চট্টগ্রামে ময়লার পাহাড়ের প্লাস্টিকে পেট চলে দেড় হাজার পরিবারের, মাসে ২০০ টন প্লাস্টিক যাচ্ছে বড় কারখানায়

২২ বছর আগে ভোলার মনপুরায় নদী ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে চট্টগ্রাম চলে আসেন জোসনা বেগম। এরপর থেকে নগরীর বন্দরের আনন্দবাজার এলাকায় ময়লা ডিপোর পাশে কুঁড়েঘর বানিয়ে চার সন্তান নিয়ে থাকেন তিনি। তার পরিবারের সবার রোজগার এই ডিপো ঘিরে। ময়লা স্তূপ থেকে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের বর্জ্য কুড়িয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে যা উপার্জন হয় তা দিয়েই চলে সংসার।

চট্টগ্রামে ময়লার পাহাড়ের প্লাস্টিকে পেট চলে দেড় হাজার পরিবারের, মাসে ২০০ টন প্লাস্টিক যাচ্ছে বড় কারখানায় 1

শুধু জোসনা নয়, তার মতো আনন্দবাজার সংলগ্ন টিজি কলোনির প্রায় দেড় হাজার নিম্ন আয়ের পরিবারের উপার্জনের অবলম্বন এই ময়লার ডিপো। এসব পরিবার এখানে এসেছে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নদী ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়ে।

চট্টগ্রামে ময়লার পাহাড়ের প্লাস্টিকে পেট চলে দেড় হাজার পরিবারের, মাসে ২০০ টন প্লাস্টিক যাচ্ছে বড় কারখানায় 2

তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মতে, ময়লার ডিপো থেকে কলেরা, ডায়রিয়া, জন্ডিস, চর্ম, এলার্জি, শ্বাসকষ্টসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের সুরক্ষার জন্য দরকার গামবুট, হ্যান্ড গ্লাভস, মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজ ও বিশুদ্ধ পানি। কিন্তু তাদের মধ্যে সুশিক্ষার যেমন অভাব তেমনি সচেতনতারও। এসব বস্তিবাসীর স্বাস্থ্য সচেতনতায় প্রয়োজন সরকারি-বেসরকারি ও বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে ডাক্তারের সমন্বয়ে কাউন্সিলিং।

চট্টগ্রামে ময়লার পাহাড়ের প্লাস্টিকে পেট চলে দেড় হাজার পরিবারের, মাসে ২০০ টন প্লাস্টিক যাচ্ছে বড় কারখানায় 3

জানা গেছে, ময়লার ডিপোর আশপাশে প্রায় ৫০টির ওপর ভাঙারি দোকান রয়েছে। প্রতিমাসে এসব দোকান থেকে প্রায় ২০০ টন বোতলসহ প্লাস্টিকের বিভিন্ন বর্জ্য বড় বড় প্লাস্টিক রিসাইকেল কারখানায় বিক্রি হয়। এসব প্লাস্টিক কুচি করে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

এছাড়া প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি হয় ফাইবার ও তুলা। ফাইবার দিয়ে সুতা বানিয়ে রং-বেরঙের পলেস্টার কাপড় তৈরি হয়। আবার এই তুলা বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি করে বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পথ তৈরি হয়েছে। একইসঙ্গে যেখানে-সেখানে পড়ে থাকা প্লাস্টিক সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করায় কমছে পরিবেশ দূষণ।

শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সরেজমিন আনন্দবাজার ময়লার ডিপো সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন এখানে ময়লা কুড়াতে আসে। ডিপোর বর্জ্য থেকে প্লাস্টিকের বোতল, স্যালাইন ব্যাগ, সিরিঞ্জসহ বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের জিনিস সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে তারা। এভাবে যে টাকা উপার্জন হয় তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। এখানে নারী-শিশু থেকে শুরু করে প্রায় সব বয়সের মানুষই বর্জ্য সংগ্রহ করে।

আরও দেখা গেছে, অল্প বয়সী শিশুরাও ময়লার স্তূপ থেকে বর্জ্য বাছাই করছে। প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা প্লাস্টিক, স্যালাইনের ব্যাগ, সিরিঞ্জ, বোতলের ছিপি কুড়িয়ে যার যার মতো ভাগ করে নিচ্ছেন। কার আগে কে বেশি সংগ্রহ করবে সেই প্রতিযোগিতায় মেতেছে শিশুরা। সংগ্রহ করা এসব বর্জ্য এলাকার প্রায় ৫০টি ভাঙারি দোকানে বিক্রি করে তারা।

এ সময় কথা হয় প্রাইম ভিউ পাবলিক স্কুলের ৩য় শ্রেণির ছাত্র মো. তাজিনের সঙ্গে। সে জানায়, অভাবের সংসারে পরিবারের হাল ধরতে প্রতিদিন স্কুল শেষে তাকে ফিরে যেতে হয় ময়লার স্তূপে। সন্ধ্যা পর্যন্ত ময়লার স্তূপে প্লাস্টিকের বোতল কুড়িয়ে ভাঙারির দোকান বিক্রি করে সে। এভাবে দৈনিক ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় তার, যা মাস শেষে দাঁড়ায় প্রায় ছয় হাজার টাকার মতো। এ আয় থেকে পরিবারে সহযোগিতা করে তাজিন। একদিকে চলে লেখাপড়া, অন্যদিকে ময়লা কুড়ানো—এ দুইয়ের মাঝে পড়ে খেলাধুলার সময় পায় না তাজিন।

ময়লার ডিপোতে কথা হয় মো. সাব্বির নামের আরেক শিশুর সঙ্গে। লেখাপড়া করে কি-না জানতে চাইলে সাব্বির বলে, ‘লেখাপড়া করি, তবে স্কুলে না, ময়লার ডিপোতে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্লাস্টিকের বিভিন্ন ভাঙাসামগ্রী কুড়িয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কামাই। লেখাপড়া করতে স্কুলে যেতে হয়, পড়া না পারলে আবার মার খেতে হয়। ইংরেজিও অনেক কঠিন পড়া। এখন আমি অনেক স্বাধীন, কারো মার খেতে হয় না, কথা শুনতে হয় না। নিজে ইনকাম করে নিজে চলি এবং পরিবারকেও টাকা দিই।’

ভাঙারি ব্যবসায়ী মো. ইব্রাহীম ফরাজী বলেন, ‘ভাঙারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মহাজনরা লাখ লাখ টাকা দাদন হিসেবে পুঁজি খাটিয়ে ব্যবসা করছে। মহাজনদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চলে এসব নিম্ন আয়ের মানুষদের জীবনযাপন। এখান থেকে আয় করে এসব পরিবার মহাজনদের ধার শোধ করে। ডিপো থেকে সংগ্রহ করা প্লাস্টিক আমরা নিয়ে পাঠায় বিভিন্ন রিসাইকেল কারখানায়। সেখানে প্লাস্টিকগুলো কুচি করে কেটে পাঠানো হয় দেশের বিভিন্ন বড় প্লাস্টিক কারখানায়।’

এ বিষয়ে চিটাগং উইমেন চেম্বারের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মুনাল মাহবুব চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমার ইচ্ছে ছিল দেশে প্লাস্টিক রিসাইক্লিং কারখানা গড়ে তোলার। এতে নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতো। সরকারিভাবে ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে যদি পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তাহলে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা যাবে।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, দোকান-রেস্টুরেন্টে, কমি্উনিটি সেন্টারে, পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত পরিত্যক্ত প্লাস্টিক যেখানে-সেখানে না ফেলে সংগ্রহের করা দরকার। এতে একদিকে যেমন ব্যবসায় ভূমিকা রাখবে অন্যদিকে পরিবেশ দূষণ রোধেও ভূমিকা রাখবে। প্লাস্টিক মাটির নিচে এক হাজার বছর পর্যন্ত না পঁচে থেকে যায়। বর্জ্য থেকে সম্পদ আহরণ করে ব্যবসার নতুন দ্বার হতে পারে এ ময়লার ডিপো।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, ‘পরিবেশ দূষণের ফলে জলবায়ু পরিবর্তন মানব সভ্যতার ওপর বিরাট প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন অপচনশীল প্লাস্টিকের বর্জ্য কর্ণফুলী নদী ও বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পানি দূষণের পাশাপাশি পরিবেশও দূষণ করছে। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে ড্রেজিং করতে গিয়ে পাওয়া যাচ্ছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বর্জ্য। নিম্ন আয়ের মানুষ এসব বর্জ্য সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে যেমন জীবিকা নির্বাহ করছে তেমনি দূষণরোধে ভূমিকা রাখছে। তবে বর্জ্য রিসাইকেল করার ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, পরিবেশের যেন ক্ষতি না হয়।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!

ksrm