চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টিতে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, মশা মারতে ধীরগতি সিটি কর্পোরেশনের
মশা মারতে ৩ মাসে ৩ কোটি টাকার যন্ত্র ক্রয়
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ১৬ নম্বর মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন ডেঙ্গু আক্রান্ত নূরজ্জামান (২৪)। নগরীর ষোলশহর সুন্নিয়া মাদ্রাসার পাশের ভবনের নিচতলায় একটা মেসে থাকেন তিনি। ওই মেসের ১০ জন ছাত্র থাকে, তাদের আট জনই ডেঙ্গু আক্রান্ত। নূরজ্জামানের ধারণা, বাসার পাশের নালায় সারাদিন পানি জমে থাকে। সেখানেই হয়তো এডিস মশার প্রজনন স্থান।
বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে যখন নূরজ্জামানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল তখন তার চোখেমুখে ছিল অসুস্থতার ধকল। আরও ২-১ দিন চিকিৎসাধীন থাকতে হবে তাকে।
নূরুজ্জামান বলেন, বাসার পাশে ও নালায় এ বছর কোনো মশার ওষুধ স্প্রে করতে দেখিনি।
তবে মাঠপর্যায়ে মশা নিধনের কোনো কর্মসূচিই চোখে পড়ছে না নগরবাসীর। শুরু হয়নি ক্রাশ প্রোগ্রামও। চট্টগ্রামে যখন ডেঙ্গু চোখ রাঙাচ্ছে তখন সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন বিভাগ আক্রান্ত ও মৃত্যুর হারকে নগণ্য বলছে। মশক নিধন বিভাগের মতে, গত বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার কম। আর এটিই তাদের মশা নিধন কার্যক্রমের সফলতা।
৩ মাসে ৩ কোটি টাকার যন্ত্র ক্রয়
তেমন কর্মসূচি না থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মশা নিধন কার্যক্রমের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে মশক নিধন বিভাগ। সেখান থেকে ৩ কোটি টাকা খরচও করে ফেলেছে কর্মকর্তারা। কিনেছে মশা নিধন যন্ত্রপাতি ও কীটনাশক।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশক নিধন কার্যক্রমের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ মিলেছে। এর মধ্যে ৩ কোটি টাকা খরচও করা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ফগার মেশিন কেনা হয়েছে ১০টি, একটির দাম পড়েছে ৬৫ হাজার টাকা করে। স্প্রে মেশিন কেনা হয়েছে ১০০টি, প্রতিটি ১২০০ টাকা দামের। ২০ হাজার লিটার এডাল্টিসাইড, ৪০০ লিটার মুসকোভান কেনা হয়েছে। মুসকোভানের সঙ্গে দেওয়ার জন্য ৭০০ লিটার কালো তেল কেনা হয়েছে। এর আগে মুসকোভানের সঙ্গে ডিজেল কিংবা কেরোসিন কেনা হতো। খরচে সাশ্রয়ী বলে কালো তেল কেনা হয়েছে। এছাড়া লারবিসাইড ৩ হাজার লিটার কেনা হয়েছে। আগামী ছয় মাসের ওষুধ মজুদ আছে। এসব ওষুধ স্প্রে করার জন্য ৩৫০ জন লোকবল নিয়োজিত আছে।
‘মশক নিধনে সফল হয়েছি’
মশক নিধনে সফল হয়েছে বলে দাবি করছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মশক নিধন বিভাগ। তাদের দাবি, গত বছর ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করার সুফল এ বছর পাওয়া যাচ্ছে। এ বছরের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা গতবারের চেয়ে কম।
মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. শরফুল ইসলাম মাহি বলেন, ‘আমরা মশা নিধনে অবশ্যই সফল হয়েছি। তা নাহলে গত বছর জুলাইয়ে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ ও মৃত্যুর হার যেমন ছিল, তার ছিঁটেফোটাও এ বছর নেই।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডে চারটি ব্লকে ভাগ করে প্রতিদিন মশার প্রজননক্ষেত্রে ওষুধ স্প্রে করা হয়। এটি রুটিন ওয়ার্ক, সারা বছরই করা হয়। আমরা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা পদ্ধতি সুপারভিশনে রাখি। বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যেসব ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসাধীন, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বাসা-বাড়ির ৪০০ গজের মধ্যে মশা মারা ওষুধ স্প্রে করে থাকি।’
ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে ২০২৩ সালে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহে ড্রোন উড়িয়ে এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করেছিল সিটি কর্পোরেশন। সেবার ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
ভারী বৃষ্টিতে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু
চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এবার আগস্টের শেষ দিকে ও সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাত বেশি হয়েছে। আরও বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। তাই জুলাই-আগস্টের চেয়ে সেপ্টেম্বর ও আগামী কয়েক মাস ডেঙ্গুর বাড়ার শঙ্কা রয়েছে। গত বছর জুলাইয়ে আগাম বৃষ্টি হওয়ায় সেবার আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি ছিল। তাই মশক নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কারণ এডিস মশা ইতোমধ্যে প্রজননের ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলেছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হাজারের ওপরে ছিল। এর মধ্যে জুলাই মাসে ২৩১১ জন, আগস্টে ৩০১১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৮৯২ জন, অক্টোবরে ২৭৭৯ জন, নভেম্বরে ১২৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন। তবে ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ১৯৮ জন, আগস্ট ২০২ জন এবং সেপ্টেম্বরের ১৪ দিনে আক্রান্ত হয়েছে ২০৪ জন।
২০২৩ সালের জুলাইয়ে ১৬ জন, আগস্টে ২১ জন ও সেপ্টেম্বরে ২১ জন ও অক্টোবরে মৃত্যু হয়েছিল ১২ জনের। সেই হিসেবে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টে ২ জন এবং সেপ্টেম্বরে এখনও পর্যন্ত ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে এ বছর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে বৃষ্টি বেশি হওয়ায় আগামীতে ডেঙ্গু বাড়ার শঙ্কা রয়েছে।
চট্টগ্রাম জেলা কীটতত্ত্ববিদ মোছাম্মৎ এনতেজার ফেরদাওছ বলেন, ‘এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম শুরু হচ্ছে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। এমনকি সেটি নভেম্বরও ছাড়িয়ে যায় অনেক সময়। চলতি বছরের বর্ষা মৌসুমে আগস্টের শেষে ও সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাত বেশি হচ্ছে। তাই ডেঙ্গুর প্রজনন বাড়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই মশক নিধন কার্যক্রম জোর দেওয়া উচিত।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও ডেঙ্গুর ফোকাল পার্সন ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, গত বছর যে বৃষ্টি জুলাইয়ের আগে হয়েছিল, সেই বৃষ্টি এবার হয়েছে আগস্টের শেষে ও সেপ্টেম্বরে। তাই এডিস মশা তার প্রজনন ক্ষেত্র এর মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। তাই এডিস মশা নিধন জরুরি।
ডিজে