চট্টগ্রামে ড্রাগ লাইসেন্স পেতে ঘুষের রমরমা, কলকাঠি নড়ে হাজারী গলি থেকে
আড়াই হাজার টাকার লাইসেন্স পেতে দিতে হয় ৫০ হাজার
চট্টগ্রামে ওষুধ ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়ার নামে চলছে রমরমা ঘুষ বাণিজ্য। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার পর ওষুধ প্রশাসনের জেলা কার্যালয়ের চক্কর কাটতে কাটতে জুতা ক্ষয় হয়ে যায় ব্যবসায়ীদের। তবে টাকা দিলেই অল্প সময়ের মধ্যেই হাতে চলে আসে ড্রাগ লাইসেন্স। এসব লাইসেন্স করে দেওয়ার বিপরীতে প্রায় বিশ গুণ বেশি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দালাল চক্র।
নগরীর হাজারী গলি থেকে নিয়ন্ত্রণ হয় এই চক্র। হাজারী গলি ওষুধ ব্যবসায়ী সমিতি ও আলী কর্পোরেশন নামের এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ওষুধ প্রশাসনের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সঙ্গে মিলে এভাবে হাতিয়ে নিচ্ছে বিপুল পরিমাণ টাকা।
জানা গেছে, দালাল চক্রের নিয়ন্ত্রণ হাজারী লেন ঔষুধ ব্যবসায়ী সমিতি ও আলী কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী ওয়াসিমের হাতে। কোনো ব্যবসায়ী ব্যক্তিগতভাবে কাগজপত্র জমা দিয়ে লাইসেন্স না পেলেও সমিতি এবং ওয়াসিমের মাধ্যমে ঘুষ দিয়ে সহজে পেয়ে যান লাইসেন্স। সমিতিকে দেওয়া ঘুষের ভাগ যায় ওষুধ প্রশাসন কর্মকর্তাদের পকেটেও।
নিয়ম অনুযায়ী দেশে তিনটি ক্যাটাগরিতে ফার্মেসিগুলোকে ড্রাগ লাইসেন্স দেয় সরকার। গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের জন্য ‘এ’ ক্যাটাগরি, ডিপ্লোমা ফার্মাসিস্টদের জন্য ‘বি’ ক্যাটাগরি এবং দুই মাসের শর্টকোর্স সম্পন্নকারীদের জন্য ‘সি’ ক্যাটাগরি। সাধারণ ক্যাটাগরিতে একটি লাইসেন্সের বিপরীতে শহর এলাকায় ২৫০০ টাকা এবং শহরের বাইরে ১৫০০ টাকা সরকারি ফি জমা দিতে হয়। নিয়ম মেনে কাগজপত্র জমা দিয়ে তিন মাসের মধ্যে লাইসেন্স পাওয়ার কথা থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। নানা উছিলায় এই লাইসেন্স ছয়-সাত মাসেও হাতে পান না ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে আরও জানা গেছে, হাজারী গলির আলী কর্পোরেশনে গিয়ে যোগাযোগ করে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা জমা দিলে এক সপ্তাহের মধ্যে পাওয়া যায় ড্রাগ লাইসেন্স। এই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ওয়াসিম চট্টগ্রাম জেলার ওষুধ তত্ত্বাবধায়ক অফিসের সহকারী পরিচালককে ‘ম্যানেজ’ করে লাইসেন্স করিয়ে দেন। ঘুষের এই টাকার ভাগ যায় জেলা তত্ত্বাবধায়ক অফিসের সহকারী পরিচালকসহ আরও কয়েকজন কর্মকর্তার পকেটে।
সম্প্রতি চট্টগ্রামের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর কার্যালয়ে গিয়ে কয়েকজন ভুক্তভোগীর দেখা মিলেছে। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েও লাইসেন্স পাননি। এদেরই একজন ফয়সাল আহমেদ, বাড়ি মনসুরাবাদে।
ভুক্তভোগী ফয়সাল বলেন, ‘লাইসেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছি প্রায় সাত মাস হতে যাচ্ছে, লাইসেন্স পাইনি। তারপর হাজারী গলি গিয়ে এক দালালকে ধরে লাইসেন্স পাই।’
এরপর দুপুর পেরোতেই চট্টগ্রামের ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের কার্যালয়ে দেখা মেলে ওয়াসিমের। কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ঘুষের রেট নির্ধারণ করেন তিনি। এছাড়া সকাল থেকে তার পক্ষে আরও দু’জন লোক বসেছিলেন কার্যালয়ে। তারা লাইসেন্সের আবেদন করতে আসা ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স পাওয়ার সহজ উপায় হিসেবে হাজারী গলির ‘আলী কর্পোরেশন’র অফিসে যেতে বলেন।
দালালের মাধ্যমে ড্রাগ লাইসেন্স পাওয়া আবুল কাশেম নামের এক ব্যক্তি জানান, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও অনেকদিন ঘুরে যখন লাইসেন্স পাচ্ছিলাম না, তখন এক দালালের মাধ্যমে ওয়াসিমকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে লাইসেন্স পেয়েছি।
ওয়াসিমের বিষয়ে জানতে চাইলে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সাখাওয়াত হোসেন রাজু চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি চট্টগ্রাম কার্যালয়ে নতুন যোগদান করেছি। ওয়াসিম নামে কারও সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। তবে আগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তার ভালো খাতির ছিল বলে জেনেছি। আমরা তিন মাস পর পর লাইসেন্স আবেদনপত্র নিয়ে মিটিং করি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই কারা লাইসেন্স পাবেন, কারা পাবেন না। কাগজপত্র ঠিক থাকলে লাইসেন্স না পাবার কোনো কারণ নেই।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আলী কর্পোরেশনের স্বত্বাধিকারী ওয়াসিমের মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি ড্রাগ লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
ডিজে