স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই প্রথম পণ্যবাহী কোনো জাহাজ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে এলো। গত সোমবার (১১ নভেম্বর) পানামার পতাকাবাহী ইউয়ান জিয়াং ফা জান নামের কনটেইনার জাহাজটি দুবাই থেকে করাচি হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। পরদিন জাহাজটি পণ্য খালাস করে ইন্দোনেশিয়ার উদ্দেশ্যে বন্দর ছেড়ে যায়। জাহাজটি থেকে ৩১৭টি পণ্যবাহী কনটেইনার চট্টগ্রামের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে খালাস করা হয়।
ঘটনাটিকে দুই দেশের মধ্যে প্রথম সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগ বলে উল্লেখ করেছে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশন। জাহাজ ভেড়ানোর সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত পাকিস্তানি হাইকমিশনার সৈয়দ আহমেদ মারুফ। এ সময় গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এই নতুন রুটটি পণ্য পরিবহনের চেইনকে স্ট্রিমলাইন করবে, ট্রানজিট সময় কমিয়ে দেবে এবং উভয় দেশের জন্য নতুন ব্যবসার সুযোগ খুলে দেবে।
এদিকে এ পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রতিবেশীদের মধ্যে এ ধরনের সরাসরি সামুদ্রিক সংযোগের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের কাছাকাছি ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের নিরাপত্তা সংস্থার একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছে, গত বছর মোংলা বন্দরের একটি টার্মিনালের অপারেটিং অধিকার সুরক্ষিত করে চীনের বিরুদ্ধে কৌশলগত জয়লাভ করেছিল ভারত। কিন্তু এখন পাকিস্তান চট্টগ্রাম বন্দরে প্রবেশাধিকার পেয়েছে। দুটি বন্দরের সমুদ্রপথে এখন পাকিস্তানি জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেবে। বিষয়টি অবশ্যই এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। কারণ মিয়ানমার চট্টগ্রামের খুব কাছাকাছি।
পাকিস্তান থেকে কার্গো জাহাজটি বাংলাদেশে আনা পণ্যের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা না গেলেও একাধিক সূত্রের বরাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, বাকি চালানগুলো খালাস করার আগে প্রাথমিকভাবে কয়েকটি বড় কনটেইনার জাহাজ থেকে নামানো হয়। সূত্রটি জানিয়েছে, ‘প্রথমে প্রায় ৪০ ফুট কন্টেইনার খুলে ফেলা হয় এবং স্থানীয় পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয় চারপাশে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করতে। এটি কোনো স্বাভাবিক নিয়ম নয়। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য প্রবেশের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।’
ওই বিশেষজ্ঞ ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি বলেন, ‘চট্টগ্রাম ও মংলা বাংলাদেশের প্রধান দুই বন্দর। গত পাঁচ দশকে এখানে পাকিস্তান জায়গা পায়নি। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হতো সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর মাধ্যমে। চট্টগ্রাম ও মংলা বাংলাদেশের দুটি প্রধান বন্দর এবং উভয় বন্দরই পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগের বাইরে রয়েছে। সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য হতো।’
এর ফলে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য আসার শঙ্কা প্রকাশ করে এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘এখন যেহেতু পাকিস্তানি জাহাজ সরাসরি চট্টগ্রামে আসবে, বাংলাদেশে নিষিদ্ধ পণ্য পাঠানোর সম্ভাবনা উড়িয়ে দিতে পারেন না।’ ২০০৪ সালে চট্টগ্রামে অস্ত্র উদ্ধারের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘যা এখনও দক্ষিণ এশিয়ায় অবৈধ অস্ত্রের বৃহত্তম জব্দ করা চালান।’
তিনি বলেন, মিয়ানমার এখনো অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। দেশটি চট্টগ্রামের কাছে হওয়ায় এ সম্পর্ক অবশ্যই এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে।
তবে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ইন্ডিপেনডেন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বন্দরে পাকিস্তানি কার্গো জাহাজের নোঙর করার বিষয়টি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের প্রতীক। এটি পাকিস্তান-বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত জটিল কূটনৈতিক সম্পর্কে উষ্ণতার নতুন দিগন্তের সূচনা করছে।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশের নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সরাসরি সমুদ্র সংযোগকে স্বাগত জানায়। পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধিরও আশা করে কর্তৃপক্ষ। ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বাণিজ্যের পরিমাণ ৮০০ মিলিয়নের নিচে নেমে গিয়েছিল।
সিপি