চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভূমিকম্প

চট্টগ্রামে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভূমিকম্প 1দেশ আর দলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি শতভাগ নিজের নিয়ন্ত্রণে বলে আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনা দলের নেতৃত্ব নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা করেন। সারা দেশে দলের নেতৃত্বে নানা জনকে সুযোগ দেন। সুযোগের অপব্যবহার করে ‘মুই কেউ হনুরে’ ভাব দেখলে তার ক্ষমতা কেড়েও নেন। ঢাকা দক্ষিণের পর যেটা তিনি করলেন চট্টগ্রামে।

ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন ১/১১-এর সময় জেনারেলদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটি ভুলে গিয়ে পিতা মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সম্মানে সাঈদ খোকনকে মনোনয়ন দিয়ে ঢাকা দক্ষিণের মেয়র করেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন কী কী করেছেন তা অনেকে না জানলেও শেখ হাসিনা জানতেন। অতএব এবার তাকে আর মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সাঈদ খোকনের একান্ত সচিবদের এখন দুদকে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। সে ঝড় থেকে মনে করা হচ্ছে সাঈদ খোকনও বাদ পড়বেন না। সর্বশেষ তিনি ঢাকা-১০ আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তা আমলে নেননি।

চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের কান্ডারী ছিলেন চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। তাঁর বয়স হওয়ায় একজন তরুণ প্রার্থী হিসাবে আ জ ম নাছিরকে বেছে নেন শেখ হাসিনা। কিন্তু তাকে নতুন প্রার্থী হিসাবে সুযোগ দিলেও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা বা তাঁর গুরুত্ব শেখ হাসিনা ভোলেননি। যা ভুলে গিয়েছিলেন আ জ ম নাছির। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মেয়র থাকতে আ জ ম নাছিরের অনুসারীদের অনুরোধে তার একটা ইন্টারভ্যু করেছিলাম জনকন্ঠে। আ জ ম নাছিরের বিরুদ্ধে তখন অনেক মামলা। বেশিরভাগ সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির। আমাকে তিনি বলেছিলেন এসব মামলা বিএনপির দেওয়া রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক। তখন তার স্বপ্ন ছিল চট্টগ্রামের প্রথম তরুণ মেয়র হবেন। শেখ হাসিনা তাকে সে সুযোগ দিয়েছিলেন। আর সুযোগ পেয়ে তিনি ধরাকে সরাজ্ঞান করেছিলেন।

ক্ষমতা পেয়ে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে আলাদা গ্রুপ নিয়ে চলতে থাকেন। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের করেন কোণঠাসা। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে একটি তোরণ নির্মানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে আ জ ম নাছির তা ভেঙ্গে দেন। এই ভেঙ্গে দেবার পর আ জ ম নাছির যদি অনুমোদনের ব্যবস্থা করে মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে কোন স্থাপনা গড়ে তুলতেন তা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগকে ঐক্যবদ্ধ করতো। শেখ হাসিনাও খুশি হতেন। কিন্তু আ জ ম নাছির যে মনে করেছিলেন তিনি ক্ষমতা পেয়ে গেছেন চিরদিনের জন্যে!

চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামে প্রতিবছর মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা করতেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী। সেই বিজয় মেলা এখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আ জ ম নাছির পূর্বসূরী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সেই ঐতিহ্য খর্ব করতে সেখানে গড়েন সুইমিংপুল! ঐতিহ্যবাহী স্থানটায় সুইমিংপুল না করার দাবিতে অনেক আন্দোলন হয়েছে চট্টগ্রামে। পরোয়া করেননি। চট্টগ্রামে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়া গেলে তাদের জনসভা করার মতো বড় জায়গা ছিল সেই আউটার স্টেডিয়াম। সেখানে সুইমিংপুল হয়ে যাওয়ায় জনসভা করার জায়গা না পেয়ে জনসভা করেছেন পটিয়ায়। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের অনেক দিন ধরে সারাদেশ জুড়ে কোন জনপ্রিয় ছাত্রনেতা নেই। ছাত্রদের ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন করার কারণে চট্টগ্রামের নুরুল আজিম রনি গোটা অঞ্চলের ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

এই ছেলেটির জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগাতে তাকে বুকে টেনে নিতে পারতেন চট্টল মেয়র। কিন্তু দেখা গেল শুধু এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হওয়ায় মেয়র তাকে নানাভাবে গ্রেফতার করান, আর ঢাকা থেকে তার জামিনে মুক্তির ব্যবস্থা করা হয়। এসব মুক্তির সঙ্গে যে গণভবনের লোকজন জড়িত— তা বোঝার ক্ষমতা হারিয়েছিলেন ক্ষমতায় অন্ধ আ জ ম নাছির। ঢাকা ঠিক রাখতে তিনি যাদের টাকাকড়ি দিতেন তারাও যে শুধু কর্মচারী সেটা তিনি ভুলে গিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা একজনকে ক্ষমতা দেন, আস্থা হারালে শেখ হাসিনাই যে তার ক্ষমতা কেড়ে নেন এটা যারা ভুলে বসে চলেন— আ জ ম নাছির ছিলেন সেই গোত্রের।

এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে চট্টগ্রাম ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর নগরী। সেটি এখন অন্যতম ময়লার ভাগাড়। দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম এখন জলাবদ্ধতার নগরী। বৃষ্টি হলেই আগ্রাবাদের মূল সড়কে নৌকা চলে। দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের কোণঠাসা করে দাগী সন্ত্রাসী, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরের লোকজনের নেতা হিসাবে বিপুল বিতর্কিত এখন আ জ ম নাছির। দলের তরুণ কর্মী দিয়াজ, সুদীপ্ত, সোহেল, মেহেদীদের প্রাণ কেন নেওয়া হয়েছে সে জবাব তাদের মায়েদের দেওয়া হয়নি। সেই মায়েদের অভিশাপেই কি কপাল পুড়লো আ জ ম নাছিরের? সে প্রশ্নও চলে এসেছে সামনে।

সর্বশেষ চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের এক নেতা প্রয়াত চট্টলবীর এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী হাসিনা মহিউদ্দিনকে মঞ্চে তুলেছিলেন শ্রদ্ধায়। আর আ জ ম নাছির তাঁকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেন অশ্রদ্ধায়! এক প্রকৌশলীকে চড় মারা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রকৌশলীদের আন্দোলনও তিনি ক্ষমতার দাপটে থামিয়ে দেন। তার সব ক্ষমতার অহমিকা শেখ হাসিনার এক সিদ্ধান্তে এখন পরিত্যক্ত হয়ে গেছে। কারণ সবাই জেনে গেছে গদি তার হয়ে গেছে খান খান।

আমি একটা কথা প্রায় লিখি। তা হলো, আওয়ামী লীগ নামের দলটি যে টানা ক্ষমতায় এর একমাত্র কারণ শেখ হাসিনার একক সাহসী পরিশ্রমী আত্মবিশ্বাসী নেতৃত্ব। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি টানা ১৮-২০ ঘন্টা কাজ করেন। আর তাঁর এই পরিশ্রমের ওপর ভর করে ক্ষমতার বলয়ে থাকা বেশিরভাগ নেতা করেন দুর্নীতি। এবং এসব শেখ হাসিনার হিসাবের মধ্যে পড়ে গেলে কে কখন বাদ পড়ছেন তা তিনি নিজেই সবার আগে আঁচ করতে পারেন। সাঈদ খোকন তা আগাম বুঝতে পেরে তার ‘রাজনৈতিক জীবন কঠিন অবস্থার মুখে’ বলে কেঁদেছেন। আর একই পরিস্থিতি টের পেয়ে বেশ কিছুদিন ঢাকায় ঘোরাফেরা করছিলেন আ জ ম নাছির।

বিশ্বকাপ বিজয়ী অনূধ ১৯ দলটি যেদিন ঢাকায় আসে তাদের অভ্যর্থনায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ছিলেন চসিক মেয়র। বিসিবির সদস্য হিসাবে তিনি বিমানবন্দরে থাকতেই পারেন। কিন্তু এমন অভ্যাস তার নিয়মিত ছিল না। সেদিন বিমানবন্দরে তাকেও হাসতে দেখা গেছে। কিন্তু সে হাসি ছিল কষ্ট-কল্পিত-ফ্যাকাসে। কারণ তিনি ততোক্ষণে পেয়ে গেছেন গণভবনের বার্তা। এতদিন ঢাকা ঠিক রাখতে তিনি যাদের নজরানা দিতেন বিপদের দিনে টের পেয়েছেন তারাও তার মতো নেহায়েৎ কর্মচারী। মুকুট হারালে কেউ আর মনিব থাকে না। খাঁটি কর্মচারীর ভূমিকায় ফিরে যায়। শেখ হাসিনার এক সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক ভূমিকম্প ঘটে গেছে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে। মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল করিম চৌধুরী নামের যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, তিনি আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ত্যাগী নেতা। ক্লিন ইমেজের এই নেতা প্রয়াত চট্টলবীর এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হিসাবে পরিচিত।

ওয়াকিফহালরা জানেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এবার এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার নওফেলকে প্রার্থী করার চিন্তা ছিল। কিন্তু ব্যারিস্টার নওফেল চট্টগ্রামের রাজনীতিতে জড়িত হতে অনিচ্ছা জানানোয় শেখ হাসিনা রেজাউল করিম চৌধুরীকেই প্রার্থী হিসাবে বেছে নেন। শেখ হাসিনার এই সিদ্ধান্ত আরেকটি বিষয় সামনে নিয়ে এসেছে। তা হলো আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দলের সারাদেশের ত্যাগী নেতাদেরও খোঁজ রাখেন। সুযোগমতো তাদের মূল্যায়নও করেন। শেখ হাসিনার অভিভাবকসুলভ এই গুণটি আওয়ামী লীগ নামের প্রাচীন দলটিকে এখনও প্রাণবন্ত করে রেখেছে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!