চট্টগ্রামে ‘সিনেম্যাটিক স্টাইলে’ ঘাট দখল করলেন আওয়ামী লীগ নেতা

একদিনের মাথায় পুনরুদ্ধার বন্দর কর্তৃপক্ষের

চট্টগ্রাম বন্দরের ইজারা থাকা সত্ত্বেও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে জোরপূর্বক বঙ্গোপসাগর লাগোয়া চরপাড়া ঘাট দখলের অভিযোগ ওঠেছে বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতার বিরুদ্ধে। তবে ঘাটটি দখলের পরদিনই দখলদারদের উচ্ছেদ করে প্রকৃত ইজারাদারকে বুঝিয়ে দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।

দখলদারদের একজন জানান, স্থানীয় সাংসদ এমএ লতিফের নাম ভাঙিয়ে একটি গ্রুপ ঘাট দখল করতে আসে। তবে এমপি লতিফ দু’গ্রুপ চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে জানান, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা অন্যকারও এটা দখল করার নিয়ম না।

তবে ইজারাদার জানান, ঘাট দখলের সময় দখলকারীরা এমপি লতিফের নাম ব্যবহার করেছেন। এই বিষয়ে কথা বলতে তারা সাংসদ এমএ লতিফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু এমএ লতিফ তাদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

জানা গেছে, চরপাড়া ঘাটটির ইজারদার হিসেবে ‘সী মেরিটাইম সার্ভিসেস’ নামের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ২০২২সালের ১৭ জুন এক কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার টাকায় এক বছরের জন্য চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৮ জুন ঘাটটি বুঝিয়ে দিলেও ইজারাদারকে টোল তোলা অনুমতি দেয়নি বন্দর। পরে ২০২২ সালের ২১ মে ঘাট দিয়ে একজন মানুষ নামার ক্ষেত্রে টোল ১০টাকা, ২০ কেজি পণ্য নামালে টোল ফ্রি, ২১ কেজি থেকে ৪০ কেজিতে ২০ টাকা, ৪০ কেজির ঊর্ধ্বে পণ্যের জন্য ৫০ টাকা নির্ধারণ করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে টোল তোলার অনুমতি দেয়। সেই থেকে ২০২২ সালে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ মাস ঘাটে টোল আদায় করে সী মেরিটাইম সার্ভিসেস। এরপর ঘাটে টোল আদায় নিয়ে লাইটার শ্রমিকরা আন্দোলনে নামে।

পরে বন্দর কর্তৃপক্ষ, ঠিকাদার, আন্দোলনকারী শ্রমিক নেতারা, স্থানীয় ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে একই বছরের ১১ নভেম্বর বন্দর ভবনে একটি বৈঠক হয়। সেখানে ইজারার মেয়াদ থাকলেও টোল না তোলার জন্য ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে বলে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সেই নির্দেশনা মেনে আসলেও হঠাৎ ১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে ঘাট দখলে যায় ৭০ থেকে ৮০ জনের একটি গ্রুপ। এই সময় ঠিকাদারের আট কর্মচারীকে বিতাড়িত করে ঘাটটি দখলে নেয় তারা।

ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঘাটটি দখলের নেতৃত্ব দেন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আসলাম, আক্কাস সাওদাগর, হারুনুর রশিদ কোম্পানি ও চরপাড়া এলাকার ফোরকার, আব্দুর রহিম, জিয়া, নাজিম, হানিফরা। এদের মধ্যে আসলাম সরকার দলীয় নেতা হলেও অন্যরা আওয়ামী লীগ নেতা নামধারী ওই এলাকার চোরাকারবারি।

Yakub Group

ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সী মেরিটাইম সার্ভিসেস’র ব্যবসায়িক পার্টনার জাহাঙ্গীর হোসেন শান্ত দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চরপাড়া ঘাটে গত ১৮ সেপ্টেম্বর বিকালে সাবেক কাউন্সিলর মো. আসলাম, আক্কাস সওদাগর, হারুন কোম্পানিসহ প্রায় ৭০-৮০ জনের একটি সন্ত্রাসী গ্রুপ ঘাট দখল করতে আসে। তারা আমাদের ৮ কর্মচারীকে বের করে দিয়ে ঘাট দখলে করে। বড় ধরনের সংঘর্ষ এড়াতে বিষয়টি আমরা সঙ্গে সঙ্গে মুঠোফোনে বন্দর কর্তৃপক্ষের এসিসটেন্ট ম্যানেজার (এস্টেট) শিহাব উদ্দিনকে জানাই। পরে মঙ্গলবার (১৯ সেপ্টেম্বর) সকালে বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করলে বন্দর কর্তৃপক্ষের এসিসটেন্ট ম্যানেজার (এস্টেট) শিহাব উদ্দিনের নেতৃত্বে পতেঙ্গা থানা পুলিশের সহযোগিতায় অবৈধ দখলদার সরিয়ে আমাদের ঘাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয়।’

অভিযোগকারী সী মেরিটাইম সার্ভিসেস’র স্বত্বাধিকারী জয়দেব চন্দ্র রায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পতেঙ্গা চরপাড়া ঘাটের ইজারা নিয়ে আমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত। আমি বন্দর কর্তৃপক্ষকে আগেও বেশ কয়েকবার মৌখিকভাবে এবং সর্বশেষ লিখিতভাবে ইজারা বাতিল করে টাকা ফেরত চেয়ে আবেদন করেছি। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারাকৃত চরপাড়া ঘাট শ্রমিকদের জন্য টোল ফ্রি করার কারণে আমরা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। চরপাড়া ঘাটে আমাদের কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও স্টাফদের বেতন দিতে হচ্ছে। ইজারা বাতিল না হওয়া পর্যন্ত এই ঘাটে বড় কোনো দুঘর্টনা ও সরকারি জিনিস চুরি হলে তার দায় আমাদের ওপর পড়বে।’

তিনি বলেন, ‘আমি ঘাট ইজারা নেওয়ার পর গত দেড় বছরের মধ্যে ব্যবসা করতে পেরেছি মাত্র সাড়ে ৪ মাস। অথচ ঘাট ইজারা পেতে আমার খরচ হয়েছে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ ১০ হাজার টাকা। স্থানীয় সাংসদ এমএ লতিফের নাম ভাঙিয়ে পরিকল্পিতভাবে আমাদের ঘাট দখল করে। পরদিন বন্দর কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ প্রসাশনের হস্তক্ষেপে ঘাট আমাদেরকে ফিরিয়ে দেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।’

এই বিষয়ে অভিযুক্ত হারুন কোম্পানি ও আক্কাস সাওদাগরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, ‘পতেঙ্গা চরপাড়া ঘাট কে বা কারা দখল করেছে, তা আমরা জানি না।’

তবে ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর মো. আসলাম বলেন, ‘পতেঙ্গা চরপাড়া ঘাট ব্যবহার করতে লাইটারেজ জাহাজের শ্রমিকদের ২০ টাকার ভাড়া স্থানে ২০০ টাকা দিতে হয়। শ্রমিকরা নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছে। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইজারাকৃত চরপাড়া ঘাটের টোল ফ্রি করার পরও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে ইজারাদাররা। চরপাড়া ঘাটের ইজারাদারদের মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। চট্টগ্রাম-১১ আসনের সাংসদ এমএ লতিফের নির্দেশে আমরা ঘাটে গিয়েছি। অতীতেও লাইটারেজ জাহাজ শ্রমিকরা চরপাড়া ঘাটে টোল ফ্রি ঘোষণায় কর্মবিরতি করেছেন। ঘটনার সত্যতার জন্য আপনারা এমপি লতিফের সঙ্গে কথা বলুন। রোববার (২৪ সেপ্টেম্বর) বন্দর চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ নেবেন এমপি সাহেব।’

জানতে চাইলে স্থানীয় সাংসদ এমএ লতিফ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখানে দুই গ্রুপই চাঁদাবাজ। কে বা কারা কি বলেছে, এটা আমার বিষয় নয়। এটি মানুষ পারাপারের ঘাট নয়। এটি মূলত নৌ-শ্রমিকদের ব্যবহারের জন্য। বন্দর কর্তৃপক্ষ যাদের ইজারা দিয়েছে তাদের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এখন এটি নৌ-শ্রমিকদের দখলে থাকার কথা। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা কিংবা অন্যকারও এটা দখল করার নিয়ম না।’

তবে ঘাটের ইজারা বাতিল হয়নি জানিয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, ‘ইজারাদার থাকা সত্ত্বেও চরপাড়া ঘাটটি অপর একটি পক্ষ দখল করতে গিয়েছিল।

তিনি বলেন, পরদিন তাদের সরিয়ে ঠিকাদারদের ঘাট বুঝিয়ে দিয়েছে। এখানে সাংসদ এমএ লতিফ জড়িত বলে আমরা কোনো খবর পাইনি।’

ইজারা বাতিল করে টাকা ফেরত দিতে ঠিকাদারের আবেদনের বিষয়ে বন্দর সচিব বলেন, ‘ঠিকাদার বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করলে ইজারা বাতিল করে টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষকে কিছু নিয়ম মেনেই তা করতে হবে। তাই তাদের টাকা ফেরত দিতে সময় লাগছে।’

এই বিষয়ে পতেঙ্গা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আফতাব হোসেন জানান, চরপাড়া ঘাটে মাঝিদের মধ্যে কথাকাটি হয়েছে। চরপাড়া ঘাট দখলের কোনো ঘটনা ঘটেনি।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!