চট্টগ্রামে মনের রোগে মানুষ ছোটে মাথার ডাক্তারের কাছে, সময়ক্ষেপণে রোগ চলে যায় গভীরে
চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক ওয়ার্ড রোগী সামলাতে হিমশিম, ডাক্তারই মোটে তিনজন
চট্টগ্রামে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা। কিন্তু সেই তুলনায় যথার্থ চিকিৎসা পাচ্ছে না বিশেষায়িত এই রোগীরা। প্রায় ক্ষেত্রেই মানসিক রোগকে পরিবারের স্বজনরা আমলে না নিয়ে কালক্ষেপণ করে যান। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, দিনের পর দিন মেডিসিন-নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হয়ে দীর্ঘ একটা সময় যাওয়ার পর শেষ সময়ে এসে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নেওয়া হয় রোগীদের। আবার চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘রেফারেল সিস্টেম’ গড়ে না ওঠায় মেডিসিন কিংবা নিউরো মেডিসিন চিকিৎসকরাও রোগীদের রেফার্ড করেন না মানসিক রোগের চিকিৎসকদের কাছে। ততোদিনে রোগটি চলে যায় আরও গভীরে। অন্যদিকে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সংকটেও রোগীরা চিকিৎসাবঞ্চিত হচ্ছেন। বৃহত্তর চট্টগ্রামে মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ ওয়ার্ডই একমাত্র ভরসা। সেই ওয়ার্ডই চলছে মাত্র তিনজন চিকিৎসক দিয়ে।
মানসিক রোগের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণ মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে একধরনের অনীহা ও লুকোচাপা মনোভাব রয়েছে। মানসিক রোগ চিকিৎসকদের অনেকে এখনও ‘পাগলের ডাক্তার’ মনে করে। সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়েও অনেকে মানসিক রোগ চিকিৎসকের কাছে যাওয়ার চেয়ে মেডিসিন কিংবা নিউরো মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাওয়াকেই নিরাপদ ও গোপনীয় মনে করেন।
এখানেই দেখা দেয় বড় বিপত্তি। প্রায় ক্ষেত্রেই রোগী পড়ে যায় দীর্ঘসূত্রতায়। রোগ ততোদিনে আরও ছড়িয়ে যায়। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথার সূত্রে জানা গেছে, মেডিসিন কিংবা নিউরো মেডিসিন চিকিৎসকদের কাছে যাওয়া মানসিক রোগীদের ওই রোগের বিশেষজ্ঞদের কাছে পাঠানো হয় খুব কম ক্ষেত্রেই। অনেক চিকিৎসক নিজের ফায়দা হাসিলের জন্য রোগী আটকে রেখে তার মনের রোগকেই আরও বাড়িয়ে তোলেন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে মানসিক রোগে ভর্তি হওয়া অনেক রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রেই মেডিসিন কিংবা নিউরো মেডিসিন চিকিৎসকরা রোগ শনাক্ত করার পরও মানসিক রোগের ডাক্তারের কাছে রেফার্ড করেন না। নিজেদের লাভের আশায় দিনের পর দিন রোগীকে তাদের চিকিৎসায় রেখে দেন। এভাবে নিস্ফল হওয়ার পরই তাদের বেশিরভাগই নিজেদের উদ্যোগে পরে মানসিক রোগ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. তারেক আবেদীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যখন কোনো রোগী মাথাব্যথা নিয়ে একজন নিউরোমেডিসিন কিংবা স্নায়ুরোগ চিকিৎসকের কাছে যান, তখন চিকিৎসক দেখে থাকেন মাথাব্যথার কারণ কী? মাথাব্যথার অনেক কারণ থাকতে পারে। মাইগ্রেন থেকে, চোখের সমস্যা থেকে মাথাব্যথা হতে পারে। কিন্তু সেটা যদি টেনশন থেকে হয়, তবে সেই রোগীকে অবশ্যই মানসিক রোগ চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে। আবার নিউরো মেডিসিন চিকিৎসক যদি সিজোফ্রোনিয়া-বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগী পান, তাহলেও অবশ্যই রোগীকে মানসিক রোগ চিকিৎসকের কাছে পাঠাতে হবে।’
ডা. তারেক আবেদীন বলেন, ‘এছাড়াও বেশ কিছু মানসিক রোগ আছে। তবে মনে রাখতে হবে, ওপরে যেসব উপসর্গ বা সমস্যার কথা বলা হয়েছে তার অনেক কিছুই একজন সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রেও থাকতে পারে। পার্থক্য হচ্ছে রোগ বলতে গেলে এসবের মাত্রা বা তীব্রতা এমন হতে হবে যে, তা একজন মানুষের জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে সমস্যা বা অসুবিধা তৈরি করবে এবং সুনির্দিষ্ট একটা সময় পর্যন্ত থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে মাত্র, কিন্তু কোনো রোগ নির্ণয় করতে হলে আরও অনেক কিছুই বিবেচনায় আনতে হয়। যে কাজটি একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পক্ষেই করা সম্ভব।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজকের দিনে রোগীদের মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসা নিশ্চিত করতে মেডিসিন কিংবা নিউরো মেডিসিন চিকিৎসকদের অবশ্যই মানসিক রোগীকে মানসিক রোগ চিকিৎসকের কাছেই পাঠাতে হবে। রোগীকে আটকে রেখে নিজের ফায়দা হাসিল করলে রোগীর মনের রোগ বাড়বে। রোগীকে সঠিক চিকিৎসকের পাঠানো চিকিৎসকদের একটা সামাজিক ও ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা। আর রোগীর স্বজনকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।’
ন্যাশনাল মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আসলে চিকিৎসার শুরুটা এমনটাই হওয়া উচিত যে, মেডিসিনের কোন চিকিৎসক দেখে যদি মনে করেন রোগীর স্নায়ুর সমস্যা, তাহলে তিনি রোগীকে নিউরো মেডিসিন চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। তারপর সেই চিকিৎসক দেখেন রোগটি স্নায়ুর নয়, মনের রোগ— তাহলে রোগীকে মানসিক রোগ চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। কিন্তু বাংলাদেশে রেফারেল সিস্টেম গড়ে না ওঠায় চিকিৎসাপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হয়। আর এতে রোগীর ভোগান্তি বাড়ে।’
ডা. হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘যখন কোন ব্যক্তির আচরণে বড় পরিবর্তন আসে, সারাদিন দুশ্চিন্তা করে, গায়েবি আওয়াজ শুনে, ঘরের লোক মানে স্বামী-স্ত্রীকে সন্দেহ করে, তখন বুঝতে হবে রোগী সিজোফ্রোনিয়ায় আক্রান্ত। এছাড়াও হঠাৎ হঠাৎ করে বেশি উত্তেজিত হয়ে ওঠা, অনেকদিন ধরে নিজেকে সবার কাছ থেকে সরিয়ে বা গুটিয়ে রাখা, সবার সাথে ঝগড়া করা, অন্যদের অকারণে সন্দেহ করতে শুরু করা, গোসল বা দাঁত মাজার মতো নিয়মিত প্রাত্যহিক কাজ করা বন্ধ করে নিজের প্রতি যত্ন না নেওয়া, যেসব কাজে আনন্দ পাওয়া যায়, সেসব কাজে আগ্রহ কমে যাওয়া, সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া এবং খুব তীব্র হলে আত্মহত্যার চিন্তা, পরিকল্পনা বা চেষ্টা করে— এমন সব লক্ষণ থাকলে বুঝতে হবে রোগটি মানসিক।’
তিনি বলেন, ‘এসব উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা গেলে একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলা উচিত। তারা সেটা বিশ্লেষণ করে বুঝতে পারবেন যে, এখানে আসলে কোন ব্যবস্থা নেওয়া উচিত কিনা।’
তবে মানসিক রোগ চিকিৎসকরা এও বলছেন, সাধারণ মন খারাপ, বিষণ্নতা আর মানসিক রোগ একই জিনিস নয়। মন খারাপ বা বিষণ্নতা দীর্ঘদিন ধরে চললে সেটি মানসিক রোগে পরিণত হয়।
বৃহত্তর চট্টগ্রামে মনের রোগে ভরসা একটিই
বৃহত্তর চট্টগ্রামে মানসিক রোগ চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক রোগ ওয়ার্ডই একমাত্র ভরসা। চট্টগ্রামে মানসিক রোগ চিকিৎসকও হাতেগোনা কয়েকজন। খোদা চট্টগ্রাম মেডিকেলের মানসিক ওয়ার্ডই চলছে মাত্র তিনজন চিকিৎসক দিয়ে।
জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের ৩ নম্বর মানসিক রোগ ওয়ার্ডের বহির্বিভাগে প্রতিদিন ৬০ থেকে ৭০ জন রোগী দেখা হয়। ইনডোরে রয়েছে ৬০টি শয্যা। সেখান থেকে রোগীকে ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। কিন্তু বিভাগটিতে ডাক্তার-নার্সের অপ্রতুলতায় অনেক সময়ই মেলে না সুচিকিৎসা— অভিযোগ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের।
ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেলের মনোরোগ ওয়ার্ডে সিজোফ্রেনিয়া ও বাইপোলার ডিসঅর্ডার রোগী বেশি আসে। এসব রোগীদের অনেকেরই দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে।
জানা গেছে, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিসঅর্ডার, ডিসোসিয়েটিভ ডিজঅর্ডার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, মনোযোগের বিক্ষিপ্ততা, হাইপার একটিভিটি ডিসঅর্ডার, বুলিমিয়া, যৌনবিকৃতি এবং সিজোফ্রোনিয়া সমস্যা নিয়ে আসা রোগীদের মেডিকেলের ওয়ার্ডে কমপক্ষে দুই সপ্তাহ রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। রোগের প্রকারভেদে অনেক রোগীকে ২ থেকে ৩ মাসও রাখা হয় হাসপাতালে।
চট্টগ্রামের হাটহাজারীর ঝুমুরের সঙ্গে আট বছর আগে বিয়ে হয় পাশের গ্রামের মাহতাবের সঙ্গে। বিয়ের দিনই মাহতাব বাধান গণ্ডগোল। যৌতুকের টাকায় হেরফের হওয়ায় মাহতাব বিয়ে করতে আসতে চান না। সেই খবর শুনে ঝুমুর হয়ে পড়েন অজ্ঞান। পরে বরযাত্রী এসে বিয়ে হলেও ঝুমুরের সেই ভীতি আর কাটে না। শ্বশুরবাড়িতে স্বামী-শাশুড়ি তাকে নির্যাতন করতেন যৌতুকের বাকি টাকার জন্য। এর একপর্যায়ে কোলের মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয় ঝুমুরকে। স্বামী হারানোর শোকে ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়েন ঝুমুর। প্রথমে জ্বর, মাথাব্যথা, বুক ধড়ফড় করতো। আর চিৎকার করে বলতেন— কে যেন তাকে মারতে আসছে!
রোববার (৯ অক্টোবর) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৩ নং ওয়ার্ড মনোরোগ বিভাগের শয্যায় বসে ঝুমুরের অতীত ও বর্তমান জীবনের কথাগুলো যখন বলছিলেন তার বোন শাহানা। ঝুমুর শুধু একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন, চোখের কোণায় তার জল।
ঝুমুরই শুধু নন, চট্টগ্রাম মেডিকেলের মনোরোগ বিভাগে চিকিৎসাধীন প্রতিটি রোগীরই পেছনের গল্পটি কষ্ট ও হতাশার, দুশ্চিন্তা ও ভীতির। এদের অনেকেরই মানসিক রোগকে পরিবারের স্বজনরা আমলে না নিয়ে কালক্ষেপণ করে গেছেন। আবার দিনের পর দিন মেডিসিন-নিউরো মেডিসিন বিশেষজ্ঞের দ্বারস্থ হয়ে দীর্ঘ একটা সময় যাওয়ার পরও রোগ ভালো না হওয়ায় অনেকটা শেষ সময়ে এসে রোগীকে এনে ভর্তি করান মেডিকেলের মানসিক ওয়ার্ডে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. তারেক আবেদীন বলেন, ‘মানুষের সচেতনতার অভাবে মনোরোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। তাই স্ট্রেস, দুশ্চিন্তা কিংবা দুঃখবোধ কমাতে পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন বাড়ানোর বিকল্প নেই।’
সিপি