ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট বা তরল ব্যবস্থাপনা। কিন্তু সেই তরল ব্যবস্থাপনাতেই দেখা দিয়েছে চরম অব্যবস্থাপনা। সিনিয়র বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া জুনিয়র ডাক্তার বা নার্সদের এ সম্পর্কে ধারণা নেই। ফলে তরল ব্যবস্থাপনায় রোগী সুস্থ হওয়ার বদলে মৃত্যুর মুখে যাচ্ছে। অথচ তরল ব্যবস্থাপনার গাইডলাইনে রোগীর ওজন অনুসারে কতটুকু পরিমাণের স্যালাইন দেবে, রোগীর অন্য কোনো রোগ থাকলে কিভাবে চিকিৎসা দিতে হবে—সব দেওয়া আছে। কিন্তু তা অনুসরণ করা হয় না চিকিৎসাক্ষেত্রে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের এই তরল ব্যবস্থাপনায় নিয়ম না মানার চিত্র দেখা গেছে।
তবে ডাক্তারদের দাবি, ডাক্তার বা নার্স নয়, রোগীর স্বজনরাই দায়ী তরল অব্যবস্থাপনার জন্য। ডাক্তাররা জানান, স্যালাইনের মাত্রা এক রকম দেওয়া হলেও রোগীর স্বজনরা তা বাড়িয়ে ও কমিয়ে দেয়। এমনকি টয়লেটে যাওয়ার সময় স্যালাইন বন্ধ করলে তা আবার এসে চালুও করে না অনেকে।
ডেঙ্গু চিকিৎসার গাইডলাইনে উল্লেখ আছে, শিরায় যে স্যালাইন দেওয়া হয় সেটাই হলো আইভি ফ্লুইড। এটি দেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমাপ ও বিধি রয়েছে। অতিরিক্ত স্যালাইন দেওয়া হলে সেটা হৃদযন্ত্র, কিডনি, ফুসফুসসহ দেহের বিভিন্ন অংশে প্রবেশ করতে পারে। এতে রোগীর অবস্থা হয় সংকটাপন্ন।
ন্যাশনাল গাইডলাইন ফর ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট অফ ডেঙ্গু সিনড্রোম ২০১৮ (সংশোধিত সংস্করণ ২০২০)-তে উল্লেখ আছে, মুখে তরল খাবার সহ্য না হলে রোগীকে শিরায় তরল থেরাপি শুরু করতে হবে। এছাড়া রক্ষণাবেক্ষণ হারে ০ দশমিক ৯ শতাংশ স্যালাইন রিঙ্গার ল্যাকটেট দিতে হবে। তবে তরল থেরাপির আগে যদি রেফারেন্স এইচসিটি পাওয়া যায়, তাহলে স্যালাইন, রিঙ্গার ল্যাকটেট একজন মানুষের ওজনের প্রতিকেজিতে ৫ মিলিলিটার থেকে ৭ মিলিলিটার দিয়ে শুরু করতে হবে।
যদি একজন ব্যক্তির ওজন ৬০ কেজি হয় তাহলে তাকে ৩০০ মিলিলিটার স্যালাইন দিতে হবে, সেটি এক থেকে দুই ঘণ্টার জন্য। তারপর সেটি ৫ থেকে ৩ মিলিলিটার আনতে হবে, ২ থেকে ৪ ঘণ্টার জন্য। তারপর আরও কমিয়ে ২ থেকে ৩ মিলিলিটার করতে হবে।
এদিকে ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের চিকিৎসা চট্টগ্রাম মেডিকেল এবং মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালসহ অন্যান্য মেডিকেলে হচ্ছে না—চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে এ তথ্য।
তেমনই এক রোগী কক্সবাজারের পেকুয়ার বাসিন্দা আব্দুল খালেক চট্টগ্রাম মেডিকেলে গত ১৫ নভেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এর আগে গত ১২ নভেম্বর তিনি মেডিকেলে ভর্তি হন।
আব্দুল খালেকের ভাই রফিক বলেন, ‘আমার ভাই চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তির পর প্রথম দু’দিন গেছে পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। তৃতীয় দিন সকাল থেকে স্যালাইন দেওয়া শুরু করেন ডাক্তার। কিন্তু দুপুরের পরই আমার ভাই মারা যায়। স্যালাইন দেওয়ার পরপরই ভাই শকে চলে যায়। পরে আমরা জেনেছি, আমার ভাইয়ের অ্যাজমার সমস্যা ছিল। ওয়ার্ডের এক চিকিৎসক আমাদের জানান, স্যালাইন মাত্রাতিরিক্ত পুশ হওয়ায় আমার ভাই মারা গেছেন।’
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) চট্টগ্রাম মেডিকেলের ১৬ নম্বর ওয়ার্ড গিয়ে দেখা গেছে, ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ডেঙ্গু রোগীদের ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট ঠিক নেই। রোগীর হাতে স্যালাইন দিয়ে নার্সরা আপনমনে তাদের রুমে গল্প করছেন। ডাকাডাকি করেও তাদের পাওয়া যায় না বলেও অভিযোগ অনেক রোগীর স্বজনের।
আরও দেখা গেছে, নয়ন (ছদ্মনাম) নামের এক ডেঙ্গু রোগীর শিরায় স্যালাইন লাগানো হয়েছে কয়েক ঘণ্টা আগে। স্যালাইন শেষে রক্ত চলে আসলেও নার্সকে ডেকে পাওয়া যায়নি। পরে রোগীর স্বজনই স্যালাইন বন্ধ করে দেন।
এ সময় নয়নের স্বজন জানান, নার্সকে ডেকে না পেলে আমরা কি করব? আমরাই স্যালাইন কম-বেশি করি, বন্ধ করি। সঠিক সময়ে স্যালাইন বন্ধ না রাখলে রক্ত চলে আসে।
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের স্টাফ ইনচার্জ শুক্লা সরকার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডাক্তার আমাদের যেভাবে স্যালাইন পুশ করে দিতে বলেন, সেইভাবে দিই। অনেক সময় স্যালাইন দেওয়াও হয় না। রোগীকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসা শুরু হতে হতে রোগীর অবস্থা খারাপ হয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘রোগীর ডাকে তাড়াতাড়ি যাওয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। কারণ ডেঙ্গু রোগী ছাড়াও আমাদের অন্য রোগীও দেখতে হয়।’
এছাড়া মেডিকেলের ১৩, ১৪, ১৬ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, সব ডেঙ্গু রোগীকেই একই রকমের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। যা অনেক রোগীর জন্য পরিমাণে অতিরিক্ত। মাত্রা ও সময়ে ব্যাপ্তির সমন্বয় হয়নি স্যালাইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে। বাইরের হাসপাতাল থেকে যেসব রোগী মেডিসিন ওয়ার্ডে আসছে, তাদের শুরুতেই ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের জন্য স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া কি পরিমাণ দেওয়া হবে, তা মানা হচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘আসলে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টর গোড়াতেই গলদ থেকে যাচ্ছে। হৃদরোগী, লিভার সিরোসিস, ডায়াবেটিকস, আ্যাজমা, ক্যান্সারের রোগীরা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে তাদের স্যালাইন নিয়ন্ত্রিত হতে হবে। এসব রোগীরা হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর চিকিৎসা নিতে আসলে পরবর্তীতে তাদের ফুসফুসে ও লিভারে পানি জমে যাচ্ছে। রোগী আর সারভাইভ করছে না।’
ডেঙ্গুর গাইডলাইন প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. শেখ দাউদ আদনান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুসারে করতে হবে। এ গাইডলাইনে জোর দিয়ে বলা আছে, রোগ শনাক্তের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে ফ্লুইড দিতে হবে। কোনো ধরনের রোগীকে কম থেকে বেশি, আবার কোনো কোনো রোগীকে বেশি থেকে কম পরিমাণের ফ্লুইড দিতে হবে। কোন উপসর্গে কী ধরনের চিকিৎসাব্যবস্থা নিতে হবে, কোন উপসর্গকে অ্যালার্মিং ধরে চিকিৎসা দিতে হবে, তা গাইডলাইনে বলা আছে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেলের ডেঙ্গুর ফোকাল পারসন মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেলের মেডিসিন তিন ওয়ার্ডে যেসব ডাক্তার আছেন, তারা ডেঙ্গুর চিকিৎসার বিষয়ে অভিজ্ঞ। ওয়ার্ডে ২৪ ঘণ্টা একজন মেডিকেল অফিসার থাকেন, সঙ্গে থাকেন জুনিয়র ডাক্তাররাও। ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টের অব্যবস্থাপনায় ডাক্তার, নার্সদের কোনো ভূমিকা নেই। অব্যবস্থাপনা করছে রোগীর স্বজনরা।’
অব্যবস্থাপনার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেমন ধরুন, কোনো রোগীর ৩০ ড্রপ স্যালাইন চলছে। আমরা গিয়ে দেখি, রোগীর স্বজন সেটি ২০ করে দিয়েছে। আবার যেখানে ২০ করা আছে, সেটি ৪০ করে দিয়েছে। রোগী ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় স্যালাইন বন্ধ করে রেখে তারপর যান। ওয়াশরুম থেকে ফিরে তা আর সচল করেন না। এসব কারণে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্টে অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছে রোগীরা।’
ডিজে