চট্টগ্রামে মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠান বিশুদ্ধ খাবার পানি বাজারজাত ও সরবরাহের অনুমোদন পেলেও এর বাইরে আরও ৬০টি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন নামে মিনারেল ওয়াটার ও ড্রিংকিং ওয়াটারের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে, কোনো অনুমোদনের ধার না ধেরেই।
বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিটিউটের (বিএসটিআই) কাছে পানি নিয়ে অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা থাকলেও প্রভাবশালী মহলের তদবিরে সংস্থাটিও অনেকটা অসহায়। দেখা গেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এলাকাভিত্তিক বড় ভাইদের দখলে চলছে অবৈধ পানির ব্যবসা।
অবৈধ এসব প্রতিষ্ঠান ওয়াসার পানি ছাড়াও এমনকি পুকুরের পানি জারে কিংবা বোতলে ভরে সরবরাহ করছে চট্টগ্রাম নগরজুড়ে। গ্রাহকের সরল বিশ্বাসের সাথে প্রতারণা করে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পানির ব্যবসা। এমন পানি পান জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ।
বিএসটিআই সুত্র জানায় , চট্টগ্রাম নগরী ও জেলা-উপজেলায় বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট কারখানা তৈরি করে দীর্ঘদিন থেকে জারে ও বোতলে ভরে অবৈধ পানি সরবরাহের কাজ চালিয়ে আসছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে নগরকেন্দ্রিক কারখানাগুলো ওয়াসার লাইনের পানি বোতলজাত করেই মূলত বাজারজাত করে থাকে। অনেক সময় বিএসটিআইয়ের লোগোও নকল করে বোতল কিংবা জারের গায়ে লাগিয়ে বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
জানা গেছে, গত বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে পুকুরের পানি ‘মিনারেল ড্রিংকিং ওয়াটার’ হিসেবে বিক্রি হওয়ার খবর পায় বিএসটিআই। স্থানীয় একটি চক্র ওই পানি প্লাস্টিকের জারে ভরে বিএসটিআইয়ের নকল লেবেল লাগিয়ে বাজারজাত করছিল। গোপন সূত্রে এমন খবর পেয়ে মাদামবিবিরহাট খাদেমপাড়া এলাকায় একটি কারখানায় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত। সেখানে দেখা যায়, ওই কারখানায় পুকুরের পানি জারে ভর্তি করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক ভবন ও কারখানায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।
বিএসটিআই সূত্রে জানা গেছে, নগরীতে বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে মোট ৮৬টি। এর মধ্যে ৬০টি প্রতিষ্ঠানই অবৈধভাবে পানি উৎপাদন করে বাজারজাত করছে। মাত্র ২৬টি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন রয়েছে বিএসটিআইয়ের। হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানেই অবৈধভাবে অস্বাস্থ্যকর পানি সরবরাহ করে চলছে চট্টগ্রামজুড়ে।
চট্টগ্রামে বিএসটিআই অনুমোদিত ন্যাচারাল মিনারেল ওয়াটারের মধ্যে রয়েছে— চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁওয়ের সানোয়ারা ড্রিংকস এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের উৎপাদিত ‘ইয়েস’ এবং রাউজান গহিরার শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের উৎপাদিত ‘সিনমিন’।
অন্যদিকে বিএসটিআই অনুমোদিত ড্রিংকিং ওয়াটারের মধ্যে রয়েছে— পূর্ব বাকলিয়া আবদুল লতিফ হাটে অবস্থিত আনন্দ পিওর ড্রিংকিং ওয়াটারের ব্র্যান্ড ‘আনন্দ’, দক্ষিণ খুলশীর মার্ট প্রমোটার্স লিমিটেডের কে-ওয়াটার, চকবাজার কে বি আমান আলী রোডের ম্যাক বেভারেজের ‘ম্যাক’ এবং মারস (বিডি) ফুড এন্ড বেভারেজের ব্র্যান্ড ‘নিউ ওরিয়েন্ট’, খুলশী জালালাবাদের তাকওয়া এন্টারপ্রাইজের (সিরাজ ফুড প্রোডাক্টস) ‘বাহীব’, কালুরঘাট বিসিক শিল্প এলাকার মীর ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘মীর’, এক কিলোমিটার শাহ আমানত ব্রিজ কানেকটিং রোডের নাজের ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘জারা, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার তাহেরী এগ্রো ফুডস এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘সতেজ প্রিমিয়ার’ ও ‘অ্যাকুয়া হর্স প্রিমিয়ার’, বোয়ালখালী পশ্চিম গোমদণ্ডীর কনফিডেন্স ফুড এন্ড বেভারেজের ‘কনফিডেন্স’, দক্ষিণ-মধ্য হালিশহরের জে বি এন্টারপ্রাইজের ‘দিশা’, নাসিরাবাদ শিল্প এলাকার জয় ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘মীম সুপার’, উত্তর পতেঙ্গার এমইবি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স লিমিটেডের ‘দাদা’, চান্দগাঁও শাহ আমানত সেতু সংযোগ সড়কের এস এস ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘শীতল’, পশ্চিম বাকলিয়া ডিসি রোডের শাহ গাজী ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘নীড’, সীতাকুণ্ড ভাটিয়ারীর এসএ বেভারেজ লিমিটেডের ‘মুসকান’, পটিয়া ধলঘাটের এম এন আর বি ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘সালসাবিল’, সদরঘাট স্ট্যান্ড রোডের ওরিয়েন্টেড রিফাইন্ড ওয়াটার কোম্পানির ‘মাউন্ট’, বাকলিয়া রাজাখালীর মালিক ফুড এন্ড বেভারেজ ইন্ডাস্ট্রিজের ‘লিন’, বায়েজিদ এ-ব্লকের ফেভারিটা লিমিটেডের ‘ব্লু অ্যাকোয়া’, আবকবরশাহ সলিমপুর মডেল শিল্প এলাকার মাশরিফা ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের ‘মামিয়া’।
এছাড়া তালিকায় রয়েছে— ফেনী সদর জের কাছারের এসএন্ডবি লাইস ফুডস ভ্যালি লিমিটেডের ‘দম’, ফেনী সদর ট্রাঙ্ক রোডের স্টারলাইন ফুড প্রোডাক্টসের ‘স্টারলাইন সেইফ’, ফেনী সদরের ফেনী ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের ‘ভাইটাল ফ্রেশ’।
চট্টগ্রাম ওয়াসার পরিচালক কাজী মহসিন বলেন, বিশুদ্ধ পানির নামে নিম্নমানের ও অস্বাস্থ্যকর পানি বাজারজাত করছে নগরীর ৬৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। আবার এসব প্রতিষ্ঠানের নেই বৈধ কোনো লাইসেন্স। অনুমোদনহীন এসব কারখানার পানি পানে বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
বিএসটিআই সূত্র জানায়, গত বছর চট্টগ্রাম নগরীতে কেএফ এন্টারপ্রাইজ, এ জেড এন্টারপ্রাইজ (ব্র্যান্ডের নাম: ডিউ ড্রপ), অহি ইন্টারন্যাশনাল, স্মার্ট ড্রিংকিং ওয়াটার, অজিফা ফুড এন্ড বেভারেজ নামের পাঁচটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। চলতি বছর অবৈধ কোনো প্রতিষ্ঠানে আর অভিযান চলেনি করোনা পরিস্থিতির কারণে। তবে সম্প্রতি কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আরও কয়েকটির বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
বিএসটিআই চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক শওকত ওসমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, আমরা কয়েকদিন আগেও কয়েকটি কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছি। তবে একথা সত্য যে অবৈধ পানির ব্যবসা দিন দিন বাড়ছে। একশ্রেণির প্রভাবশালীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে এ ব্যবসা।
তিনি বলেন, আমরা অনেক সময় অভিযানে গিয়েও কিছু করতে পারি না। নগরীতে যে কয়টি বিশুদ্ধ পানি উৎপাদন ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদেরও বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে পানি উৎপাদন করে বোতলজাত করছেন— এ তথ্যও আমাদের কাছে রয়েছে । তাই যাদের অনুমোদন আছে তাদেরও আমরা নজরে রাখি। তবে আমরা ধীরে ধীরে অবৈধ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সিপি