চট্টগ্রামে ২১ বছর ধরে কৃষকের টাকা মেরে খাচ্ছিল সোনালী ব্যাংকের দুই ম্যানেজার

একজনের ৭ বছর কারাদণ্ড, আরেকজনের ১৫ বছর

মাত্র ১০০ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে চট্টগ্রামের এক ব্যাংকারকে দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ছাড়াও ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। জরিমানার টাকা শোধ না করলে আরও চার মাস জেল খাটতে হবে ওই ব্যাংকারকে। এমন ঘটনা চমকে যাওয়ার মতো হলেও এই একই ব্যাংকার এর মাত্র দুদিন আগেও ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে পেয়েছেন ৫ বছরের কারাদণ্ড। তার বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা বর্তমানে রয়েছে রায়ের অপেক্ষায়। শুধু তাই নয়, ওই একই শাখায় কর্মরত তার আগের ম্যানেজারও কৃষকের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় মাত্র চার মাস আগে পেয়েছেন ১৫ বছরের কারাদণ্ড।

সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজ মুনসী আবদুল মজিদের দেওয়া রায়ে কারাদণ্ডের আদেশ পাওয়া ওই ব্যাংকারের নাম মো. ইউনুস (৫০)। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মৈশামুড়া এলাকার আলী হোসেনের ছেলে। ১৯৯৭ সালে সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের মরফলা বাজারে সোনালী ব্যাংকের কৃষি শাখার ইনচার্জ থাকা অবস্থায় ১০০ টাকা আত্মসাৎ করার ওই অভিযোগ ওঠে।

মরফলা বাজারে সোনালী ব্যাংকের ওই কৃষি শাখা থেকে টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ওই শাখায় কর্মরত এর আগের ম্যানেজার শাহ আলমের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ। সদ্য দণ্ডিত মো. ইউনুসের আগে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শাহ আলম ছিলেন ওই শাখার দায়িত্বে।

বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্পেশাল জজের রায়ে আসামি মো. ইউনুসকে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারায় এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও দুই মাসের কারাদণ্ড, ৪২০ ধারায় ছয় মাসের কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ছয় মাস কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় এই মামলায় অভিযুক্ত অপর একজন সোনালী ব্যাংক মরফলা বাজার শাখার বার্তাবাহক মঞ্জুরুল ইসলামকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়।

তবে ওই ব্যাংকারের বিরুদ্ধে কৃষকের জমা দেওয়া টাকা আত্মসাতের এটিই একমাত্র মামলা নয়। ম্যানেজার মো. ইউনুসের বিরুদ্ধে রয়েছে আরও ছয়টি মামলা। গত মঙ্গলবারও (২২ ফেব্রুয়ারি) তাকে আত্মসাতের অন্য একটি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ঋণ জালিয়াতির মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের প্রায় ১ কোটি ৪২ লাখ টাকা আত্মসাতের দায়ে মো. ইউনুসকে ৫ বছরের ওই কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার বিরুদ্ধে আরও চারটি মামলা বর্তমানে রয়েছে রায়ের অপেক্ষায়।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সাতকানিয়ায় সোনালী ব্যাংকের মরফলা বাজার শাখার ইনচার্জ থাকা অবস্থায় মো. ইউনুস কৃষক ও স্বল্প আয়ের মানুষদের কাছ থেকে সঞ্চয় জমা নিতেন। তবে কৃষকদের জমা দেওয়া সেই টাকা ব্যাংকের বালাম বইয়ে জমার হিসাব তুলতেন না। পরে বিষয়টি ব্যাংকের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তদন্তের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তদন্তে মো. ইউনুসের বিরুদ্ধে কৃষকের জমা দেওয়া টাকা আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণিত হয়। এভাবে তিনি কয়েক বছরে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেন।

এরপর ২০০১ সালের ৩১ মে সোনালী ব্যাংক সাতকানিয়া উপজেলা শাখার ম্যানেজার আব্দুস সবুর সাতকানিয়া থানায় এ নিয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তভার পড়ে চট্টগ্রামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপসহকারী পরিচালক ছাইফুল্লাহ মো. এমরানের হাতে। ওই বছরের ৩০ নভেম্বর মো. ইউনুস ছাড়াও সোনালী ব্যাংক মরফলা বাজার শাখার বার্তাবাহক মো. মঞ্জুরুল ইসলামকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।

পরে আত্মসাতের এই ঘটনায় ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মোট ছয় বছরের জন্য ছয়টি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে ১৯৯৭ সালের ২১ মে ও ২৩ মে আত্মসাৎ করা হয় মাত্র ১০০ টাকা। বৃহস্পতিবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) সেই মামলারই রায় ঘোষিত হল।

আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ার পর থেকেই সাতকানিয়ায় সোনালী ব্যাংকের মরফলা বাজার শাখার ইনচার্জ মো. ইউনুস পলাতক রয়েছেন। ফলে তার অনুপস্থিতিতেই এ পর্যন্ত দুটি মামলার রায় ঘোষণা করা হল।

ইউনূসের আগে শাহ আলমও ছিলেন একই অপকর্মে

সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের মরফলা বাজারে সোনালী ব্যাংকের কৃষি শাখা থেকে টাকা মেরে দেওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। ওই শাখায় কর্মরত এর আগের ম্যানেজার শাহ আলমের বিরুদ্ধেও রয়েছে একই অভিযোগ। সদ্য দণ্ডিত মো. ইউনুসের আগে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত শাহ আলম ছিলেন ওই শাখার দায়িত্বে।

গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ১৯৯১ সালে দায়ের হওয়া এক মামলায় ওই শাখার ম্যানেজার শাহ আলমকে গত বছরের ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিভাগীয় বিশেষ জজ মুন্সী আবদুল মজিদ এক রায়ে দুটি পৃথক ধারায় মোট ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেন। সোনালী ব্যাংকের ওই শাখা থেকে কৃষিখাতে ‍ঋণ নেওয়া এক গ্রাহক ৯০ হাজার ৫১৩ টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল সময়ের মধ্যে ধারাবাহিকভাবে পরিশোধ করা সেই টাকা ব্যাংকে জমা না দিয়ে ব্যবস্থাপক শাহ আলম আত্মসাত করেন। বছরওয়ারি পরিশোধকৃত টাকা আত্মসাতের ঘটনায় তৎকালীন দুর্নীতি দমন ব্যুরো ১৯৯২ সালে শাহ আলমের বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা দায়ের করে। এর মধ্যে ১৫ বছরের কারাদণ্ড হয় প্রথম মামলার রায়ে।

মো. ইউনুসের মতো শাহ আলমও আত্মসাতের ঘটনা ধরা পড়ার পর থেকে পলাতক রয়েছেন।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm