চট্টগ্রামের কর্ণফুলীর চরপাথরঘাটা এলাকা থেকে জুয়েল নামে এক যুবক অপহরণের ঘটনায় চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে এসেছে। এ ঘটনায় আট জনকে আসামি করে মামলা করলেও ভিডিও ফুটেজে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। এমনকি অপহৃত জুয়েলের বক্তব্যের সঙ্গেও ভিডিও ফুটেজের কোনো মিল নেই। অপহরণকারীরা জুয়েলের মুঠোফোন নিয়ে ফেললেও তা বন্ধ করেনি। তার নম্বরের লোকেশন ট্র্যাক করে নগরীর বিভিন্ন জায়গার অবস্থান নেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।
এছাড়া মুক্তিপণ না নিয়েই তাকে অপহরণকারীরা ছেড়ে দিলে তিনি কোতোয়ালী থানায় রিকশায় চড়ে আসেন বলে জানান। অপহরণের সময় সিএনজি অটোরিকশায় উঠতে গিয়ে কোনো ধরনের চিৎকার বা ধস্তাধস্তি করেননি জুয়েল। বরং বাড়ি থেকে ২০ ফুট দূরে থাকা সিএনজিতে অনেকটা স্বেচ্ছায় ওঠেন তিনি। জুয়েল মামলার এজাহারে অপহরণকারী তাকে একাধিকবার হুমকি দিয়েছে বলে উল্লেখ করলেও তাদের বিরুদ্ধে আগে তিনি থানায় কোনো জিডি (সাধারণ ডায়েরি) করেননি। জুয়েল প্রথমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়ে ‘তুলে নেওয়ার’ কথা বললেও এজাহারের কোথাও সেটি উল্লেখ করেননি।
স্থানীয়দের ধারণা, এলাকার জাটকা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিতে এ ঘটনা ‘সাজানো নাটক’ হতে পারে। তবে তদন্তকারী কর্মকর্তার ভাষ্য, অন্য মামলার সাক্ষী নিতে ঢাকায় যাওয়ায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়নি। নেওয়া হয়নি বাদির বক্তব্যও।
স্বেচ্ছায় সিএনজিতে ওঠেন জুয়েল
চরপাথরঘাটা থেকে জুয়েলকে জোরপূর্বক সিএনজিতে তোলার দাবি করা হলেও সিসিটিভি ফুটেজ ও চালকের বক্তব্যে ছিল বড় ফারাক। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, জুয়েল স্বেচ্ছায় সিএনজিতে ওঠেন। বাড়ির মাত্র ২০ গজ দূরে গাড়িতে উঠলেও তিনি কোনো ধরনের চিৎকার করেননি।
ফিশারিঘাটে সিএনজি থেকে কালো প্রাইভেট কারে ওঠানো হয় বলে জুয়েলের সেই দাবিও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ঘটনার দিন একটি কালো প্রাইভেট কার এবং তিনটি সিএনজি কর্ণফুলীতে অবস্থান করছিল।
টোলপ্লাজার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, ৫ মার্চ (বুধবার) রাত ১১টা ৩৬ মিনিটে টোলপ্লাজার ৭ নম্বর লেনে জুয়েলকে বহনকারী সিএনজি পার হয়। চট্টমেট্রো-থ ১২-৬৬৫৬ নম্বরের সেই সিএনজিতে চালকসহ পাঁচজন ছিলেন। জুয়েল কালো পাঞ্জাবি ও টুপি পরা অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে বসে ছিলেন।
একই সময় ১ নম্বর লেনে একটি কালো প্রাইভেট কারও পার হতে দেখা গেছে। যেটির ইনডিকেটর লাইট বারবার জ্বলছিল। প্রাইভেট কার ও সিএনজি পাশাপাশি ছিল এবং তাড়াহুড়ো করে টোল পরিশোধ করে দ্রুত চলে যায়। রাত ১১টা ৩৬ মিনিট ১৭ সেকেন্ডে আরেকটি সিএনজি (চট্টমেট্রো-থ ১৩-৬৭৮০) পার হয়। এ সময় কালো জামা ও জিন্স পরা এক যুবক প্রাইভেট কার থেকে নেমে ওই সিএনজির চালকের সঙ্গে কথা বলেন। সিএনজি চালক আব্দুল হাকিম জানান, ওই যুবক ভুলবশত তাদের সিএনজিতে উঠতে চেয়েছিলেন।
পুলিশের একটি সূত্র ধারণা করছে, ওই যুবক কার থেকে নেমে অন্য সিএনজিতে উঠেন এবং লালদীঘিতে গিয়ে তার আসনেই ভিকটিম জুয়েলকে বসানো হয়। অপহরণে ব্যবহৃত কালো প্রাইভেট কারের নম্বর চট্টমেট্রো-গ ১৪-৪৮৪১, যেটির মালিক রাঙ্গুনিয়ার পশ্চিম কোদালার মোছাম্মদ রওশন আক্তার ও মোহাম্মদ মুছা। তাদের বর্তমান ঠিকানা নগরীর চান্দগাঁও বহদ্দারহাটের খাজা রোডে। এটি ভাড়া করা কোনো গাড়ি নয়।
অন্যদিকে ভিকটিমকে বহনকারী সিএনজিটির মালিক মো. শাহেদ আলী, যিনি ইপিজেড লেবার কলোনিতে বসবাস করেন। ওই সিএনজি চালক মো. শরীফ জানান, তাকে কাজীর দেউড়ি মোড় থেকে ভাড়া করা হয়েছিল এবং তিনটি সিএনজি একসঙ্গে শহর থেকে চরপাথরঘাটা পর্যন্ত যাতায়াত করেছে। প্রতিটি সিএনজিকে ৭০০ টাকা করে মোট ২১০০ টাকা ভাড়া দেওয়া হয়।
শরীফ আরও জানান, অপহরণকারীরা ভিকটিমকে কোনো প্রাইভেট কারে তোলেনি, বরং সরাসরি লালদীঘি মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে কালো প্রাইভেট কারে স্থানান্তর করে। তারা ভিকটিম জুয়েলের মোবাইল ও মানিব্যাগ গাড়িতে ওঠার আগেই ছিনিয়ে নেয়, তবে জুয়েল কোনো চিৎকার করেননি।
তবে মামলার এজাহারে জুয়েল দাবি করেছেন, ৫ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে বাড়ি ফেরার পথে চরপাথরঘাটার সাইক্লোন সেন্টারের কাছে তিনটি সিএনজিযোগে আসেন ৯-১০ জন লোক। তাকে মামলা থাকার কথা বলে জোরপূর্বক তুলে নেয় তারা। কিন্তু থানায় না নিয়ে তারা তাকে শাহ আমানত সেতু হয়ে ফিশারিঘাটে নিয়ে যায় এবং পরে কালো প্রাইভেট কারে করে লালদীঘি মাঠে পৌঁছে দেয়। সেখানে মাস্ক পরিহিত ৯-১০ জন ব্যক্তি তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে মাস্ক পড়া নতুন চারজনের হাতে হস্তান্তর করেন। কিন্তু সিসিটিভি ফুটেজে কোনো মাস্ক পরিহিত ব্যক্তিকে দেখা যায়নি।
ছেড়ে দেওয়া হয় মুক্তিপণ ছাড়াই
এজাহারে জুয়েল উল্লেখ করেন, মাস্ক পরা চারজন ব্যক্তি জুয়েলকে একটি সাদা প্রাইভেট কারে তুলে চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে ঘোরাতে থাকেন। রাত সাড়ে ১টার দিকে গাড়িটি কাজীর দেউড়ি এলাকার রয়েল হাট রেস্টুরেন্টের সামনে থামে। মাস্কধারীরা জুয়েলকে গাড়ির ভেতরেই রেখে দরজা লক করে দেয়। প্রায় ৩০ মিনিট পর, তারা নিজেদের প্রশাসনের লোক পরিচয় দিয়ে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। জুয়েল অক্ষমতা প্রকাশ করলে, তারা ৫ লাখ টাকা চান।
পরে অপহরণকারীরা জুয়েলের মোবাইল ফোন থেকে সাজ্জাদ নামের এক ব্যক্তির নম্বরে কল করে তার ছোট ভাই মুন্নার সঙ্গে কথা বলেন। তার মুক্তিপণের জন্য ৫ লাখ টাকার কথা জানান। দরকষাকষির একপর্যায়ে, তারা ৩ লাখ টাকা হলে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেন, যা জুয়েল বারবার তার বাবাকে ফোনে জানান বলে উল্লেখ করেন এজাহারে।
কর্ণফুলী থানার ওসি ও অন্যান্য পুলিশ কর্মকর্তারা কাজীর দেউড়ী মোড়ে গাড়ি তল্লাশি করতে গেলে অপহরণকারীরা জুয়েলকে বলেন, ‘টাকা লাগবে না, আমরা তোমাকে ছেড়ে দেবো, চিৎকার করো না।’ এরপর তারা গাড়িটি ঘুরিয়ে হল টোয়েন্টিফোর রেস্টুরেন্টের সামনে নিয়ে যায়। রাত সাড়ে ৩টার দিকে আমাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয় বলে এজাহারে উল্লেখ করেন জুয়েল।
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, এজাহারের আসামিরা জুয়েলকে ধরে এনে টাকা আদায়ের জন্য প্ররোচিত করেছেন বলে অপহরণকারীরা জানান। পরে রিকশা নিয়ে কোতোয়ালী থানায় গিয়ে ঘটনাটি ওসি কোতোয়ালী ও সেখানে উপস্থিত কর্ণফুলীর ওসিকে জানাই।
থানায় জুয়েলের এসব কথোপকথনের ভিডিও রেকর্ড সংরক্ষিত করা হয়।
ভিডিও ফুটেজে নেই আসামিরা
৭ মার্চ ভুক্তভোগী জুয়েল নিজেই কর্ণফুলী থানায় অপহরণ মামলা দায়ের করেন (মামলা নম্বর-৮)। মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন সিএমপি বন্দর জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ বদরুল আলম মোল্লা।
মামলায় আসামিরা হলেন—এম মঈন উদ্দিন (৪৬), মো. শাহেদুর রহমান ওরফে শাহেদ (৫০), মির্জা আজাদ (৪০), সাবেক ইউপি সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক (৪০), জাফর আহমদ (৫৮), মো. ইমরান পাটোয়ারী (২৯), আব্দুর শুকুর (৩৫) ও জহিরুল আলম (৪০)। এছাড়া আরও ১৩-১৪ জন অজ্ঞাত ব্যক্তিকেও আসামি করা হয়।
কিন্তু এজাহারে উল্লেখ করা আসামিদের মধ্যে কাউকেই অপহরণের কোনো ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়নি।
ভিকটিমের বাবা মো. শাহ আলম এবং ভাই মুন্না জানান, তারা মামলা করার বিষয়ে জানতেন না এবং তাদের পরামর্শ না নিয়েই জুয়েল নিজেই মামলা করেছেন।
তারা জানান, তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ না পাওয়া গেলে নাম অভিযোগ থেকে বাদ দেওয়া হবে।
এদিকে শুরুতে জুয়েল দাবি করেন, তাকে ‘চট্টগ্রাম মহানগর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী’ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু মামলার এজাহারে এমন কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্যের নাম নেই। এছাড়া মামলার আসামিরা পূর্বে তাকে হুমকি দিতেন বলে উল্লেখ করা হলেও, জুয়েল থানায় আগে কখনও তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেননি।
স্থানীয়রা ধারণা করছেন, ইছানগর এলাকায় জাটকা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে এটি একটি পরিকল্পিত ঘটনা হতে পারে। তবে এ বিষয়ে এখনও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
লোকেশনের তথ্যেও গরমিল
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৬ মার্চ রাত ১টা ৬ মিনিট ২২ সেকেন্ডে ভিকটিমের মোবাইল ট্র্যাক করা হলে অবস্থান খুলশীতে পাওয়া যায়। ১৫ মিনিট পর, রাত ১টা ২১ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে অবস্থান পাঁচলাইশ, ৪ মিনিট পর ১টা ২৫ মিনিটে ইস্পাহানি মোড় লালখানবাজার, ১টা ২৯ মিনিট ৪৪ সেকেন্ডে কোতোয়ালী এবং ২টা ২১ মিনিট ২৯ সেকেন্ডে আবার কোতোয়ালী এলাকায় পাওয়া যায়। সেখানে ২টা ৩৫ মিনিট ২ সেকেন্ড পর্যন্ত অবস্থানের তথ্য পাওয়া গেছে।
কিন্তু জুয়েল জানিয়েছেন, তাকে ইছানগর থেকে সরাসরি সিএনজিতে নতুন ব্রিজ হয়ে ফিশারিঘাট, লালদীঘি ও কাজীর দেউড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর ছেড়ে দেওয়ার পর তিনি রিকশায় করে কোতোয়ালী থানায় যান। প্রশ্ন উঠছে, তাহলে তার ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে কিভাবে খুলশী, লালখানবাজার ও পাঁচলাইশে পাওয়া গেল?
জুয়েলের ভাষ্যমতে, তার মোবাইল ফোন অপহরণকারীদের কাছেই ছিল। তাহলে এই অবস্থান পরিবর্তন কীভাবে হলো—এখন সেই প্রশ্নই উঠছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘ভিকটিমের বর্ণনায় অসঙ্গতি এবং মামলার বিভিন্ন অস্পষ্টতার কারণে কাউকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি না করে, ঘটনার আসল রহস্য উন্মোচন করা জরুরি। যেন নিরীহ কেউ হয়রানির শিকার না হন।’
এখনও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেননি তদন্ত কর্মকর্তা
মামলা তদন্ত কর্মকর্তা এসআই কেএম নাজিবুল ইসলাম তানভীর বলেন, ‘মামলাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তাই সঠিকভাবে তদন্ত করা হবে। তবে মামলাটি পাওয়ার পর অন্য মামলায় আমি দুটি সাক্ষী দিতে ঢাকায় গিয়েছিলাম। তাই এখনও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়নি এবং বাদির বক্তব্যও শোনা হয়নি। আশা করি, খুব শিগগিরই তদন্ত সম্পন্ন হবে।’
এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘অপহরণের ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে যাতে হয়রানি না করা হয়, অবশ্য পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত করবে।’
ব্যক্তিগত বিরোধ নাকি ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব
স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইছানগর এলাকায় জাটকা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এ ঘটনা ঘটতে পারে। তবে এখানে দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব ও আধিপত্যের লড়াইও থাকতে পারে।
ভুক্তভোগী শহিদুল আলম জুয়েল বলেন, ‘যারা আমাকে অপহরণ করেছে, তারা ছেড়ে দেওয়ার সময় হুমকির সুরে বলেছে—ব্যবসা-বাণিজ্যের ঝামেলা থেকে দূরে থাকাই ভালো। ঘটনার ১০-১২ দিন আগে মামলায় আমি যাদের নাম উল্লেখ করেছি, সেই একই গ্রুপ থেকেই খবর পেয়েছিলাম যে, আমাদের মধ্যে যেকোনো একজনকে তারা তুলে নিতে পারে। তবে সেটা যে আমি হব, তা কল্পনাও করিনি। বিস্তারিত পরে বলব, কারণ বিষয়টি দীর্ঘ এবং জটিল।’
জে জাহেদ/ডিজে