চট্টগ্রামে মনোনয়ন বাণিজ্যের সাঁকো নেড়ে ৩ ঘন্টার মাথায় বহিষ্কার নৌকাপ্রত্যাশী

সভাপতি সাতকানিয়ায়, সেক্রেটারি ঢাকা— সভা না ডেকেই বিজ্ঞপ্তি

চট্টগ্রামের দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদের নাম করে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে আইনজীবী কামাল উদ্দিনকে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে সোনাকানিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ। তবে আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির এক সদস্যের সাথে আলাপ করে জানা গেছে কামাল উদ্দিনকে বহিষ্কার করার বিষয়টি একেবারেই দলীয় নিয়মশৃঙ্খলা মেনে করা হয়নি।

বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) সোনাকানিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মাস্টার আহমদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কামাল উদ্দিনকে বহিষ্কারের কথা জানানো হয়।

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, ফেসবুকে মিথ্যা বানোয়াট মানহানিকর বক্তব্য প্রদান করায় সোনাকানিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির এক জরুরি সভায় এডভোকেট কামাল উদ্দিনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়া তাকে স্থায়ী বহিষ্কার ও দলে তার প্রাথমিক সদস্যপদ বাতিলের জন্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি বরাবরও আবেদন করা হয় বলে ওই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।

যে ফেসবুক স্ট্যাটাস দেওয়ার তার কয়েক ঘন্টার মধ্যে কিভাবে জরুরি সভা ডাকা হল, আবার সভা সম্পন্ন করে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তও নেওয়া গেল— এই বিষয়ে ওঠা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল আদতে কোনো সভাই অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি যে দুজনের যুক্ত স্বাক্ষরে এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি, তাদের একজন এই মুহূর্তে ঢাকায় অন্যজন আছেন সোনাকানিয়ায়। তাহলে কিভাবে সভা হল? আর একই প্যাডে দুজনে কিভাবে সভা করলেন?

বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) দিবাগত রাত ১২টার দিকে এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় অবস্থানরত সোনাকানিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কোনো সভা হয়নি। আমি ঢাকায় আসার সময় সভাপতির স্বাক্ষরিত ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের প্যাড সাথে করে নিয়ে এসেছি। পরে সভাপতির সাথে আলাপ করে এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি।’

এভাবে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের কোনো কমিটি থেকে কাউকে বহিষ্কার করা যায় কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য ও নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি নঈম উদ্দিন চৌধুরী চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সভা ছাড়া কাউকে বহিষ্কার করার সুযোগ নাই। সভা করেও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ দলের কোনো পর্যায়ের কোনো নেতাকে বহিষ্কার করার ক্ষমতা রাখে না। তারা শুধুমাত্র পদ স্থগিত করতে পারে। আর বহিষ্কারের জন্য সাংগঠনিক চেইনে কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে সুপারিশ করতে পারে।’

এক্ষেত্রে তড়িঘড়ি কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ারও সুযোগ নেই জানিয়ে নঈম উদ্দিন বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে শুধু অভিযোগের ভিত্তিতে কাউকে শাস্তি দেওয়া যাবে না। প্রথমে তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, সে অভিযোগের বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে তাকে শোকজ চিঠি দিতে হবে। শোকজ চিঠির জবাব পাওয়ার পর সভা করে সবার সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এটাই নিয়ম।’

তবে এসবের কোনো কিছুই অনুসরণ করা হয়নি কামাল উদ্দিনকে বহিষ্কারের ব্যাপারে। এতে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদেরও অনেকে প্রশ্ন তুলে বলছেন, স্থানীয়ভাবে দলের গঠনতন্ত্র মানা হচ্ছে না। অনেকেই মনে করছেন স্থানীয়ভাবে নেতাদের ব্যক্তিস্বার্থে দলের গঠনতন্ত্র মানা হচ্ছে না আওয়ামী লীগের মতো সুসংগঠিত দলেও।

বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) চট্টগ্রামের দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদের নাম করে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তোলেন চট্টগ্রাম জজ কোর্টের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর কামাল উদ্দিন। তিনি দক্ষিণ জেলা আওয়ামী যুবলীগের লীগের আইন বিষয়ক সহ সম্পাদকও। আসন্ন নির্বাচনে সাতকানিয়া উপজেলার ১৭ নং সোনাকানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দিতে উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুসেইন কবির মোছলেম উদ্দিনের নামে ১৫ লাখ টাকার এই চেক গ্রহণ করেন বলে দাবি কামাল উদ্দিনের।

বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) বেলা দুইটায় নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক পোস্টে চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী ও অতিরিক্ত পিপি মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন অভিযোগ তুলে লিখেছেন— ‘আসন্ন ১৭ নং সোনাকানিয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আমাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাইয়ে দিবে বলে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হুসেইন কবির চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সংগ্রামী সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা জননেতা জনাব আলহাজ্ব মোসলেম উদ্দিন আহমেদ এম. পির নাম দিয়ে আমার কাছ থেকে ১৫,০০,০০০৳ (পনের লক্ষ) টাকার চেক নিয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে আমাকে মনোনয়ন দেয়া ত দূরে থাক, কেন্দ্রে আমার নামটি পর্যন্ত পাঠায়নি।’

সেই চেক ও টাকা ফেরত চেয়ে আইনজীবী কামাল উদ্দিন লিখেছেন, ‘এখন আমি আমার চেক ও টাকা ফেরত চাই। অন্যথায় বিষয়টি নিয়ে আমি তৃণমূলের আশা ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল জননেত্রী শেখ হাসিনার দ্বারস্থ হব এবং ফৌজদারি মামলা করতে বাধ্য হব।’

কামাল উদ্দিনের এমন দাবির বিষয়ে সাংসদ ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোছলেম উদ্দিন আহমেদের বক্তব্য জানার জন্য তার মুঠোফোন নম্বরে কল করলেও অন্য প্রান্ত থেকে সাড়া মেলেনি।

সাতকানিয়ায় নৌকা প্রতীক নিয়ে এই মনোনয়ন বাণিজ্যে এক মিষ্টি বিক্রেতা ও ইয়াবাবিক্রেতার হাতও দেখছেন কামাল উদ্দিন। তবে কারও নাম উল্লেখ না করে তিনি এও লিখেছেন, ‘আমি মিষ্টি বিয়ারী ও বাবা বিয়ারীকে প্রশ্ন করছি— নমিনেশন দেওয়ার মালিক জননেত্রী শেখ হাসিনা। তো আমার নামটি ৬ জনের মধ্যে কেন্দ্রে পাঠাইলে সমস্যা কোথায় ছিল?’

তবে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা যে হুসাইন কবিরের মাধ্যমে মোছলেম উদ্দিনের জন্য টাকা দিয়েছেন বলে দাবি কামাল উদ্দিনের, সেই হুসাইন কবির চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘উনি (কামাল উদ্দিন) একটা মস্তিস্ক বিকৃত মানুষ। উনার সাথে গত ৫-৭ বছরে আমার দেখাও হয় নাই। দেখা হলেও কথা হয় নাই। উনার সাথে আমার ফোন বা ফেসবুক কোথাও যোগাযোগ নাই। বিকেল থেকে অনেকেই আমাকে ওই পোস্টের কথা বলেছে। সেখানে যে চেকের ছবি তিনি দিয়েছেন সেটাও একটা এনালগ চেক। এভাবে কি টাকা লেনদেন হয়? লিডার (মোছলেম উদ্দিন) মনোনয়ন দেয়ার জন্য এভাবে কারও কাছ থেকে টাকা পয়সা নিয়েছেন এমন কথা আমি জীবনেও শুনি নাই।’

তবে কামাল উদ্দিনের ওই পোস্টে অনেকেই মোছলেম উদ্দিনের বিরুদ্ধে মনোনায়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলেছেন রাখঢাক ছাড়াই। তাজুল ইসলাম নামের একজন লিখেছেন, ‘গতবারের মতো এবারও মোসলেম উদ্দিনের সদাগরের ব্যবসা ভাল চলতেছে।’ তবে অনেকে পাল্টা কামাল উদ্দিনকেও প্রশ্ন করেছেন— দলীয় মনোনয়নের জন্য কামাল উদ্দিন টাকা দিয়ে নিজেও অপরাধ করেছেন কিনা।

নাজমুল ইসলাম নামে একজন লিখেছেন , ‘সব বুঝলাম, আগে আপনি বলেন… আপনি ১৫ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চেয়ারম্যান ইলেকশন করতে চান কেন? কি মধু আছে? জনসেবা করবেন? নাকি লুটের মাল ভাগ করবেন?’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!