হাতে মেহেদি এঁকেছেন জান্নাতুল ফেরদাউস। কারণ, আজ তার স্বামী ফিরছেন। স্বামী মো. নুর উদ্দিন সঙ্গে যখন দেখা হলো কোলে আড়াই বছরের ছেলেকে নিয়ে তখন মেহেদি আঁকা হাতে চোখের জল মুছছেন তিনি। তার চোখেমুখে বাঁধভাঙা আনন্দ—যেন এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন।
মঙ্গলবার (১৪ মে) এমন দৃশ্য দেখা গেছে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং টার্মিনালের জেটিতে। ২৩ জন নাবিক নিয়ে ওই জেটিতে নোঙর করে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাত থেকে মুক্ত হয়ে আসা ‘এমভি জাহাজ মণি’। জাহাজটির নাবিকদের একজন নুর উদ্দিন।
মঙ্গলবার বিকাল ৩টা ৪৩মিনিটে ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজের ২৩ নাবিক ‘এমভি জাহানমনি’ নামের আরেকটি জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দর জেটিতে এসে পৌঁছান। জান্নাতুল ফেরদাউসের মতো জিম্মিদশা থেকে মুক্ত অন্য নাবিকদের স্বজনরাও হয়ে ওঠেন উচ্ছ্বসিত।
এর আগে গতকাল সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া উপকূলে নোঙর করে ‘এমভি আবদুল্লাহ’।
এদিকে টানা ৬৪ দিন পর স্বজনদের দেখা পেয়ে নাবিকরা আনন্দ-উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের জিম্মিদশায় থাকাকালীন নানা অভিজ্ঞতার কথা জানান তারা। এদেরই একজন ডেক ক্যাডেট সাব্বির হোসেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন এভাবে—‘পরিবারের কাছে আসতে পেরে অনেক খুশি। অস্ত্রের মুখ থেকে মুক্ত হয়ে আজ পরিবারের কাছে ফিরতে পেরেছি, আল্লাহর কাছে অনেক শুকরিয়া। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমির ৫৬তম ক্যাডেট আমি। বাড়িতে আব্বু, আম্মু ও ছোটবোন আছেন।’
জাহাজের তৃতীয় কর্মকর্তা মো. তারেকুল ইসলাম বলেন, কল্পনাও করিনি প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারব। সারপ্রাইজড! এ আনন্দ আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। দস্যুরা আমাদের শারীরিকভাবে অ্যাসল্ট করেছে।
ক্যাপ্টেন আবদুর রশিদ বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে এই বেঁচে ফেরার আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। জিম্মি হওয়ার পর আমাদের প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর হুমকি ছিল। আমাদের কেউই সাহস হারায়নি। নাবিকদের কখনো ভয় কাজ করলেও আমরা সবাই আমাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ স্বাভাবিক রেখেছি। আমাদের কোনো ক্রুর যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকে সর্বক্ষণ সতর্ক নজর রেখেছি। আমরা সেফটি অফ লাইফটাকে প্রাধান্য দিয়েছি।’
আতিক উল্লাহ খান ‘এমভি আবদুল্লাহ’র প্রধান কর্মকর্তা। দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়ার পর এমন দিন আর ফিরে পাবেন কি-না, তা নিয়ে সংশয় ছিল তার। দুশ্চিন্তায় ছিল পরিবারেরও। তবে এসব উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার অবসান ঘটেছে মঙ্গলবার। দীর্ঘ অপেক্ষার পর প্রিয়জনদের কাছে ফিরেন তিনি। তাকে ফিরে পেয়ে দুই মেয়ে ইয়াশরা ফাতেমা ও উনাইজা মেহবিন বরণ করে নেন ফুল দিয়ে।
জাহাজ থেকে চতুর্থ প্রকৌশলী তানভীর আহমেদ নামতেই জ্যোৎস্না বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। জ্যোৎস্না বেগম বলেন, ‘মুক্ত হওয়ার আগে ৩৩ দিনের একেকদিন আমার কাছে হাজার বছর মনে হতো। একটা রাত ঘুমাতে পারিনি, খেতে পারিনি। ছেলেকে আজ কাছে পাব, এ আনন্দ কি! তা আমার মত ভুক্তভোগী মায়েরাই বুঝবে।’
নাবিকদের সংবর্ধনা দিতে নানা ধরনের আয়োজন করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এছাড়া তাদের বরণে প্রস্তুতি নিয়েছিল এস আর শিপিংয়ের মালিকপক্ষ।
নাবিকদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ সোহায়েল ও সচিব ওমর ফারুক, কেএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক সরওয়ার জাহান রোকন, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম।
ডিজে