চট্টগ্রামে ডাক্তারের সিরিয়াল পেতেই রোগীরা হয়রান, ফি বেড়ে গেছে প্রায় দ্বিগুণ

প্রাইভেট প্র্যাকটিসে নিরবেই চলছে খেয়ালখুশির নৈরাজ্য

ভোগান্তি ছিল আগেও, কিন্তু করোনার এই সময়ে চট্টগ্রামে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ‘সিরিয়াল’ পাওয়া নিয়ে রোগীদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। সিরিয়াল পেতে হচ্ছে বহু কায়দাকানুন আর রীতিমতো কষ্ট স্বীকার করে। দিনের বেলা তিনটায় রোগী দেখার সময় নির্ধারিত থাকলেও রোগীকে সিরিয়াল নিতে যেতে হচ্ছে ডাক্তারের চেম্বারে সেই সাতসকালে— কখনও ভোর পাঁচটায়, কখনও বা ৬টায়। আবার ফোনে কোনোভাবে ধরতে পারলেও ‘সিরিয়াল’ শেষ হয়ে যাচ্ছে মিনিটদশেকের মধ্যেই।

বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সহকারীদের মুখে কথা যেন তৈরিই থাকে— ডাক্তার ১০ থেকে ১৫ জনের বেশি রোগী দেখছেন না। তবে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের সহকারীকে খরচের নামে বিকাশে টাকা পাঠালেই ‘শেষ হয়ে যাওয়া’ সিরিয়াল মিলেও যায়।

এদিকে সিরিয়াল নিয়ে এসব নাটকবাজির পাশাপাশি ডাক্তারের ফি নিয়েও চলছে খেয়ালখুশির নানা কাণ্ড। করোনার আগে যে ফি ছিল, তা ঠিক এই সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় দ্বিগুণ।

চট্টগ্রামের নামি চিকিৎসক ডা. শামীম বখস্। মেডিসিন, লিভার ও পরিপাকতন্ত্রের বিশেষজ্ঞ তিনি। রোগী দেখেন নগরীর মেহেদিবাগের ন্যাশনাল হাসপাতালে। শনিবার থেকে মঙ্গলবার তিনি রোগী দেখেন সকাল ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। আর এজন্য সিরিয়াল দেওয়া হয় শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে। আর তা শনি, সোম ও মঙ্গলবারের জন্য। শামীম বখস্ নগরীর আরেকটি বেসরকারি হাসপাতাল সিএসসিআরে রোগী দেখেন সপ্তাহে তিন দিন— সকাল সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ৩টা পর্যন্ত। মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য সিরিয়াল নিতে হয় সোমবার সকাল ৬টায়। সম্প্রতি তিনি অ্যাপয়নমেন্টের জন্য একটি ওয়েবসাইট চালু করেছেন। drshamimboksha.com-এ রয়েছে তার সিরিয়াল ও সাক্ষাৎ নেওয়ার নিয়মকানুন। সিরিয়াল ব্যবস্থাপনায় রয়েছে বখ্স ফার্মেসি। সেই ফার্মেসির ঠিকানা খোঁজ করে পাওয়া গেল গোলপাহাড় মোড়ের মেহেদীবাগ রোডের রোজ টাওয়ারের নিচতলায়।

জানা গেছে, ডা. শামীম বক্সের ওয়েবসাইট থেকে নির্দিষ্ট দিনের জন্য একটি মোবাইল ফোন নাম্বারের মাধ্যমে সিরিয়াল তালিকাভুক্ত করতে হয়। এরপর সাক্ষাতপ্রাপ্ত তারিখ ও সময়ের একঘন্টা আগে ‘বখ্স ফার্মেসি’ থেকে সিরিয়ালের প্রিন্ট কপি সংগ্রহ করে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই সেখানে দিতে হয় ২০০ টাকা। ডাক্তারকে দেখানোর পর প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধ ওই ফার্মেসি থেকে কিনলে পরে ওই ২০০ টাকা ফেরত দেওয়া হয়। আর যদি ফার্মেসি থেকে ওষুধ না কেনে, তাহলে ওই ২০০ টাকা আর ফেরত দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক রোগী। তবে ফার্মেসি সংশ্লিষ্ট একজন জানিয়েছেন, শুরুতে এই প্রথা চালু থাকলেও এ নিয়ে সমালোচনা হতে থাকলে সম্প্রতি এই ‘ফি’ আর নেওয়া হচ্ছে না।

চট্টগ্রামের বেলভিউ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী দেখেন গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. শাহানারা চৌধুরী। শাহানারা চৌধুরীর সিরিয়ালের জন্য নিদিষ্ট নম্বরে ফোন করা হলে বেলভিউ ডায়াগনস্টিকের রিসিপশন ডেস্ক থেকে ডাক্তারের সহকারী ছোটখাটো একটি সাক্ষাৎকার নেন। রোগের কেস হিস্ট্রি শুনে ওই সহকারী জানান, দুপুরে ফোন করতে। তিনি জানান, ডা. শাহানারা কেস হিষ্ট্রি শুনে রোগী দেখতে রাজি হলে মিনিটদশেকের মধ্যে নগরীর জিইসি বেলভিউ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগীকে হাজির হতে হবে। ডা. শাহানারার বর্তমান ফি ২ হাজার টাকা। করোনার আগে তার ফি ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রদীপ কুমার দত্ত। তিনি রোগী দেখেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পূর্ব গেইট সংলগ্ন লাইফ কেয়ার ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। বর্তমানে রবি, সোম ও বুধবার রোগী দেখেন দুপুর ৩টা থেকে। তাকে দেখাতে হলে রোগীকে সিরিয়াল নিতে হয় সকালে ফোনে পৌনে সাতটা থেকে ৭টার মধ্যে। তখন ফোনে সহকারী নিশ্চিত করবেন রোগীর সিরিয়াল নম্বর। ডা. প্রদীপ কুমার দত্তের ফি করোনার আগে ছিল ৩০০ টাকা আর এখন ৪০০ টাকা। প্রতিদিন রোগী দেখেন ১০ থেকে ১৫ জন।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এমএ হাসান চৌধুরী বসেন শেভরন ক্লিনিক্যাল ল্যাবরেটরিতে। সপ্তাহের শনিবার ও মঙ্গলবার তিনি সিরিয়াল নেন সপ্তাহে ৫ দিন রোগী দেখার জন্য। শনিবার ও মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে বিশেষ একটি নম্বরে ফোন করে সিরিয়াল পাওয়ার কথা থাকলে এ নম্বরটি কখনও খোলা পাওয়া যায় না বলে রোগীরা জানিয়েছেন।

বুধবার (২০ জানুয়ারি) শেভরনে ডা. এমএ হাসান চৌধুরীর সিরিয়াল নেওয়ার নিয়ম-কানুন জানতে গিয়ে পাওয়া গেল ভিন্ন চিত্র। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোগী জানান, একটি বিশেষ নম্বরে ফোন করলে যিনি ফোন ধরবেন তাকে ৫০০ টাকা বিকাশ করলেই মেলে সিরিয়াল। সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে নির্দিষ্ট ওই নম্বরে ফোন করে সিরিয়ালের জন্য অনুরোধ করলে ফোনের ওপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, সিরিয়াল পাওয়া যাবে না। সিরিয়াল পেতে হলে কিছু খরচাপাতি করতে হবে। ৫০০ টাকা বিকাশ করতে হবে। তারপর ৫০০ টাকা রোগীদের মোবাইল থেকে বিকাশ করতে দেখা গেল কয়েকজনকে। বিকাশ করেই সাথে সাথেই সিরিয়াল পেয়ে যান রোগীর কয়েকজন স্বজন। ডা. এমএ হাসান চৌধুরীর ফি করোনার আগে ৮০০ থাকলেও তিনি এখন নিচ্ছেন ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকা।

ডায়াবেটিক ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মোহাম্মদ ইফতিখার হোসেন খান বসেন সিএসসিআর হাসপাতালে। জানা গেছে, সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ফোনে সিরিয়াল নেওয়ার জন্য যে মুঠোফোন নম্বরটি নির্ধারিত আছে, তা সকাল ১০টা থেকে সোয়া দশটার মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র ১৫ মিনিট খোলা থাকলেও সিরিয়াল কপালে জোটে না রোগীর। কিন্তু সিএসসিআর হাসপাতালের রিসিপশনে গিয়ে তার সহকারীর কাছে বাড়তি টাকা জমা দিলেই মেলে সিরিয়াল— এমন অভিযোগ মিলেছে অনেক রোগীর কাছে।

সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. একে খন্দকার আজাদ রোগী দেখেন একই হাসপাতালে। শনিবার ও মঙ্গলবার তিনি রোগী দেখেন সকাল ৯টা থেকে। তার সিরিয়াল নিতে ফোন করতে হয় সকাল ৭টা থেকে ৭টা ১০-এর মধ্যে। জানা গেছে, ১০ মিনিটের মধ্যেই এই ডাক্তারের সিরিয়াল শেষ হয়ে যায়। করোনার সময়ে তিনি ফি নিচ্ছেন ১২০০ টাকা, যা আগে ছিল ৮০০ টাকা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় সপ্তাহের ৬দিন রোগী দেখেন বিকেল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত। ফোনে অবশ্য তার সিরিয়াল নেওয়ার নিয়ম নেই। রোগী কিংবা তার স্বজনকে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে নগরীর প্রবর্তক মোড়ের সেবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে ১২০০ টাকা ফি জমা করে সিরিয়াল নিতে হয়। সাড়ে সাতটা থেকে ফিসহ ১০ জন রোগীর রেজিষ্ট্রেশন শেষ হলেই সিরিয়াল নেওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

জানা গেছে, নগরীর বাইরে থেকে ডা. জয়ের কাছে রোগী দেখাতে চান, তাদের ফজরের নামাজের পরপরই বাড়ি থেকে রওনা দিতে হয়। দুইদিন আগে রাউজান থেকে আসা এক রোগীর দেখা মিললো সেবা ডায়াগনষ্টিক সেন্টারে। নাম মোহাম্মদ আলী (৬৫)। তিনি সিরিয়াল পেলেও রোগী ১০ জন হয়ে যাওয়ায় তার সাথে রিসিপশনে দাঁড়িয়ে থাকা পটিয়া থেকে আসা জয়নাল হোসেন আর সিরিয়াল পেলেন না। মোহাম্মদ আলীর সিরিয়াল ৫-এর মধ্যে থাকলেও ডাক্তার দেখতে দেখতে তার সাড়ে তিনটা চারটা নাগাদ হয়ে যাবে। তাই বাধ্য হয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েও রাহাত্তারপুল তার মেয়ের বাসায় গিয়ে আবার বিকেলে আসবেন বলে জানান মোহাম্মদ আলী। করোনার আগে ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ জয়ের ফি ছিল ৮০০ টাকা। করোনার সময় থেকে এখন নিচ্ছেন ১২০০ টাকা।

ডাক্তারের সিরিয়াল ও ফি নিয়ে রোগীদের করোনাকালে দুর্ভোগের চিত্র এমনটাই। অনেক সময় ডাক্তারের সহকারীকে বাড়তি টাকা ঘুষ দিয়ে সিরিয়াল মিললেও কোন ডাক্তারের সেটিও মিলছে না। অসুস্থ রোগীদের ভালো একটু চিকিৎসার জন্য এক ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আরেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ঘুরতে হচ্ছে ভোর হওয়ার পর থেকেই।

এমনটি হওয়া উচিত নয় জানিয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘ডাক্তারদের স্বাধীনতা রয়েছে রোগী দেখায়। তবে যারা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তাদের কাছে রেফার্ড রোগী যাওয়া ছাড়া উচিত না। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সজাগ থাকা উচিত যে তারা রেফারেল রোগী ছাড়া দেখবেন না।’

তিনি আরও বলেন, ‘সামান্য, জ্বর, সর্দি-কাশি নিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত না। কিন্তু তা না করে ভোর রাতে বা নিশিরাতে রোগীর সিরিয়াল নিয়ে রোগীর সাথে তামাশা করা ঠিক না। এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞদের একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসা উচিত।’

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার সময়ে কোন ডাক্তারকে ফোর্স দেওয়া যায় না। প্রত্যেকেরই পরিবার আছে। নিজের নিরাপত্তা রয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যে কয়জন রোগীই দেখুক তা যেন সুষ্ঠু সময় সমন্বয় করে সিরিয়াল নির্ধারণ করা হয়।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!