চট্টগ্রামে ৪ সহোদরের চোরাচালান চক্র, কমিশনে স্বর্ণের চালান আসে ‘সাধারণ যাত্রীর’ হাত ধরে

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার উত্তর কাঞ্চনা এলাকার আব্দুল গফুরের চার পুত্র— আলমগীর, জাহাঙ্গীর, সায়েম ও শাহজাহান। তার মধ্যে তিন ভাইয়ের নামে চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারে রয়েছে মোবাইল ফোনের তিনটি দোকান, স্টেশন রোডের প্যারামাউন্ট সিটিতে অফিস রয়েছে অপর ভাই জাহাঙ্গীরের। বড় ভাই আলমগীরের মোবাইলের দোকানের হাত ধরে বাকি তিন ভাইও ‘ব্যবসায়’ জড়িয়ে পড়েন। শুরুতে আলমগীর দুবাই থেকে যাত্রীর মাধ্যমে কৌশলে মোবাইল আনতেন দেশে। পরবর্তীতে চোরাকারবারিদের সঙ্গে সখ্য বেড়ে গেলে জড়িয়ে পড়েন দুবাই থেকে স্বর্ণের চালান আনা ও দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রাপাচারসহ হুন্ডি ব্যবসায়ও।

অনেকটা অবাধেই চার ভাই মিলে এই ব্যবসা চালিয়ে এলেও সম্প্রতি তাদের দুই ভাইয়ের নাম খোলাখুলি এসেছে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে স্বর্ণসহ এক যাত্রী ধরা পড়ার পর। এরপর বেরিয়ে আসে তাদের অবৈধ ব্যবসার চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে এই চক্রে জড়িত আরও দুই ভাইয়ের তৎপরতার কথা বেরিয়ে এসেছে বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণে।

গত বছরের ২৩ নভেম্বর দুবাই থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে নামার পর ২৬ পিস স্বর্ণের বারসহ ৪ কেজি ১৫৯ গ্রাম স্বর্ণ, চারটি দামি আইফোন ও একটি আইপ্যাডসহ বিমানবন্দরে আটক হন সোহেল (২৮) নামে এক যাত্রী। স্বর্ণ আটকের ওই ঘটনায় সিএমপির পতেঙ্গা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করেন বিমানবন্দরের কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা (এআরও) শরীফুল ইসলাম। পরবর্তীতে আটক সোহেলকে চট্টগ্রামের একটি আদালতের মাধ্যমে ৫ দিনের রিমান্ড আনে পতেঙ্গা থানা। রিমান্ড শেষে শাহ আমানত বিমানবন্দরে জব্দকৃত স্বর্ণের মূল হোতা হিসেবে জাহাঙ্গীর ও সায়েম এবং চট্টগ্রামের হাটহাজারী এলাকার দুবাইপ্রবাসী হাশেমের নাম পান সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সোহেলের মতো দুবাই থেকে আসা আরও বিভিন্ন যাত্রীর মাধ্যমে স্বর্ণের বারের প্রতি পিস ১ হাজার টাকা কমিশন অথবা যাত্রীদের আসা-যাওয়ার টিকিটের বিনিময়ে এদেশে কৌশলে অবৈধ স্বর্ণের চালান নিয়ে আসছে চার ভাইয়ের ওই যৌথ সিন্ডিকেট। স্বর্ণ ছাড়াও দেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে চার ভাই জড়িত— পুলিশের অনুসন্ধানে মিলেছে এমন তথ্যও। সম্প্রতি দেশ থেকে বিদেশি মুদ্রা পাচারের সময় দুবাইগামী এক যাত্রীর সঙ্গে সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা জাহাঙ্গীরের হোয়াটসঅ্যাপ কথোপকথনের বেশ কয়েকটি অডিও ক্লিপ চট্টগ্রামের প্রতিদিনের হাতে এসেছে।

জানা গেছে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে জব্দ করা ৪ কেজি ১৫৯ গ্রাম স্বর্ণের তদন্তভার গ্রহণ করার পর চট্টগ্রামে সিআইডি সোহেলকে রিমান্ডে নেয়। সেখানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়ার পর ২১ ডিসেম্বর আবার ৫ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয় সোহেলকে। সর্বশেষ ২৯ ডিসেম্বর সোহেল ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন চট্টগ্রাম চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে। ওই জবানবন্দিতে জব্দ করা ৪ কেজি ১৫৯ গ্রাম স্বর্ণের মূল হোতা হিসেবে এসেছে সাতকানিয়ার উপজেলার উত্তর কাঞ্চনা এলাকার আব্দুল গফুরের দুই পুত্র জাহাঙ্গীর ও সায়েমের নাম।

গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে জব্দ করা স্বর্ণ আটকের দিন সোহেলের সঙ্গে একই ফ্লাইটে দুবাই থেকে দেশে আসেন সায়েম— আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে এমন তথ্যও দিয়েছেন সোহেল। একই সঙ্গে তাতে এসেছে হাটহাজারীর দুবাইপ্রবাসী মো. হাশেমের নামও।

এদিকে আদালতে সোহেলের জবানবন্দিতে জাহাঙ্গীর, সায়েম ও হাশেমের নাম আসার পরপরই তারা তড়িঘড়ি গত ৬ জানুয়ারি ৬ সপ্তাহের জন্য অস্থায়ী আগাম জামিন নিয়েছেন বলে জানা গেছে নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে। আগাম ওই জামিনের মেয়াদ শেষ হলে নিম্ন আদালতের মাধ্যমে নতুন করে জামিন নেওয়ার কথাও রয়েছে বলে জানা গেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরীর রিয়াজউদ্দিন বাজারের রিজুয়ান কমপ্লেক্স ও চৌধুরী মার্কেটে মোবাইল ফোনের তিনটি দোকান রয়েছে আলমগীর, সায়েম ও শাহজাহানের। চট্টগ্রাম নগরের স্টেশন রোড এলাকায় প্যারামাউন্ট সিটিতে রয়েছে জাহাঙ্গীরের অফিস। নগরীর জামালখান মোমিন রোডে ইকুইটির একটি ভবনে দেড় কোটি টাকার মূল্যের দুই হাজার স্কয়ার ফিটের একটি ফ্ল্যাট রয়েছে তাদের। এছাড়া নগরীর ঈদগাওঁ বৌবাজার এলাকায় রয়েছে জায়গাসহ নিজস্ব বাড়ি। আলমগীরের নামে চট্টমেট্রো-গ ১৩-৪০৫৭ নম্বরের একটি এলিয়েন গাড়িসহ রয়েছে চট্টমেট্রো-ম ০০০১১৭ নম্বরের অর্ধকোটি টাকার মূল্যের প্রাইভেট কার।

সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮ সালের শুরুতে দুবাই থেকে মোবাইল এনে চট্টগ্রামে ব্যবসা পরিচালনা করতেন আলমগীর। ২০১০ সালে ৭০০ পিস মোবাইল ফোনসহ আলমগীর আটক হন চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে। এরপর ২০১৫ সালের এপ্রিলে ২০ পিস স্বর্ণের বারসহ শাহ আমানত বিমানবন্দরে আটক হন দুবাইফেরত নুরুল ইসলাম। এই ঘটনায় আলমগীরসহ তার ভাইদের নাম আসলেও তদন্ত কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে কৌশলে মামলা থেকে নিজেদের নাম সরাতে সক্ষম হন তারা। এরপর বেশ কিছুদিন চোরাচালানের কারবারে কিছুটা ধীরগতি থাকলেও ২০১৯ সাল থেকে পূর্ণ উদ্যমে স্বর্ণ চোলাচালান ও বিদেশি মুদ্রা পাচারের কাজ চালাতে থাকেন চার ভাই মিলে।

জানা গেছে, জাহাঙ্গীর দুবাই থেকে অবৈধ পথে স্বর্ণের বড় চালান দেশে পাঠান দুবাই থেকে সাধারণ যাত্রীদের ম্যানেজ করে। দেশে বিমানবন্দরে কর্মরত কিছু অসৎ কর্মকর্তা, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব পালন করেন আলমগীর। যাত্রী বিমানবন্দর থেকে বের হওয়ার পর সড়কে নিরাপত্তা দিয়ে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যান তাদের বাকি দুই ভাই সায়েম ও শাহজাহান। তারা চার ভাই প্রতি মাসে ৪ থেকে ৫ বার চট্টগ্রাম থেকে দুবাই আসা-যাওয়া করেন বলে জানা গেছে।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো মিথ্যা। ব্যবসায়িক শত্রুতার জের ধরে তদন্তে আমাদের নাম ওঠানো হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে পতেঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কবির হোসেন বলেন, ‘৪ কেজি ১৫৯ গ্রাম স্বর্ণের মামলাটি থানায় দায়ের হওয়ার পর আসামি সোহেলকে আদালতের মাধ্যমে ৫ দিনের রিমান্ডে আনা হয়। সেখানে জব্দকৃত স্বর্ণের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে দুই ভাই জাহাঙ্গীর ও সায়েমসহ হাটহাজারী এলাকার দুবাইপ্রবাসী হাশেমের। পরে আদালতের মাধ্যমে এই মামলাটির তদন্তভার নেয় সিআইডি।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগরের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) চট্টগ্রামের সংশ্লিষ্ট পুলিশ পরিদর্শক ফজলুল কাদের চৌধুরী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!