চট্টগ্রামে সনাতনী সম্প্রদায়ের শীর্ষ নেতাসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা প্রত্যাহার ও আট দফা দাবিতে গণসমাবেশ করেছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংগঠন বাংলাদেশ সনাতন জাগরণ মঞ্চ। প্রতিবাদ সমাবেশে আসার পথে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সংঘাত ছাড়াই সমাবেশটি সম্পন্ন হয়।
শুক্রবার (১ নভেম্বর) বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত এ সমাবেশ থেকে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সমাবেশ শেষে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চের ঘোষণা, ১৯ নেতার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি প্রদান ও সোমবার পর্যন্ত আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।
এদিকে সনাতন জাগরণ মঞ্চের এই প্রতিবাদ সমাবেশে আসার পথে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। সমাবেশের আগে বিকেল থেকেই চেরাগী পাহাড় মোড়, আসকার দীঘির পাড়, কাজীর দেউড়ি, জামালখান চত্বর, চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ও আন্দরকিল্লায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা গেছে।
বেলা আড়াইটার পর থেকে চট্টগ্রাম নগর এবং বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে লোকজন সমাবেশে আসতে শুরু করে। বেলা তিনটার মধ্যে চেরাগী পাহাড় এলাকা জড়ো হতে থাকে মানুষের ঢল। শুধু চেরাগী পাহাড়ই নয়, কাজীর দেউড়ি থেকে শুরু করে নন্দনকানন, জামালখান ও আন্দরকিল্লায়ও ব্যাপক জনসমাগম হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল বিভিন্ন দাবিসম্বলিত ব্যানার ও ফেস্টুন।
সমাবেশে যোগ দিতে যাওয়ার সময় আসকার দীঘির পাড়, জামালখান মোড়, আন্দরকিল্লা ও বৌদ্ধমন্দির মোড়ে বাধা দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। তবে সেই বাধা উপেক্ষা করে চেরাগী পাহাড় মোড়ের চত্বরে অবস্থান নেন অসংখ্য মানুষ। বাধা দেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে একপর্যায়ে চেরাগী চত্বর থেকে হাজার হাজার মানুষ জামালখান, নন্দনকানন ও আন্দরকিল্লার দিকে এগিয়ে যায়।
জামালখান এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যারিকেড ডিঙ্গিয়ে কাজীর দেউড়ির দিকে এগিয়ে যায় অসংখ্য মানুষ। মিছিলে এ সময় ‘তুমি কে আমি কে সনাতনী সনাতনী’, ‘কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ দাদার’, ‘মামলা দিয়ে আন্দোলন, বন্ধ করা যাবে না’, ‘সাম্প্রদায়িক কালো হাত, ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও’, ‘চিন্ময় প্রভুর কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’, ‘আমার মাটি আমার মা, এ দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না’, ‘জয় শ্রী রাম’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেয় হাজার হাজার নারী-পুরুষ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন জায়গায় বাধা দিলেও শেষ পর্যন্ত কোনো সংঘাত-সংঘর্ষ ছাড়াই বিকেল সোয়া পাঁচটায় সমাবেশ শেষ হয়।
সমাবেশ থেকে স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে সমবেত হয়েছি। কিন্তু নগরের জামালখান, আসকারদীঘির পাড়, নন্দনকানন ও আন্দরকিল্লা এলাকায় লোকজনকে সমাবেশে আসতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। যদি মিছিল আসতে দেওয়া না হয় তাহলে আমরা মিছিল নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন স্থানে আটকে দেওয়া লোকজনকে নিয়ে আসব।’
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক কুশল বরণ চক্রবর্তী বলেন, ‘মিথ্যাচারেরও একটা সীমা আছে। ঢাকা থেকে একজন হিন্দুবিরোধী সাংবাদিক উস্কানি দিয়েছে, তার উস্কানি থেকেই এই ফিরোজ খান মামলা করেছে।’
‘সনাতন সম্প্রদায় শতভাগ রাজাকারমুক্ত’ উল্লেখ করে কুশল বরণ বলেন, ‘১৯৭১ সালে অন্যন্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মাঝেও দেশবিরোধী মানুষ ছিল। হিন্দু সম্প্রদায়ে দেশবিরোধী কোনো মানুষ নেই। আমাদের বেদে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে ভালোবাসি। রামায়ণে বলা আছে, জননী ও জন্মভূমি স্বর্গপর চেয়েও শ্রেষ্ঠ। আপনারা আমাদের দেশপ্রেম শেখাতে আসবেন না। সারা পৃথীবিতে হিন্দু সম্প্রদায়কে চেনে তাদের দেশপ্রেমের কারণে। আমরা এ ভূমিকে ভালোবাসি। আমাদের সাথে অন্যায় করবেন না।’
স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ও সুমন দে’র সঞ্চালনায় সমাবেশে আরও বক্তব্য রাখেন বিপ্লব চৈতন্য মহারাজ, অজপানন্দ ব্রহ্মচারী, রণনাথ ব্রহ্মচারী, রিগান চৈতন্য দাস, তাপসানন্দ ব্রহ্মচারী, অকিঞ্জন গোর দাস ব্রহ্মচারী, দারুব্রহ্ম জগন্নাথ দাস ব্রহ্মচারী,সুচারু কৃষ্ণ দাস,পরিতোষানন্দ মহারাজ,শ্রীল সুধারাম মহারাজ, মিলন শর্মা, কুশল বরণ চক্রবর্তী, কাঞ্চন আচার্য, যীশুময় দেব, জুয়েল আইচ, সুব্রত দাস আকাশ, রুবেল দাস,লিংকন তালুকদার, সুহৃদ গৌরাঙ্গ দাস, অমিত পাড়িয়াল প্রমুখ।
গত বুধবার চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালী থানায় সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। গত ২৫ অক্টোবর সনাতন জাগরণ মঞ্চ আট দফা দাবিতে লালদীঘি মাঠে সমাবেশের আয়োজন করে। ওই সমাবেশ থেকে যাওয়ার সময় নিউমার্কেট এলাকায় জাতীয় পতাকার অবমাননার অভিযোগে মামলাটি করেন নগরের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. ফিরোজ খান।
এই মামলার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেলে নগরের চেরাগী পাহাড় মোড়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে সনাতন জাগরণ মঞ্চ। এতে শুক্রবার ৬৪ জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেওয়া হয়। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামের সমাবেশ হয় চেরাগী মোড়ে।
এদিকে সংগঠনকে না জানিয়ে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করায় শুক্রবার (১ নভেম্বর) সকালে এক চিঠির মাধ্যমে তাকে বহিষ্কার করেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার সভাপতি মোহাম্মদ আজম ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. গিয়াস উদ্দিন ভুঁইয়া।