চট্টগ্রামে সরে যাচ্ছে পরিবারের ছায়া, সাড়ে ৮০০ পঞ্চাশোর্ধের মৃত্যু ১৬ মাসে

বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন বেশি বাসার তরুণ সদস্যদের মাধ্যমে

২০২০ সালের ৯ এপ্রিল চট্টগ্রামে করোনাভাইরাসে প্রথম যার মৃত্যু হয়, তিনি ছিলেন ৬৯ বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার পশ্চিম ঢেমশার বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম মারা গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসার পথে। তার এমন আকস্মিক মৃত্যুতে পুরো পরিবারই যেন ভেঙে পড়েছিল হতাশায়— পরিবারের ছায়া হারানোর বেদনায়।

সারা বাংলাদেশে করোনায় মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তিটিও ছিলেন ৭০ বছরের এক পুরুষ। সেই থেকে চট্টগ্রামই শুধু নয়, পুরো দেশজুড়েই সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছেন বয়স্করা। করোনায় বরাবরই তারা আছেন সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।

সরকারি হিসেবে গত প্রায় ১৬ মাসে চট্টগ্রাম মহানগরী ও ১৪ উপজেলায় ১ থেকে ৫০ বছর বয়সী মানুষ মারা গেছেন মোট ২২৫ জন। অন্যদিকে ৫১ থেকে ৬১ বছরের বেশি বয়সী মানুষ মারা গেছেন প্রায় চারগুণ বেশি— ৮৩৪ জন।

এক করোনা এসে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পরিবারের ছায়াগুলো। একটা পরিবারের বাবা-মা, দাদা-দাদী যিনি পরিবারের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তি— তিনিই থাকেন পরিবারের ছায়া হয়ে। কিন্তু করোনায় সেই ছায়াগুলো যেন ক্রমেই সরে যাচ্ছে চট্টগ্রামের পরিবারগুলো থেকে। অন্য চিত্রও আছে। জীবিকার খোঁজে বেরিয়ে পরিবারের প্রধান লোকটিই পড়ে যাচ্ছেন করোনার কবলে। অনেকে সেই কবল থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেন না। ফলে সেই পরিবার ডুবে যাচ্ছে অনিশ্চয়তার অন্ধকারে। অনেক পরিবার হয়ে পড়ছে অভিভাবকহীন।

করোনার শুরু থেকে রোববার (৮ আগস্ট) পর্যন্ত চট্টগ্রামে ৫১ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১৩ হাজার ২৮৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৮ হাজার ১৯৭ জন আর মহিলা ৫ হাজার ৮৮ জন। অন্যদিকে এই বয়সী মারা গেছেন মোট ২৪২ জন— ১৩৮ জন পুরুষ ও ১০৪ জন নারী।

অন্যদিকে চট্টগ্রামে ৬১ থেকে এর বেশি বয়সী মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ১২ হাজার ৬৩১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৭ হাজার ৯০৪ জন এবং মহিলা ৪ হাজার ৭২৭ জন। অন্যদিকে এই বয়সী মারা গেছেন মোট ৫৯২ জন— ৪০৭ জন পুরুষ ও ১৮৫ জন নারী।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চট্টগ্রামে করোনায় ষাটোর্ধ যারা মারা যাচ্ছেন তাদের অধিকাংশের বয়স যেমন ৬০ এর বেশি, ঠিক তেমনি বেশিরভাগেরই একাধিক রোগ ছিল।

তারা বলছেন, যেসব মানুষের শরীরে প্রতিরোধী ব্যবস্থা কমে গেছে এবং অন্যান্য রোগ যেমন- ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার, ব্রঙ্কিওল অ্যাজমা রয়েছে এবং একইসাথে শরীরের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা কিছুটা কমে গেছে, সেই মানুষগুলোই বেশি মারা যাচ্ছে।

এছাড়াও শরীরচর্চার মতো অভ্যাসগুলো না থাকায় বয়স্করা বেশি মারা যাচ্ছেন করোনাভাইরাসে।

চট্টগ্রামে দেখা গেছে, ৩০ বছরের পর বহু মানুষই উচ্চ রক্তচাপ বা ডায়াবেটিসে ভুগছেন। অনেকে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম বয়সে। যুবকরা নানা কাজে বাসার বাইরে বের হয়। তারা সচল জনগোষ্ঠী, তাদের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।

এই যুবকদের মাধ্যমে বাড়ির বয়স্কদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। বাসার বয়স্করা যারা একদিনও বাইরে বের হন না, তারাও আক্রান্ত হচ্ছেন মূলত বাড়ির যুবক সদস্যদের মাধ্যমে। কিন্তু করোনার সাথে অন্য সব শারীরিক জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আইসিইউতে নিয়ে গিয়েও বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে না তাদের।

তবে যুবকরা জানছেন না তাদের মাধ্যমেও বাড়ির বয়স্করা আক্রান্ত হচ্ছেন। এ কারণে যুবসমাজের চলাফেরায় সাবধানতা অবলম্বন করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় আরও জোর দিতে বললেন চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের অ্যানেসথেসিওলজি বিভাগের প্রধান ও করোনা ট্রিটমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. অলক নন্দী।

রবিবার (৮ জুলাই) নূর নাহার বেগম (৫০) করোনায় আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তার বাড়ি মধ্যম পতেঙ্গার মাইজপাড়ায়। নূর নাহার বেগমের লাশ গোসল ও কাফন সম্পন্ন করে মরহুমার বাড়িতে পৌঁছে দেয় গাউছিয়া কমিটি। এই কমিটির করোনা ইউনিটের সমন্বয়ক মোসাহেব উদ্দিন বখতিয়ার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আমরা যেসব বয়স্ক নারী পুরুষের লাশ গোসল ও কাফন শেষে বাড়িতে পৌঁছে দিতে যাই পরিবারের সদস্যদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। আকস্মিক এসব মৃত্যু তারা মেনে নিতে পারেন না। অনেক পরিবারের মূল উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারের সদস্যরা হয়ে পড়েন দিশেহারা।

করোনা এসে পরিবারের মাথার ওপর থেকে এভাবেই সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এক একে ভরসার ছায়াগুলো।

আইএমই/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!