে দিচ্ছে। কৌশলে ফন্দিফিকির করে চক্রটি ছয় মাসের মধ্যে একতরফা রায়ও বের করে নিচ্ছে— এমন উদাহরণও আছে।

s alam president – mobile

জানা গেছে, এই সংঘবদ্ধ চক্রের কব্জায় গেছে কর্ণফুলী সাব-রেজিস্ট্রি অফিসও। রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির বহু অভিযোগ। সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে নানা অজুহাতে পদে পদে হয়রানি করা হচ্ছে। যদিও কর্ণফুলীতে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা সাব-রেজিস্ট্রার মো. শাহিন হাসান এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানায়, গত কয়েক দিনে তিনটি সন্দেহজনক দলিল জমা পড়েছে— যা ভূয়া বলে ধারণা জন্মেছে। দেখা গেছে, দলিল নম্বর ২৫৬৩ তৈরি হয়েছে তারিখ ৭০ সনের ৩রা এপ্রিল। জমির পরিমাণ ৬ গন্ডা। দলিলগ্রহীতার নাম বড়উঠান ইউনিয়নের মো. আলী খানের ছেলে নওসের আলী খাঁন। দাতা একই এলাকার মৃত আনোয়ার আলী খাঁর স্ত্রী রোসন খাতুন বেগম। মহিলার নামের শেষে বেগম ও খাতুন দুটিই আছে। এরকম আরেক দলিল নম্বর ৫১৪০ তৈরি হয়েছে ৭০ সনের ২৪ আগস্ট। জমির পরিমাণ ৯ কড়া। দলিলগ্রহীতা আনোয়ারা উপজেলার বটতলীর শীবপ্রসাদ দাসের ছেলে দীলিপ দাস। দাতা শিকলবাহা ইউনিয়নের মৃত মকবুল আলীর ছেলে খলিলুর রহমান।

সন্দেহজনক সর্বশেষ দলিলটির ক্রমিক নম্বর ২৩। এর তারিখ ৭০ সনের ২৬ অক্টোবর। জমির পরিমাণ ২ গন্ডা। দলিলগ্রহীতা চরলক্ষ্যা ইউনিয়নের আমজু মিয়ার ছেলে বাচা মিয়া। দাতা হলেন একই ইউনিয়নের ফজর রহমানের ছেলে নজির আহমদ। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তিনটি দলিলই সত্তর সনের। পাকিস্তান আমলের স্ট্যাম্প লাগানো আছে ৬ রুপি, ৯ রুপি ও ১৫ রুপির। তিন দলিলে হাতের লেখা একই ব্যক্তির। রয়েছে তাজা টিপসই ও সিল স্বাক্ষরও। ভিন্ন ভিন্ন মালিক। দেখে বোঝার উপায় নেই এসব আসল না ভুয়া!

Yakub Group

অনেকেই দলিলগুলো দেখে বলছেন, ৫৩ বছর আগের দলিল এখনও এতো ‘তাজা’ দেখায় কী করে?

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্দেহজনক সব দলিলই ৭০ সনের। কেন শুধুই সত্তর সন? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা পটিয়া ভূমি অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল। ওই সময় ভূমি অফিসে থাকা সকল নথি ও দলিল পুড়ে যায়। ফলে কোনো জমির দলিলের অফিস কপি সংরক্ষিত নেই। এসিল্যান্ডরা চাইলেও জেলা রেজিস্ট্রার ৬৯, ৭০, ৭১ সনের দলিলের তথ্য উপাত্ত দিতে পারছেন না। এ সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে চক্রটি শুধু ৭০ সনের দলিল তৈরি করছে।

চট্টগ্রাম জজকোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিহাব বলেন, ‘জাল দলিলচক্রের অপতৎপরতায় জমি নিয়ে নাজেহাল হচ্ছে নিরীহ মানুষ। নকল দলিলে আইনি জটিলতা বাড়ছে। এসব বন্ধ করতে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযান দরকার ।’

কর্ণফুলীর সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিযুষ কুমার চৌধুরী বলেন, ‘এক জমি একাধিক মালিকের নামে করা থাকলে ধরে নিতে হবে দলিলটি জাল হতে পারে। এক্ষেত্রে সরেজমিনে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে মূল মালিক কে— তা নির্ণয় করতে হবে। ভূমি অফিস থেকে জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে। নামজারিতে ধারাবাহিকতা ঠিক আছে কি না, সেটা সুচারুভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। যদিও কাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এসিল্যান্ডরা কিছু সিম্পটম দেখে দলিল সনাক্ত করতে পারেন। এতে ভলিউডেমর তথ্য, স্বাক্ষর যাচাই, মূল মালিক শনাক্ত, নামজারি তারিখ যাচাই, লেখক যাচাই, মালিকানা যাচাই, সিল-স্ট্যাম্প যাচাই বাছাই করে স্পষ্ট একটি ধারণা করতে পারেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!