কখনও সরকারি কর্মকর্তা, কখনও সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেন তিনি। সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে করেন চাঁদাবাজি। তার ফেসবুক আইডিতে আজাদী টিভিসহ কয়েকটি দৈনিকে কর্মরত হিসেবে উল্লেখ আছে। কাভার ফটোতে আছে বাংলাটিভির লোগোও। কিন্তু এর সবই ভুয়া। আদতে তিনি একজন প্রতারক, এভাবেই ‘সাংবাদিক’ হিসেবে নাম বেচে প্রতারণা করে চলেছেন দীর্ঘদিন। বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার হলেও তার চরিত্র বদলায়নি। এবার তিনি ধরা পড়েছেন র্যাবের হাতে।
ওই প্রতারকের নাম সৈয়দ মিজান উল্লাহ সমরকন্দী। তিনি চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পুরানগড় এলাকার বাসিন্দা।
বুধবার (২৪ জানুয়ারি) সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় দীর্ঘদিন ধরে পলাতক মিজানকে নগরীর পাহাড়তলী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-৭।
এর আগেও নগরীর কর্ণেলহাট, হালিশহর, বন্দর ছাড়াও জেলার রাঙ্গুনিয়া ও সাতকানিয়ায় কয়েকবার আটক হন প্রতারক মিজান উল্লাহ সমরকন্দী। কখনও ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, আবার কখনও এনজিওর নির্বাহী পরিচালক হিসেবে পরিচয় দিতে তিনি। একেক সময় একেক পরিচয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতেন। পারভীন আক্তার নামের এক নারীর প্রধান সহযোগী হিসেবে মাইক্রোবাসে ঘুরে ঘুরে কথিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান পরিচালনা করতেন। এভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে তারা টাকা আদায় করতেন। প্রতিবারই ছাড়া পেয়ে ফের একই প্রতারণা করেন তিনি। পারভীন আক্তার ও মিজান উল্লাহ সমরকন্দী পরস্পরকে স্বামী-স্ত্রী হিসেবেও পরিচয় দেন।
তার প্রতারণার ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হয়েছে শ্রমজীবী দরিদ্র মানুষ থেকে শুরু করে চাকরিপ্রত্যাশী বেকার যুবকও। ‘স্বীকৃতি’ নামে একটি এনজিওর নাম দিয়ে চাকরির বিজ্ঞপ্তি দেয় একটি আঞ্চলিক দৈনিকে। ২০১৮ সালে ওই এনজিওর নামে চট্টগ্রাম মহানগরসহ বিভিন্ন উপজেলায় অবস্থিত শাখা অফিসে নিয়োগ পাওয়া ২৬ জন কর্মকর্তার জামানতের ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক পারভীন আক্তার ও সহযোগী মিজান। প্রতারণার শিকার হওয়া কর্মকর্তারা স্বীকৃতি এনজিওর নির্বাহী পরিচালকের কাছে বার বার ধর্না দিয়েও কোন ফল পায়নি।
এছাড়া ২০১৮ সালের ৬ মে দুপুরে রাঙ্গুনিয়ার রাজানগর ইউনিয়নের রাণীরহাট বাজারে বিলাসবহুল ‘চ্যানেল আজাদী’ লেখা স্টিকার লাগানো প্রাইভেট কারে (চট্টমেট্রো-গ ১১-৬৩১৪) চড়ে নিজেদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে চাঁদাবাজি করার সময় স্থানীয় ব্যবসায়ীদের কাছে আটক হন সৈয়দ মিজান উল্লাহ সমরকন্দি ও পারভীন আকতার। তারা রাণীরহাট বাজারের সাজ্জাদ বেকারিতে গিয়ে নিজেদের পরিবেশ আদালতের ভ্রাম্যমাণ ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের চেষ্টা চালান। অনেক দেনদরবারের পর ছয় হাজার টাকা জরিমানা আদায় করে সটকে পড়ার সময় সন্দেহ হলে তাদের চ্যালেঞ্জ করেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা তাদের ধাওয়া করে এক কিলোমিটার দুরে চট্টগ্রাম-রাঙামাটি সড়কের কাউখালী রাস্তার মাথা থেকে গাড়িসহ আটক করেন।
এরপর ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি দুপুরে নগরীর কর্ণেলহাট এলাকায় বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক ওষুধালয় নামে একটি দোকানে ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয়ে চাঁদাবাজির সময় সৈয়দ মিজান উল্লাহ (৩৫) ও ফারদিন আহমেদ (২৪) নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে আকবর শাহ থানার পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মিজানের স্ত্রী ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট পারভীন আকতার পালিয়ে যান।
জানা গেছে, ফেসবুকে ‘মিজান উল্লাহ সমরকন্দী’ নামে তার একটি আইডি আছে। সেখানে তার ব্যক্তিগত তথ্যের ঘরে দেওয়া আছে তিনি আজাদীটিভির চেয়ারম্যান, দৈনিক শাহ আমানত পত্রিকার বার্তা সম্পাদক, জাতীয় দৈনিক আলোচিত প্রতিদিনের সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন। এছাড়া তার শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরে উল্লেখ আছে তিনি সাতকানিয়া সরকারি কলেজ, সরকারি সিটি কলেজ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন।
মিজানের বিরুদ্ধে চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ, পতেঙ্গা, পাঁচলাইশ, সাতকানিয়া থানায় চাঁদাবাজি ও দস্যুতা মামলা রয়েছে পাঁচটি।
র্যাব-৭ জানায়, ভুয়া সরকারি কর্মকর্তা, সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজি করতেন তিনি। এছাড়া দস্যুতা মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত পলাতক আসামিও তিনি। পরে তিনি পাহাড়তলী এলাকায় অবস্থান করছে জানতে পেরে গ্রেপ্তার করা হয়।
তার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা হওয়ার পর নগরীর বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন ছিলেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান তিনি। আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ শেষে সাতকানিয়া থানায় তাকে হস্তান্তর করা হয় বলে জানায় র্যাব।
আরএ/ডিজে