চট্টগ্রামে নারী নির্যাতনের ১৩ হাজার মামলা ৪ বছরে, অর্ধেকই শারীরিক
করোনাকালেই নির্যাতনের মামলা সবচেয়ে বেশি
চট্টগ্রামে বেড়েই চলেছে নারী নির্যাতন। প্রায় প্রতিদিন স্বামীর মারধর এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তার শিকার হচ্ছেন নারীরা। শুধুমাত্র ২০২২ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তিন হাজারের বেশি নারী। গত চার বছরের নারী নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১২ হাজারের অধিক । এদের মধ্যে ৫০ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতন, ৩০ শতাংশ মানসিক নির্যাতন, ২০ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। তবে গত দু’বছর ধরে গতি বেড়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের। মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য চলছে তোরজোড়। আগে একটি ট্রাইব্যুনাল থাকলেও বিচারিক কাজের গতি বাড়াতে সাতটি করা হয়েছে।
নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের তথ্যমতে, গত চার বছরে পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুক ও ধর্ষণ মামলা হয়েছে ১২ হাজার ৮৩৮ টি। এরমধ্যে ২০১৯ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা হয়েছে ৩ হাজার ২৪৮ টি। ২০২০ সালে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৯৯৮টি। ২০২১ সালে মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯৫ টি এবং চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা হয়েছে ৩ হাজার ৯৭টি। তবে করোনাকালীন সময় ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নারী ও শিশু সংক্রান্ত মামলা হয়েছে।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ হিউম্যান রাইট ফাউন্ডেশনের (বিএইচআরএফ) তথ্যমতে, চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত পারিবারিক সহিংসতার শিকার, ধর্ষণ, হত্যা, যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় সরকারিভাবে মামলা ছাড়াও রয়েছে দু’হাজারের বেশি ঘটনা। এছাড়াও বর্তমানে নারী নির্যাতনের নতুন নতুন পথ তৈরি হচ্ছে। সাইবার অপরাধের মূল টার্গেট নারী। শিক্ষিত-অশিক্ষিত সব নারীই এ ধরনের নির্যাতনের শিকার।
সম্প্রতি সময়ে চট্টগ্রাম নগরীর জামালখান এলাকায় সাত বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের পর গলাটিপে হত্যা করা হয়। এছাড়া গত ৩১ অক্টোবর মিরসরাইয়ে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করে সাদিয়া আকতার নামের এক গৃহবধূ হত্যা করা হয়। এর আগে ২৭ অক্টোবর আনোয়ারার বৈরাগ ইউনিয়নে এক গৃহবধূকে ধর্ষণে ব্যর্থ হয়ে ছুরি মেরে পালিয়ে যায় দেবর।
এছাড়া চট্টগ্রাম নগরীর পশ্চিম বাকলিয়ায় শ্বশুরবাড়িতে চার বছর ধরে টর্চারসেলে যৌন নির্যাতনের শিকার হন জেসমিন আকতার জেরিন নামের এক গৃহবধূ। গত ৩ আগস্ট কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজনীন সরওয়ার কাবেরী, স্থানীয় মহিলা কাউন্সিলর শাহিন আকতার রোজী ও হুরে আরা বিউটির সহযোগিতায় উদ্ধার করা হয় তাকে। ৬ ঘণ্টার বাকবিতণ্ডারর পর দুই শিশু সন্তানসহ তাকে উদ্ধার করা হয়।
পরে গত ১১ আগস্ট সংবাদ সম্মেলন করে তিনি নির্যাতনের বিভৎসতা তুলে ধরেন গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছি। বিয়ের পর আমার স্বামীর উপস্থিতিতে কয়েকশবার হাবিবের কাছে যৌন নিপীড়ণের শিকার হয়েছি। ১৭ জুন হাবিব যৌনলালসা চরিতার্থের উদ্দেশে আমাকে চুল ধরে বিছানায় ফেলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে স্পর্শ করার চেষ্টা করে। আমি অসম্মতি জানিয়ে চিৎকার করলে কাজের মেয়ে রোমা আকতারসহ কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে হাবিব আমার লজ্জাস্থানে সজোরে আঘাত করে। আমার লজ্জাস্থান দিয়ে অতিরিক্ত রক্তপাত হতে থাকে এক পর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি।’
জেরিন বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকে বাসায় বেলকনির গ্রিল স্থায়ীভাবে ওয়েলডিং করে দেন। হাবিব আমার শয়ন কক্ষে ঢুকবার জন্য বেলকনির ছাদ ভেঙ্গে নিচ থেকে ওঠার ও ছাদ দিয়ে পালানোর জন্য লোহার ২টি সিড়ি তৈরি করেন। যা ঢাকনা দিয়ে তৈরি করে। গভীর রাতে যখন তখন আমার শয়নকক্ষে শয্যাশায়ী থাকা অবস্থায় হাবিব ওই সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করে আমাকে যৌন নির্যাতন করতো। নির্যাতনের কথা যেন কাউকে বলতে না পারি সেজন্য আমাকে মোবাইল ব্যবহার করতে দেয়নি তারা। ঘর থেকে বের হতে দেয়নি।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার এক গৃহবধূ বলেন, ‘নিজের পছন্দ মত পরিবারের সম্মতিতে ধুমধাম করে বিয়ে হয়েছে আমাদের। প্রথম কয়েক মাস ভালোই চলছিল। কিন্তু এরপর থেকে শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রেসার দেওয়া হয় বাপের বাড়ি থেকে এটা আনতে, ওটাও আনতে। আমার বাবা এত কোটিপতি না যে, আপনাদের সব আবদার পূরণ করবে—এটা বলার পর থেকে আমার ওপর প্রতিদিন শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালালো হচ্ছে।’
শুধু বাইরের মানুষ বা শ্বশুড়বাড়ি থেকে নারীর নির্যাতনের শিকার হয়, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় পরিবার থেকে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এসব নারীরা। এসব ঘটনায় মামলার পর মামলা হলেরও রায়ের দেখা পান না ভিকটিম। অনেক সময় ভিকটিমের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটেও রায় পরিবর্তন হয়ে যায় বললে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা।
এ বিষয়ে বিএইচআরএফ’র মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান বলেন, ‘নারী নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে আইন থাকলেও নেই তার ব্যবহার। আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ছিল একটি। কিন্তু নারী নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সেটা বেড়ে সাত হয়েছে। প্রতিটি ট্রাইব্যুনালে প্রতিবছর কয়েক হাজার মামলা হচ্ছে। কিন্তু এগুলো কি আদৌ মীমাংসা হচ্ছে, সঠিক রায় পাচ্ছে?’
তিনি আরও বলেন, ‘নারী সহিংসতার বেশিরভাগ মামলা হেরে যায়, তার কারণ কোন মামলায় কোন ধারা দেওয়া হবে সেটা না জানা। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিপরীত পক্ষের ভয়ে কুঁকড়ে নারীরা মুখ খুলে কথা বলতে ভয় পায়। এ সহিংসতা রোধের জন্য আইন ছাড়াও আমাদের প্রয়োজন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।’
ডিজে