চট্টগ্রামে যুবলীগের কমিটি ‘ভাই’য়ের পছন্দে ভাগবাটোয়ারা, নাকি কর্মীদের চাওয়ায়?

নিখিল বলছেন, কার সাথে সুসম্পর্ক সেটা দেখার বিষয় না

চট্টগ্রাম মহানগর, দক্ষিণ ও উত্তর জেলা যুবলীগের নতুন নেতৃত্বের জন্য আগ্রহীদের দৌড়ঝাপে বেশ সরগরম চট্টগ্রামের রাজনৈতিক অঙ্গন। দীর্ঘদিন পর আওয়ামী লীগের অন্যতম এই সহযোগী সংগঠনে নতুন কমিটি গঠন প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই চট্টগ্রামের রাজনীতি সংশ্লিষ্টদের কাছে বেশ গুরুত্ব বহন করছে। তবে কোন্ প্রক্রিয়ায় এই নেতৃত্ব ঠিক করা হবে সেটা নিয়ে বরাবরের মতই প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন উঠছে যুবলীগে কি নেতৃত্ব নির্বাচন করা হবে নাকি বরাবরের মত ঢাকা থেকে ‘চট্টগ্রামের ভাইয়ের পছন্দের নেতৃত্ব’ চাপিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটবে এবারেও। এক্ষেত্রে বরাবরের মতই যুবলীগ নেতারা বলছেন দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন করতে যা যা করার দরকার তাই করবেন তারা।

অন্যদিকে বাস্তবতা হলো তিন ইউনিটের কোনোটিতেই সম্মেলন করে কর্মীদের চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করার পরিস্থিতি নেই একেবারেই। এমনকি এখন পর্যন্ত সে ধরনের পরিস্থিতি তৈরি করার কোনো উদ্যোগও দেখা যায়নি। ফলে সকলেই ধারণা করছেন প্রথম অধিবেশন শেষে কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা অর্পণের মধ্য দিয়েই শেষ হবে যুবলীগের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া।

এক্ষেত্রে বরাবরের মত চট্টগ্রাম নগরে আওয়ামী লীগের বড় দুই গ্রুপের দুই শীর্ষ নেতার হাতেই যুবলীগের চাবিকাঠি চলে যাবে— এমনটাই শঙ্কা কর্মীদের। নগরে যেমন, তেমনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ ও উত্তর জেলায়ও আওয়ামী লীগ থেকে যুবলীগ-ছাত্রলীগও চলে আসছে ‘ভাইদের পছন্দের নেতৃত্বে’। তবে সম্প্রতি স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটির পর সেই আলাপ কতটা প্রাসঙ্গিক সেটি নিয়েও সংশয় প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। তবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নে যেমন নেতা দরকার তেমন নেতাই দায়িত্ব পাবেন, এক্ষেত্রে কে কোন্ ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিংবা ঘনিষ্ঠ না সেটি দেখার আগ্রহও নেই তাদের।

চট্টগ্রাম নগরে আওয়ামী লীগ থেকে যুবলীগ-ছাত্রলীগের সব পদই কোনো না কোনোভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে আসছে দুটি প্রধান বলয় থেকে। এর একটির নেতৃত্বে রয়েছেন নগর আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল। অন্যটির নেতৃত্ব রয়েছে নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের হাতে।

চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক পদে সিভি জমা দিয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন। সম্মেলনে কোন্ প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব বাছাই হওয়া উচিত— এমন প্রশ্নের জবাবে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে সুজন বলেন, ‘কমিটি গঠনের সর্বোত্তম পন্থা দ্বিতীয় অধিবেশনে ভোটের মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখের বিষয় চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের ৪টি ওয়ার্ড কমিটি ছাড়া অন্য ওয়ার্ডগুলোর কমিটি নেই। বাস্তবতা হচ্ছে দ্বিতীয় অধিবেশন করার সুযোগ নেই। আমি মনে করি আমাদের যুবলীগের বর্তমান চেয়ারম্যান ও সাধারণ সম্পাদক ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ভাইয়ের সাথে আলোচনা করে একটি সময়োপযোগী যুবলীগের কমিটি গঠন করে আগামী নির্বাচনে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগকে ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেবেন।’

এর আগে সভাপতি পদের জন্য সিভি জমা দেওয়া করোনা আইসোলেশন সেন্টারের উদ্যোক্তা ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য সাজ্জাত হোসেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, ‘সভাপতি পদের জন্য আবেদন করেছি। সিভি বানাতে রাজনীতি করি নাই, করেছি সংগঠনকে ভালোবেসে। চট্টগ্রামের দুই গ্রুপ নেতার রেফারেন্সে সিভিওয়ালারাই মূলত শীর্ষ পদে আসবেন।’

যুবলীগে কোন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচন চান এমন প্রশ্নের উত্তরে সাজ্জাত হোসেনের মুখেও শোনা গেল সুজনের একই সুর। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, ‘এখানে মূলত কাউন্সিল করার কোনো পরিবেশই নাই। এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় যুবলীগের চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি সহ মহানগর ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা জমা পড়া সিভিগুলো যাচাইবাছাই করে খোঁজখবর নিয়ে নেতা নির্বাচন করতে পারেন। এটা ছাড়া তো আর উপায় নাই।’

এক্ষেত্রে দুই গ্রুপের নেতার রেফারেন্সে সিভি জমাদানকারীদেরই কি শীর্ষ পদ পাওয়ার রাস্তা সুগম হবে না— চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এমন প্রশ্নের জবাবে সাজ্জাত হোসেন বলেন, ‘যুবলীগের এখন যিনি চেয়ারম্যান তিনি শেখ ফজলুল হক মনির রক্তের উত্তরাধিকার। তাছাড়া তিনি একজন রুচিশীল আদর্শবান নেতা। উনি যুবলীগের রাজনীতির মূল আবেগের জায়গাটা অনেকের চেয়ে বেশি ফিল করেন। উনাকে কারও পক্ষে টাকা দিয়ে কেনা সম্ভব না। এক্ষেত্রে উনাকে যদি আশপাশের লোকজন মিসগাইড না করে, তাহলে উনার হাত ধরে ভাল নেতৃত্ব বের হয়ে আসার সুযোগ আছে। এই বিষয়ে সকলেই আশাবাদী।’

চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের বর্তমান যুগ্ম আহ্বায়ক দেলোয়ার হোসেন খোকা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যুবলীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি তো বলবো অবশ্যই নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা তৃণমূলে যারা রাজনীতি করে তাদের হাতেই থাকুক। রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া তো এমনই। আমরা যুবলীগের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যখন দেখা করেছি উনাকেও একই কথা বলেছি। এখন এটা মূল্যায়ন করাটা উনাদের এখতিয়ার।’

এই বিষয়ে একই মত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদের সদস্য ও বাংলাদেশ যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য নঈম উদ্দিন চৌধুরীরও। তিনি বলেন, ‘শুধু যুবলীগ না, সকল সংগঠনেরই নেতৃত্ব সম্মেলনস্থলে নির্বাচন করা উচিত। কিন্তু বর্তমানে একটা চর্চা দেখা যাচ্ছে প্রথম অধিবেশন করে কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচনের ক্ষমতা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকায় চলে যান। সর্বশেষ স্বেচ্ছাসেবক লীগও যেটা করলো। আমাদের বুঝতে হবে নেতৃত্ব নির্বাচন করা এক কথা, চাপিয়ে দেওয়া আরেক কথা। যুবলীগে নেতৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া না হলে সেটা সবার জন্যই ভালো।’

এক্ষেত্রে কেন্দ্র যদি সম্মেলনে ভোটাভুটি করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা মতামত দেনও তাহলে কি সেটা আয়োজন করার সুযোগ আছে— এমন প্রশ্নের জবাবে দেলোয়ার হোসেন খোকা বলেন, ‘হ্যাঁ এটা সম্ভব। এখন যে টাইমফ্রেম তার মধ্যে এটা করা একটু কঠিন হবে। তবে এটা অসম্ভব না। যদি কেন্দ্রীয় নেতারা নির্দেশনা দেন তাহলে সম্ভব।’

নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়ে কী ভাবছেন এমন প্রশ্নের জবাবে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা সম্মেলন করে সেকেন্ড অধিবেশন করে চলে আসবো, তারপরে আমরা সিদ্ধান্ত নেব কিভাবে করা যায়।’ এর পরের মুহূর্তে নিজের আগের বক্তব্য ব্যাখ্যা করে নিখিল আবার বলেন, ‘আমরা প্রথম অধিবেশন শেষে সেকেন্ড অধিবেশন করবো। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে যে আমরা কিভাবে কমিটিটা করবো।’

এক্ষেত্রে ‘ভাইয়ের’ পছন্দ বিবেচনায় পদ দেওয়া নিয়ে কর্মীদের যে অস্বস্তি, যুবলীগ কি সেই বৃত্ত থেকে বের হতে পারবে— এমন প্রশ্নের জবাবে নিখিল বলেন, ‘আমরা এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থানটা পরিষ্কার করতে চাই। আমরা সেই পথে হাঁটবো না। কে কার সাথে সুসম্পর্ক সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমাদের দেখার বিষয় হলো কে সত্যিকার অর্থে আদর্শবান, কে সত্যিকার অর্থে প্রধানমন্ত্রীর যেসব নির্দেশনা সৎ পথে চলা, সৎ কথা বলা, মানুষের পাশে থাকা— এসব নিশ্চিত করতে পারবে। তাকেই আমরা নেতা বানাবো। সে কোনো ভাইয়ের পছন্দ হতে পারে, নাও হতে পারে। সেটা আলাদা বিষয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!