চট্টগ্রামে রেলের জায়গা দখল করে অপরাধীদের আস্তানা, নিয়ন্ত্রক দুই মাদক কারবারি

চট্টগ্রামে রেলের জায়গায় গড়ে ওঠা নগরীর পাহাড়তলীর স্ক্র্যাপ কলোনি অপরাধীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, মাদক বিক্রি থেকে শুরু করে নবজাতক বিক্রি—সবই হয় এসব এলাকায়। এই কলোনি প্রায় ৪০টিরও বেশি ঘর আছে, যা নিয়ন্ত্রণ করে দুই মাদককারবারি। এমনকি পুলিশ কুপিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে এই এলাকায়। মূলত এই এলাকাটি তিন থানার সীমানার মধ্যে হওয়ায় অপরাধীরা অপরাধ করে সহজেই পার পেয়ে যায়।

সম্প্রতি মাদকের বিরুদ্ধে পাহাড়তলীর এক স্কুলের শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা মানববন্ধন করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। এসব এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে রেলওয়ে অভিযান চালালেও দু’দিন পর আবারও দখল করে ভূমিদস্যুরা।

বুধবার (৪ জানুয়ারি) সকাল ১১টায় আকবরশাহের পাহাড়তলী স্ক্র্যাপ কলোনিতে সরেজমিন গিয়ে রেলের জায়গা দখল ও বস্তিতে মাদক বিক্রির সত্যতা পাওয়া গেছে।

গত ২৭ নভেম্বর বিভাগীয় রেল দপ্তরে পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা মানববন্ধন করে স্মারকলিপি দেয় রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এর প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীদের সাতদিনের সময় দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এরপর দু’মাস পার হলেও এখনও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ হয়নি।

জানা গেছে, পাহাড়তলীর স্ক্র্যাপ কলোনিতে গড়ে ওঠা বস্তিতে কাঁচা-পাকা ঘর আছে ৪০টিরও বেশি। এখানে বিভিন্ন ঘরে চলে মাদক বিক্রি ও সেবন। এছাড়া বিভিন্ন চুরি-ছিনতাই করা মালামালও বিক্রি করা হয় প্রকাশ্যে। একইসঙ্গে বস্তির লোকজন নবজাতকও বিক্রি করে মোটা অংকের বিনিময়ে। এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণে আছেন ফাতেমা (৩৭) ও জয়নাল (৫৫) নামের দুই মাদককারবারি। এই কাজের জন্য নিজস্ব বাহিনীও গড়ে তুলেছেন তারা।

এই দুই মাদককারবারির বিরুদ্ধে পাহাড়তলী, আকবরশাহ ও খুলশী থানায় ১০টিরও বেশি মামলা রয়েছে। এরমধ্যে চুরি, ছিনতাই, মাদক বিক্রি থেকে শুরু করে পুলিশের হাত থেকে আসামি ছিনতাইয়ের মামলাও রয়েছে।

Yakub Group

দিনের আলো নিভতেই শুরু হয় এই চক্রের অপরাধ। মূলত বস্তি এলাকাটি তিন থানার সীমানায় পড়েছে। বস্তির এলাকার ড্রেন পার হলেই আকবরশাহ থানার পাঞ্জাবি লেন। এরপর সরু গলি পেরিয়ে রাস্তায় ওঠে পুলিশবিট মোড়ের মাস্টার লেন খুলশী থানা ফাঁড়ির অন্তর্ভুক্ত। বস্তির পাশে রেললাইন পার হলেই পাহাড়তলী থানার সিগন্যাল কলোনি। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এক থানা এলাকায় অপরাধ ঘটিয়ে তারা চলে যায় আরেক থানা এলাকায়।

এই চক্রের সদস্য শাহ আলম, জসিম, গুরা বেলাল, মনা রেলের লোহা চুরিতে জড়িত বলে জানান রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবির) সিআই ইসরায়েল মৃধা।

ফাতেমা ও জয়নাল বাহিনীর অন্য সদস্যরা হলেন শাকিল, শাহ আলম, নুরনবী, কালি রাবেয়া ও নুরা। এদের প্রত্যেকে মামলার আসামি। এছাড়া শিশু বিক্রির সঙ্গে জড়িত চক্রের সদস্যরা হলেন কোহিনূর, রাবেয়া, তৃষা ও জোসনা।

জানা গেছে, ২০০১ সালে পাহাড়তলীর স্ক্র্যাব কলোনি ও আকবরশাহের নিউ শহীদ লেন বিহারি কলোনিতে মাদক ব্যবসা শুরু করেন ফাতেমা। এরপর তার সঙ্গে যোগ দেন জয়নাল। এভাবে তারা পুরো এলাকায় গড়ে তোলেন মাদক বাণিজ্য।

২০২২ সালের ১৫ এপ্রিল রাতে ছিনতাই হওয়া ফোন উদ্ধারে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিম এই বস্তিতে ঢুকলে তাদের ওপর হামলা করে ফাতেমা-জয়নাল বাহিনী। অভিযানে ফাতেমাসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও পালিয়ে যান জয়নাল।

এর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে আকবরশাহ থানার দুই এসআই ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি আনার পথে তাদের কুপিয়ে আসামি ছিনতাই করেন ফাতেমা-জয়নালের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা। পরে অভিযান চালিয়ে হ্যান্ডকাপটি উদ্ধার করা হয়।

২০২০ সালের ২৬ এপ্রিল রিকশা গ্যারেজ থেকে ১৮টি চুরি হওয়া রিকশাসহ জয়নালকে গ্রেপ্তার করে খুলশী থানা পুলিশ।

এছাড়া গত বছরের ২২ নভেম্বর গ্যারেজের ভেতর মাদক বিক্রি ও সেবনে বাধা দিলে মাস্টার লেন এলাকার মহিউদ্দিন (২৭) নামের এক যুবককে মারধর করা হয়। এ ঘটনায় খুলশী থানায় জয়নালসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। এতে আমির হোসেন, রুজি, আমেনাকে গ্রেপ্তার করা হলেও জয়নাল পালিয়ে যান।

অবৈধ স্থাপনার বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগীয় কর্মব্যবস্থাপক (পূর্ব) আবিদুর রহমান বলেন, এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বিভাগীয় ভূসম্পদ দপ্তরকে বলা হয়েছে।’

এ বিষয়ে বিভাগীয় ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা ও রেলওয়ের নির্বাহী মাজিস্ট্রেট মাহবুব উল করিম বলেন, ‘স্কুল শিক্ষার্থীদের স্মারকলিপি পেয়েছি। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

অপরাধের বিষয়ে আকবরশাহ থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওয়ালী উদ্দিন বলেন, ‘আমি আসার আগে ঘটেছে এসব ঘটনা। বিষয়টি আমার নজরে রয়েছে। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!